লীনা ফেরদৌস: গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ এলাকায় এখন বড্ড প্রয়োজন একজন ইলা মিত্রের। সেই ইলা মিত্র, যিনি সমগ্র বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তেভাগা আন্দোলনের সূচনা করে। আদিবাসী সাঁওতালদের রাণীমা ইলা মিত্র কিম্বা নাচোলের রাণী যে নামেই ডাকি না কেন এমন কাউকেই আজ ভীষণ প্রয়োজন নিষ্ঠুর হামলার শিকার ওই অভাগা সাঁওতালদের।
আমরা জানি, গত সপ্তাহে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ আখ খামার এলাকায় প্রশাসন ও চিনিকলের কর্মকর্তারা পুলিশ নিয়ে সাঁওতালদের উচ্ছেদের চেষ্টা করলে সাঁওতালদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাঁধে এবং এই সংঘর্ষ ৩জন নিহত ও কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়। সাঁওতালদের অভিযোগ, এই চিনিকল এলাকা থেকে তাদের বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ করে উচ্ছেদ করা হয়েছে। তাদের প্রায় বাইশশো ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ও লুটপাট হয়েছে গবাদি পশুসহ ঘরের জিনিষপত্র। এমন কি স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ওই গ্রামের চারপাশ ঘেঁষে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয় এবং খুব রাতারাতি মিল কর্তৃপক্ষের সেই জমিতে ট্রাক্টর দিয়ে হাল চাষ শুরু করেছে। সাঁওতালদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়েছে।
ইতিহাস বলে সাঁওতালদের এই বঞ্চিত হবার অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন নয়। যুগে যুগে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে আসছে। আদিবাসী সাঁওতালরা চরিত্রগত ভাবেই প্রচণ্ড পরিশ্রমী। বহুযুগ থেকেই তারা পেটের তাগিদে জঙ্গল কেটে জমি বানিয়ে চাষাবাদ করে সোনার ফসল ফলাত। কিন্তু যখন সেই জমিতে ফসল ফলত, তখনই লোলুপ দৃষ্টি পড়ত লোভী জমিদারদের। ব্রিটিশদের মদদ পুষ্ট এই সব জমিদাররা গায়ের জোরে জমির মালিক বনে যেত এবং সাঁওতালরা হত তাদের বর্গা চাষি। অত্যাচারী সেই সব জমিদাররা সেই জমি লিজ দিত তাদের নায়েব আর কর্মচারীদের কাছে। সেই সব জোতদারদের অত্যাচারে সাঁওতালদের জীবন ছিল অতিষ্ঠ। তারা জোর করে সাঁওতালদের দিয়ে অনেকটা বিনা পারিশ্রমিকে জমি চাষ করাতো এবং বেশীর ভাগ ফসল নিজেরাই নিয়ে যেত। বহুযুগ ধরেই এভাবেই বর্গা চাষি সাঁওতালরা জমিদার আর জোতদারদের হাতে নিষ্পেষিত হয়েছিল।
ইলা মিত্র, বঞ্চিত সেই সাঁওতাল চাষিদের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজেই গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান এবং সেই সব অত্যাচারী জমিদার, জোতদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সাঁওতালদের তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তাদের অধিকার আদায়ের জন রুখে দাঁড়ান । এই আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে এবং পরিসমাপ্তি ঘটে আদিবাসী সাঁওতালদের রানিমা ইলা মিত্রের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি।
যেহেতু গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার হামলার শিকার সাঁওতালরা আবারো হামলার ভয়ে চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে, এবং এই উচ্ছেদ অভিযানে স্থানীয় প্রশাসন তাদের আস্থা ভাজন হতে পারেনি তাই ঠিক কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারছে না এখন তারা । ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল পরিবারের জন্য জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পুনর্বাসন ও ত্রাণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করা হলেও সাঁওতালরা কিন্তু সেই ত্রাণ গ্রহণ করেনি, যদিও চরম নিরাপত্তাহীনতায়, অনাহারে, খোলা আকাশের নীচে কাটছে তাদের জীবন।
সাঁওতালদের দাবি হচ্ছে উচ্ছেদকৃত জমিতেই তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। ওই জমির চারপাশ থেকে অবিলম্বে চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাঁটা তারের বেড়া অপসারণ ও আখ চাষ বন্ধ করতে হবে। সাঁওতালদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। হামলা ও হত্যার বিচারের দাবিও জানিয়েছেন ওই সাঁওতালরা, তাদের শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা কোন সরকারি ত্রাণ গ্রহণ করবে না।

আমি মনে করি তারা একদম ঠিক কাজটি করেছে, রাষ্ট্র যদি সত্যি তাদের নাগরিক মনে করে তবে তাদের বাসস্থানের অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে এই সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায়ের পাশে থাকাটা ছিল রাষ্ট্রের কর্তব্য । এদেশে অসংখ্য সরকারি সম্পত্তি দখল করেছে প্রভাবশালীরা, কই তাদের তো গুলি করে তোলা হচ্ছে না । যেখানে এই দেশের জমির ওপর সাঁওতালদের হাজার বছরের অধিকার সেই অধিকার থেকে কেন তারা আজ বঞ্চিত ! আমি মনে করি মানবতা এখানে চরমভাবে বিপন্ন হয়েছে কিন্ত কই সাঁওতালদের জন্য এখন পর্যন্ত কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থা বা কোন মানবাধিকার কর্মী তাদের অধিকারের লড়াইতে পাশে এসে দাঁড়ায়নি ।
ইলা মিত্র রক্ষণশীল সমাজের একজন নারী হয়েও অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেও দাঁড়িয়েছিলেন শোষিতের পাশে, স্বেচ্ছায় জমিদারী জীবনের সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে বঞ্চিত আদিবাসীদের অধিকার লড়াইয়ে নিবেদিত ছিলেন। এরকম সংবেদনশীল মানুষ কি আজ আর আছে আমাদের সমাজে! হয়ত নিরীহ এই আদিবাসীরা নিজেদের লড়াই এমনি ভাবে নিজেরাই লড়ে যাবে, এ যুগে কোন ইলা মিত্রের আবির্ভাব হবে না এবং এই অনাচারের বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া কোথাও দেখা যাবে না।
এই লড়াইতে এখনো পর্যন্ত সাঁওতালদের যে মনোবলের পরিচয় আমরা পাচ্ছি সেই মনোবলকে আমি স্যালুট জানাই আর প্রার্থনা করি ইলা মিত্রের মত কেউ যেন এই বঞ্চিত আদিবাসীদের অধিকারের লড়াইয়ে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়, যেন তারা আরো শক্তি পায়, সাহস পায় এবং তেভাগা আন্দোলনের মত নতুন কোন ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায়।