কেমন হতে পারতো পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটন

দিলশানা পারুল: কাপ্তাই লেককে পাহাড়ের কান্না বলা হয় আমি জানতাম না। রাঙামাটির পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া কী অদ্ভুত সুন্দর নয়নাভিরাম একটা লেক। অসাধারণ এক পর্যটন স্থান। সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জায়গার একটি। কিন্তু এই সুন্দরের পিছনে শত পাহাড়ি চাকমা পরিবারের যে কান্না চাপা পড়ে আছে, সে কান্না আমরা শুনতে পাই না। এ কান্না শুনতে দেয়া হয় না। আশির  দশকে যখন এই লেক করা হয়, তখন কয়েকশ চাকমা পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল । আজ পর্যন্ত এই পরিবারগুলো তাদের ভিটেমাটির ক্ষতিপূরণ পায়নি।

kaptai-1 এদের বেশিরভাগই এখনও ভূমিহীন। পাহাড়িদের তাদের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করা সবচেয়ে সহজ কাজ, কারণ সমতলের মতো তারা ব্যক্তি মালিকানার জমিজিরাতে অভ্যস্ত না। পাহাড়ে জমির মালিকানা সামাজিক। এক সমাজের অন্তর্ভুক্ত যে কেউ যেকোনো জমিতে চাষবাস করে খেতে পারে।

যেইটা আসলে আমাদের স্বপ্নের ব্যবস্থা। সেই কারণেই তাদের ব্যক্তির নামে সাধারণত কোনো জমি রেজিস্ট্রি করা থাকে না। সরকারি ব্যবস্থা অনুযায়ী পাহাড়ে নতুন করে কোন জমি রেজিস্ট্রেশন করা যায় না। নথিতে সবই খাস হিসেবে দেখানো আছে। কাজেই কোনো পাহাড়ি যদি একবার ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়, তার পক্ষে নতুন করে পাহাড়ে আবাস গড়া প্রায় অসম্ভব।

kaptai-2কিন্তু টুরিজমের নামে, নিরাপত্তার নামে, সেনাবাহিনীর আবাস বানানোর প্রয়োজনে, স্থাপনা বানানোর প্রয়োজনে পার্বত্য অঞ্চলে হরহামেশাই এই উচ্ছেদ অভিযান চলছে। এখন চলছে টুরিজমের নামে এই উচ্ছেদ অভিযান। যেটা আসলেই কতখানি প্রয়োজন?    

টুরিজম হচ্ছে এমন একটা ব্যবসা যেটা লাভজনক হবে কিনা তা  শতকার একশভাগ নির্ভর করে যে এলাকার টুরিজম প্রমোট করতে চাচ্ছেন সেই এলাকার  ধরনের উপর। কী রকম? যেমন ধরেন লাসভেগাস কিংবা পাতায়াতে আপনি যে জুয়া বা প্রসটিটিউশন দিয়ে ব্যবসা করতে পারবেন, সেই একই ধরনের টুরিজম আপনি ভারতের কেরালাতে পারবেন না। কেরালায় গেলে লোকে যাবে প্রকৃতি দেখতে। কাজেই কেরালায় লাভজনক টুরিজম করতে হলে আপনাকে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রেখে, প্রকৃতিকে প্রায়োরিটি দিয়ে করতে হবে। ইনফ্যাক্ট যেটা ভারত খুবই ভালো পারে এবং করে।

মনে করেন, আমাদের উত্তরবঙ্গে টুরিজমকে আপনি প্রমোট করতে চান, কিভাবে করবেন? ওখানে গেলে লোকে আমাদের প্রত্নতাত্বিক স্থানগুলো, মানে পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, কান্তজী মন্দির এইগুলাই দেখতে যাবে। ওইখানে যেয়ে লোকে জুয়া খেলতে চাইবে না। কাজেই ওখানে টুরিজম প্রমোট করতে গেলে আপনি এর প্রত্নতাত্বিক জায়গাগুলো নষ্ট করে করতে পারবেন না। একইভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চল, সবচেয়ে কালারফুল এবং সবচেয়ে ভাইব্রেন্ট সংস্কৃতি হচ্ছে এ্ই অঞ্চলের জনগোষ্ঠির, কাজেই এই এলাকায় যদি আপনাকে পযর্টনকে প্রমোট করতে হয় তাহলে এই এলাকার প্রাণ, প্রকৃতি এবং আঞ্চলিক জনগোষ্ঠির সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে তবেই তা করতে হবে। আর নইলে এই ব্যবসা লাভজনক হবে না, টেকসই হবে না। এখন কিন্তু আর মান্ধাতার আমলের পযর্টন ধারণা নেই।

hill-track-1সভ্য পৃথিবী প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে যে টুরিজম সেইখান থেকে কিন্তু সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এখন কিন্তু আর সেই যুগ নেই যে পাহাড়ের মধ্যখানে গ্র্যান্ড সুলতানের মতো একটা হোটেল করবেন, আর বিদেশিরা সব ভীড় করবে সেইখানে! যে পযর্টক পাহাড় দেখতে চাইবে সে পাহাড়ের প্রকৃতি দেখতে আসবে, পাহাড়ের সংস্কুতির রঙ কেমন সেটা আস্বাদন করতে আসবে, পাহাড়ের বৈসাবি দেখতে আসবে, সে থামি কিনতে চাইবে, অদ্ভুত সব বেতের ঝুড়ি কিনতে চাইবে, পাহাড়িদের খাবার কেমন, সেটা হবে তার জন্য এডভেঞ্চার!

যে পাহারে এসে বিরিয়ানি খেতে চাইবে সে পুরান ঢাকার রাজ্জাক হোটেলে যাক, পাহাড়ে কেন? যে ধুম মাচালে গান বাজিয়ে নাচতে চাইবে, সে কোন ডিস্ক ক্যাবারে যাক, পাহাড়ে কেন? এইটা আধুনিক টুরিজম না। আধুনিক টুরিজম ইকো টুরিজমে বিশ্বাস করে। ইকো টুরিজম মানে কি? ইকো টুরিজম মানে দায়িত্বশীল টুরিজম, যেটা প্রাণ এবং প্রকৃতিকে রক্ষা করবে, যেটা সবসময়ই আঞ্চলিক জনগোষ্ঠির স্বার্থ রক্ষা করবে এবং আঞ্চলিক জনগোষ্ঠির জীবনযাপনের মানোন্নয়ন ঘটাবে।

আঞ্চলিক জনগোষ্ঠিকে ভূমিহীন করে, তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে আর যাই হোক, লাভবান পর্যটন শিল্প হয় না। আপনি সামরিক ব্যবস্থাপনায় গুটিকয়েক আয়েশী ভবন বানাতে পারেন, কিন্তু সেইটা সামগ্রিকভাবে পাহাড়ের পর্যটন শিল্পকে প্রমোট করবে না। তাহলে আমাদের পাহাড়ে কি পযর্টন শিল্প আগাবে না? হবে, খুব চমৎকার ভাবেই হবে। যে সব দেশ পাহাড়ে লাভজনক এবং প্রকৃতি বান্ধব পর্যটন ব্যবসা করছে, তাদেরকে অনুসরণ করলেই হয়।

যেমন কেরালার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে ওখানকার হাতে তৈরি চকলেট। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট কটেজ যত আকর্ষণীয়, তৈরি করা যত সহজ এবং যতখানি কস্ট ইফেক্টিভ, বড় বড় দালান সেটা কখনই হতে পারে না। পাহাড়ে থাকবে পাহাড়ি রেস্তোরা, যেটা চালাবে স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠি, যেটায় সেবা প্রদান করবে স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠির ছেলেমেয়েরা। তাতে স্থানীয়ভাবে এম্লোয়মেন্ট যেমন জেনারেট হবে, তার চেয়েও বেশি সেটা টুরিস্টকে আকর্ষণ করতে পারবে স্থানীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির কারণে। কেন্দ্রিয় কোন পাহাড়ের পাদদেশে স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠির মেলা বসবে প্রতিদিন, যেটা দেখার জন্যই টুরিস্ট আসবে, সন্ধ্যায় সেখানে পাহাড়ি নাচ গানের আসর বসবে প্রতিদিন!

আর যারা টুরিজমকে কেন্দ্র করে ব্যবসা করতে চায় তারা এই কর্মকাণ্ডকে জীবিত রাখার জন্য পুঁজি বিনিয়োগ করবে। আপনি ইকো টুরিজমকে বেছে নিলে মিনিমাম কোন উচ্ছেদ কিংবা স্থানীয় জনগোষ্ঠির কোন ভোগান্তি হবে না, অথচ আপনার ব্যবসা ঠিকই হবে। পাহাড়ে যদি আপনাকে পর্যটন দিয়ে ব্যবসা করতে হয়, তাহলে পাহাড়ের মতো করেই করতে হবে, থাইল্যান্ডের মতো করে না। আধুনিক ইকো টুরিজম এর কতগুলো শর্ত  আছে, সেইটা যারা টুরিজমকে প্রমোট করবে তারা মানতে বাধ্য থাকবে।

  • সর্ব নিম্ন পরিবর্তন ( ইম্প্যাক্ট)
  • টুরিজম ওই নিদির্ষ্ট অঞ্চলের প্রকৃতি এবং সাংস্কৃতি বিষয়ে সচেতনতা ছরাবে
  • টুরিস্ট এবং হোস্ট দুইজনের মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরি করবে
  • যেটা প্রান প্রকুতিকে বাচাঁনোর জন্য সরাসরি অর্থ বিনিয়োগ করবে
  • যেটা আঞ্চলিক জনগোষ্ঠিকে সরাসরি অর্নৈতিক ভাবে লাভবান করবে এবং তাদের এম্পাওয়ার করবে
  • যেটা টুরিস্টদের ভিতর  ওই এলাকার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রকৃতি বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করবে  

hill-track-2দেখেন উপরের কোন শতর্টা আমাদের দেশে পাহাড়ে টুরিজম এর ক্ষেত্রে মানার চেষ্টা করা হয়? একটাও নাতো? আমাদের দেশে টুরিজম শিল্প এখনো শিশু পর্যায়ে আছে, এই কিন্তু সঠিক সময় একে সঠিকভাবে নারচার করার বড় করার। একে এখন থেকে আপনি যেভাবে নারচার করবেন সেভাবেই বড় হবে।

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের যে সৌন্দর্য, এর যে রঙিন সাংস্কৃতিক অবয়ব আমরা চাইলে এইটা পযর্টনের স্বর্ণ খনি হতে পারে আবার একটু অসচেতনতায় অংকুরেই সব বিনষ্ট হতে পারে । সবই নিভর্র করছে আমরা পাহাড়ে টুরিজম নিয়ে আসলে কতখানি সৎ তার উপর ।

শেয়ার করুন: