ফারজানা আকসা জহুরা: আমাদের সমাজে বৌ পেটানোকে কখনও খারাপ ভাবা হয় না, যতোক্ষণ না তা মারাত্মক পর্যায়ে যায়! বেশিরভাগ নারী ও পুরুষ উভয় একটু-অাধটু বৌ পেটানোকে বৈধ মনে করেন। প্রচলিত আছে, ” বৌ না পেটালে, বৌ কন্ট্রোলে থাকে না….. ভালোবাসা বাড়ে না… ইত্যাদি”। তা ওই একটু থেকেই শুরু হয় এবং শেষ হয় মারাত্মক পর্যায়ে গিয়ে।
যদি কেউ প্রথমেই বাধা দেয়, তাহলে তাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয় l হয় তো নারীটি সংসার করতে চাইছিলো … হয়তো লোকটা খুব খারাপ ছিলো না l কিন্তু স্ত্রী কেনো স্বামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলো? কেন তার দোষত্রুটি অন্যকে বললো? তাই নিয়ে সম্পর্কটা আর টিকে না, এই ক্ষেত্র পুরুষটির আশেপাশের মানুষ গুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

মজার বিষয় হলো, যখন কোনো নারী ” বিশেষ করে তার স্বামীর ” দোষত্রুটি বা ভুল ধরে ও তা সংশোধন করার চেষ্টা করে, তখন সবচেয়ে অসহযোগী মনোভাব দেখায় তার আশেপাশের অন্য নারীরা। স্বামীটিকে তার দোষত্রুটি বা ভুল ধরিয়ে সংশোধন হওয়ার জন্য কেউ তো উপদেশ দেয়ই না , বরং তার স্ত্রী চরিত্র নিয়ে টানাটানি করে l অন্য নারীরাও তখন সতী নারী পতি ভক্তি দেখিয়ে বলে ; ” তার স্বামীও এমন-তেমন করছে …. সে অসীম ধৈর্য্যশীল নারী তাই তার সংসার টিকে আছে.. ইত্যাদি “। শাশুড়ি আর নন্দন হলে তো কোনো কথায় নাই …. উল্টো বৌরে আরও দুই ঘা দেওয়ার উপদেশ দিবে।
নারীদের এই অসহযোগী মনোভাবের অন্যতম কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থায় অর্থ ও ক্ষমতা এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা সব সময় পুরুষের হাতেই থাকেl তাই ঐ যৎসামান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগের আশায় সমাজের অন্য গোষ্ঠী “নারীরা ” তাদের ভুল ধরিয়ে দিতে পারে না। অনেক সময় সুযোগ থাকার পরও …. নারীরা সমাজের ভয়ে তা করতেও পারে না, ভাবে তাকেই সবাই আক্রমণ করবে,খারাপ ভাববে …. ঘটেও তাই। কারণ সামাজিক ব্যবস্থার ও অন্যান্য কারণে সমাজে পুরুষের দোষগুলি বেশি প্রকাশিত হয় এবং সবাই সেই দোষগুলিকে স্বাভাবিক বলেই মনে করে।
অন্যদিকে সমাজিক ব্যবস্থার কারণে নারীরা তাদের দোষ গুলি প্রকাশের তেমন একটা সুযোগ পায়না l কারণ সমাজ তাকে জন্ম থেকে ভালো মেয়ে হওয়া শেখায়, ভালো মা হওয়া শেখায় , ভালো বৌ হওয়া শেখায় , পতি ভক্তি শেখায় , ভালো রান্ধুনি হওয়া শেখায় আরও অনেক কিছুই শেখায়। কিন্তু দুই একটা পরিবার বাদে কেউ মেয়েদের ভালো মানুষ হওয়া শেখায় না । নারীকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখায় না। মানুষ হিসেবে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ তা বিচার বিবেচনা করতে শেখায় না ইত্যাদি । কারণ এইগুলির কোনোটাই ভালো মেয়ে বা নারীদের লক্ষণ নয়।
উল্লেখযোগ্য যে পুরুষদেরও সমাজ অনেক কিছু শেখায় না, যেমন ভালো স্বামী হওয়া শেখায় না, একই সাথে ভালো মানুষ হওয়াও শেখায় না …বরং পুরুষ মানুষ হওয়া শেখায় ….পুরুষত্ব শেখায় , আর নারীদেরকে নারীত্ব ।
যেহেতু নারীরাও ভালো মানুষ হওয়া শেখে না তাই অনেক নারী কাজের মেয়েকে পেটায়, এটাকে তারা বৈধ মনে করে অনেকটা বৌ পেটানো র মতন। আবার অনেক নারী অন্য নারীর রুপ গুণ ও সামজিক মর্যাদাকে ও প্রতিষ্ঠাকে হিংসা করে, অনেক সময় কোনো প্রতিষ্ঠিত নারীর চরিত্র খারাপ প্রমাণিত হলে অন্য নারীরা এই ভেবে মনে মনে খুশি হয় যে …যাক বাবা তাদের চরিত্র ভালো ! কোনো নারী তালাকপ্রাপ্ত হলেও অনেক নারী খুশি হয়। কারোর বাচ্চা না হলে খুশি হয়…. বিয়ে না হলেও খুশি হয় ….. এমনকি ধর্ষিতা নারীর চরিত্র ও পবিত্রতা নিয়ে কথা বলেও অনেক নারী সুখ অনুভব করে। এইসব করে নারী নিজেকে অন্য নারীদের থেকে উচ্চতর বলে মনে করে এবং তা সে প্রমাণও করতে চায়।
যদিও এই সবকিছু নারী তার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ও সমাজ ব্যবস্থার কারণে করে। তবুও এই সমস্ত কর্মকাণ্ড পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোকে আরো বেশি শক্তিশালী করে। এমতাবস্থায় পুরুষ কর্তৃক নির্যাতিতা বেশিরভাগ নারী কখনও তার নির্যাতনের কথা সমাজের কাছে অন্য নারীর কাছে বলার সাহস পায় না। কারণ সে জানে তাকে সমাজ তো ভালো চোখে দেখবেই না, এমনকি তার আশেপাশের নারীরা তার সমালোচনা করতে করতে তাকে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যাবে। তাই তারা নিজেরাই নিজেদের উপর ঘটে যওয়া অন্যায় মেনে নেয় এবং সমাজে হ্যাপি ফ্যামিলি হিসাবে নিজেদেরকে দাঁড় করায়। আর এইভাবেই পুরুষের দোষগুলি সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশাল হয়।
যেহেতু খারাপের বা অপকর্মের কোনো সীমা নেই তাই পুরুষদের অপকর্ম বাড়তে থাকে, আর নারীরা নির্যাতিত নিপীড়িত হতে থাকে। যে পুরুষ একদিন বাইরে নারীর গায়ে হাত লাগায়, প্রতিবাদের অভাবের কারণে সেই পুরুষই একদিন নারীকে জড়িয়ে ধরবে, সুযোগ পেলে অন্ধকারে ধর্ষণ করবে। আমরা তো প্রথমেই তাদের ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছি ….. তাই না?
কিছুদিন আগে এক জরিপে দেখা গিয়েছে , ” বাসে নারীদের শরীরে হাত দেয়াকে শতকরা ৬০ ভাগ লোক বৈধ মনে করেন বা খারাপ কিছু বলে মনে করেন না “। এর অন্যতম কারণ কিন্তু আমরা। আমরাই প্রতিবাদ না করতে করতে তাদের সেই অসৎ কাজকে বৈধতা দিয়েছি। আমরা কি নিশ্চিত যে এই ৬০ ভাগের মধ্যে কেউ ধর্ষক হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে না?
যে নারী সন্তান ধারণ করে সে নিজেই ছেলে সন্তান জন্মদানে নিজেকে গর্বিত মনে করে। সেই নারী অন্য কন্যা সন্তানের মায়েদের এবং নিজের কন্যাকে বার বার সাবধান করে কন্যার চরিত্র চলাফেরা ইত্যাদি নিয়ে l অথচ সে একবারও নিজের পুত্রটির চরিত্র চলাফেরা নিয়ে প্রশ্ন করে না l আর যদি অন্য কেউ সেই নারীকে তার পুত্রটির চরিত্র চলাফেরা নিয়ে প্রশ্ন করে, তাহলে প্রতি উত্তরে সেই নারীটি বলে, “এই বয়সে একটু-আধটু করে”। আর যদি ছেলেটি প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন বলে, “পুরুষ মানুষে একটু-আধটু ওমন দোষ থাকে”। এই দেখে অন্য নারীরা এবং তার কন্যাটিও শেখে, “পুরুষ মানুষের ওমন একটু আধটু দোষ থাকে” l
কেউ কখনো ভেবে দেখে না মানুষ হিসাবে আমাদের দোষত্রুটি থাকবে ঠিক, তেমনি কাজে-কর্মেও ভুল-ত্রুটি হবে। দোষত্রুটি ধরা ভালো, দোষ ধরলে তা সংশোধন করার উপলব্ধি আসে এবং আমরা নিজেদের সংশোধন করতে পারি l কিন্তু সমাজে পুরুষের ভুল দোষত্রুটি ধরা যাবে না তার সমালোচনাও করা যাবে না , এটা একটা অবৈধ কাজ !
যে পুরুষ ছোটকালে শেখেনি মেয়েদের সাথে কিভাবে চলতে হয়, মানুষ হিসেবে তার কী করা উচিৎ আর অনুচিৎ, যে ছোটো থেকেই দেখেছে বাপরে বৌ পেটাতে, ভাইকে বৌ পেটাতে , দুলা ভাইকেও বৌ পিটাইতে … তার কাছে বৌ পেটানো কোনো পাপ না ,বরং বৈধ একটি কাজ। আর যে নারী ছোটো থেকেই জেনেছে পুরুষের দোষত্রুটি ও ভুল ধরতে মানা, ঐ সকল নারীর কাছেও পিটানি খেয়ে সংসার করাও একটা গর্বের বিষয় ।
যে সমাজ ব্যবস্থা বেশিরভাগ নারীদের শিক্ষা দেয় সুন্দরী সেবিকা হওয়ার , ভালো রাঁধুনি হওয়ার , পুরুষদের সুখ সুবিধার নিমিত্ত সমাজে বসবাস করার। যখন নারীরা শুধুই নিজেদের ঘর সংসার.. সতীত্ব ..পতি …সৌন্দর্য …ইত্যাদি রক্ষায় ও চর্চায় ব্যস্ত থাকে, যখন নারী পুরুষ উভয় ভালো কে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলতে ভুলে যায়। যখন তারা কেউই শেখে না অন্যায়কে না বলতে হয়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়। যখন তারা শুধু জানে পুরুষ ও নারী বলে তাদের কি কি করা উচিৎ আর কি কি করা উচিৎ নয় l এইরকম একটি সমাজের নারী পুরুষের কারোও কাছ থেকে আর যাই হোক মনুষ্যত্ব আশা করা যায় না। কারণ তারা জানেই না মানুষ হলে মনুষ্যত্ব থাকতে হয়। তখন ঐ সমাজে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ….খুন…. বাড়বেই কখনও কমবে না। আর ঐ সমাজের নারীরা পুরুষদের সকল ধরনের অপকর্ম লুকাতেই ব্যস্ত থাকবে।
এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে আমরা নারী পুরুষ উভয়ই, নিজেদের দোষগুলোকে ধারণ, লালন-পালন এবং চর্চা করে করে সেই গুলিরে পূণ্যের মর্যাদা দিয়ে সমাজে টিকিয়ে রেখেছি। কখনো তা আমরা সগর্বে প্রকাশ করি কখন বা তার অস্তিত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করি।