আমরা ফোঁস করতেও ভুলে গেছি

সেবিকা দেবনাথ: ধর্ম-কর্মে আমার খুব যে মতি আছে তেমনটা নয়। আবার নাস্তিক হবার মতো সাহস বা পাণ্ডিত্য কোনটাই আমার নেই। নমোঃ নমোঃ করে যতোটুকু না করলেই নয়, ততোটুকুই করি।

santals-4ছোট বেলায় ধর্মশিক্ষা বইতে একটা গল্প পড়েছিলাম। পুরো গল্পটা মনে নেই। সারমর্মটা মনে আছে। গল্পটা এমন, এক বনে একটা বিষাক্ত সাপ ছিল। সাপটার ভয়ে ওই বনের রাস্তা কেউ মাড়াতো না। এক সাধু একদিন ওই বনের পথ ধরে যাচ্ছিলেন। সাধুর সঙ্গে সাপের দেখা হলো। এ কথা, সে কথায় এবং সাধুর সংস্পর্শে এসে সাপটার জীবনে পরিবর্তন এলো। অহেতুক মানুষকে আর কামড়াবে না এবং ভয় দেখাবে না বলে সাপটা স্থির করলো। বেশ কিছুদিন পর ওই সাধু বনের পথ ধরে আবার যাচ্ছিলেন। সাধু দেখলেন রাস্তায় আধমরা হয়ে একটা সাপ পড়ে আছে। সাপটার কাছে যেতেই সাধু দেখলেন ওই সাপটাই আধমরা হয়ে পড়ে আছে।

সাধু সাপটাকে বললেন, “এ তোমার কী অবস্থা? কীভাবে হলো তোমার এই দুরবস্থা?” সাপ বললো, “আপনার কথা শুনেই আজ আমার এই অবস্থা। আপনাকে দেয়া কথামতো আর আমি কোনো মানুষকে কামড়াইনি। ভয় দেখাইনি। এরপর থেকে মানুষ আর আমাকে ভয় পেত না। ক’দিন আগে কয়েকজন মানুষ মিলে আমাকে মেরে আধমরা করে এখানে ফেলে গেছে।”

সাপের একথা শুনে সাধু বললেন, “আমি তোমাকে বিনা কারণে কাউকে কামড়াতে বা ভয় দেখাতে বারণ করেছিলাম। কেউ তোমাকে আক্রমণ করলে তখন চুপ করে থাকতে বলিনি। ফোঁস করতেও বারণ করিনি।”

আমাদের হিন্দুদের অবস্থাও হয়েছে ওই সাপটার মতো। বেশি ভালো মানুষী দেখাতে গিয়ে আমরা আত্মরক্ষা করতেও পারছি না। আক্রমণ করা তো দূরের কথা, ফোঁস করেও উঠতে ভুলে গেছি। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, মানুষ ভূত ভাবতে ভাবতে একসময় সে ভূত হয়ে যায়।

আর আমরা নিজেদের সংখ্যালঘু ভাবতে ভাবতে আমাদের মেরুদণ্ডটাও ক্ষয় হয়ে গেছে। তাই সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারি না। সাঁওতালরা আমাদের চেয়ে সংখ্যায় কয়েকশ গুণ কম। ওরা কীভাবে এত সাহস পেল? ওরা আসলেই বাঘের বাচ্চা। ত্রাণ ফিরিয়ে (পরে অবশ্য ত্রাণ গ্রহণ করেছে) দিয়ে ওরা প্রমাণ করেছে, সংখ্যা কোনো ব্যাপার না। আত্মমর্যাদা থাকা লাগে। সাহস থাকা লাগে। ঐক্য থাকা লাগে। যা আমরা অনেক আগেই খুইয়েছি। চাল-চুলোহীন মানুষগুলোর এমন দৃঢ়তা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত।

এই যে নাসিরনগরে কয়েক দফায় হামলা হলো, বাড়ি ঘরে আগুন দেয়া হলো। সর্বশেষ দুর্বৃত্তের দেয়া আগুনে একজনের মৃত্যুও হয়েছে। কই সেখানকার মানুষগুলোতো এমন সাহস দেখাতে পারলো না? পারবেও না।

sebika-3
সেবিকা দেবনাথ

সরেজমিন প্রতিবেদন করার জন্য অফিস থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছিল নাসিরনগরে। সাধারণ মানুষগুলোকে দেখে আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। অথচ তাদের নিয়ে কী ভয়ঙ্কর একটা খেলা চলছে। আশীর্বাদপুষ্ট হবার লোভ সেখানকার কিছু মানুষের মধ্যে ঢুকে গেছে। নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত ওই মানুষগুলো আর কেউ নয়, আমারই স্বগোত্রীয়। যাদের কারণে সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর ঐক্যে ফাঁটল ধরেছে। স্বার্থ রক্ষার্থে তারা সত্য ঘটনাকে বিকৃত করছে। দোষীদের শাস্তি চাইবার বদলে তাদেরই রক্ষা করতে চাইছে।

আর এই  সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে অন্যরা। প্রবাদ আছে, কাক কাকের মাংস খায় না। কিন্তু মানুষই বোধ হয় একমাত্র প্রাণী, যে কিনা হীনস্বার্থের কারণে নিজের আপনজনকে ঠকাতে এমনকি হত্যা করতেও পিছপা হয় না। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সব দায়িত্ব সরকার কেন নেবে? আমাদের কি কোন দায়িত্বই নেই? আমাদের নিয়ে শুরু হওয়া এই খেলাটা আমাদেরই বন্ধ করতে হবে। আত্মরক্ষায় আর কিছু না পারি ফোঁস তো করেতে পারি।

শেয়ার করুন: