উম্মে মুসলিমা: স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ধর্ম ও সংস্কৃতি জাতিবিশেষের পোশাকের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকে। বলা হয়, যে দেশের মানুষের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ যতো শক্তিশালী সে দেশ ততো ঐতিহ্য রাখতে তৎপর।
সম্প্রতি ভুটান ঘুরে এসে সে ধারণা দৃঢ় হলো। ভুটানের নারী-পুরুষের প্রায় পঁচাশি শতাংশই জাতীয় পোশাক পরেন। কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পোশাক পরা বাধ্যতামূলক। কেবল ছুটির দিনে কেউ নিজের পছন্দের পোশাক ইচ্ছে হলে পরতে পারেন। কারণ সারা বিশ্বে ফ্যাশন সচেতন ছেলেমেয়ের নিকট বৈশ্বিক হাওয়াকে উপেক্ষা করা যেমন সহজ নয় তেমনি জলবায়ুভেদে এবং কর্মোপযোগী স্বাচ্ছন্দময় পোশাকের চাহিদাও অনেকসময় জাতীয় পোশাকের বাহুল্যকে এড়িয়ে চলার সাহস দেখায়। ওদিকে শীতপ্রধান দেশগুলোতে একটু গরম পড়তে না পড়তেই স্বল্পবাসের আদিখ্যেতায় মেতে ওঠেন নারী-পুরুষ সবাই।
আমাদের এ বৃষ্টিবাদল-ভ্যাপসা গরমের দেশে (যদি ধরেই নিই এদেশে নারীর জাতীয় পোশাক শাড়ি) কেজো নারীদের আর বারো হাতে পোষাচ্ছে না। সালোয়ার-কামিজ-ওড়না অনেক স্বাচ্ছন্দ্যময়। আবার ওড়না পরাও ঝকমারি। রিকশার চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে দুর্ঘটনাসহ মৃত্যুর নজিরও আছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বরেই নওগাঁর সাপাহারে ব্যাটারিচালিত ভ্যানের চাকার সাথে ওড়না পেঁচিয়ে পুষ্প সাহা নামে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ওড়না ব্যতিরেকে কোন মেয়ের পক্ষে সাধারণ জনসমাগম থেকে উত্ত্যক্তহীন হয়ে ফিরে আসার দৃষ্টান্ত কমই পাওয়া যাবে। সমস্যাটা সাবলীল চলাফেরার, মেয়েদের নয়, আমাদের সাধারণ পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির।
হিজাব কি আমাদের সংস্কৃতির পরম্পরা? মনে আছে সত্তরের দশকে বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সময় পুরো স্কুলের তিন-সাড়ে তিনশো মেয়ের মধ্যে একজন মেয়ে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে আসতো। আমরা তাকে কেন জানি ‘দাদিবুড়ি’ ডাকতাম। সে সময়ের খুব কম মায়েরা বোরকা পরতেন। শাড়ির ওপর ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকতেন না, বড়জোর আঁচল তুলে দিতেন মাথায়। এখনও বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তরে আন্দোলনরত নারীদের সাদাকালো ছবি দেখে অবাক হই। তারা বেশিরভাগই ‘মাথার প’রে দেয়নি তুলে বাস’।
অথচ এই ভ্যাপসা গরমে সেদিন পার্কে হাঁটতে গিয়ে দেখি দুজন তরুণ বাঙালি মা-বাবা (দুজনেরই পোশাক এবং অবয়ব মধ্যপ্রাচ্যীয়) পারাম্বুলেটারে বহন করা তাদের তিন-চার মাস বয়েসি কন্যাশিশুকে সামলাতে পারছেন না। একবার কোলে তুলছেন, একবার শোয়াচ্ছেন, কিন্তু শিশুটির চিল-চিৎকার থামছে না। দেখলাম মোজাসহ সারা শরীর ঢাকা পোশাক এবং শুধু মুখটুকু খোলা আঁটোসাটো হিজাবে বাচ্চাটা গরমে অস্থির হয়ে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে। কিন্তু মা-বাবা শিশুটির কান্নার অন্য কারণ খুঁজছিলেন। তাদের ধারণা এ পোশাকে তো তাদের সৃষ্টিকর্তার খুশী হবার কথা। সৃষ্টিকর্তা কি শিশুকে কষ্ট দিতে পারে?
হিজাব নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় অনেক বাকবিতণ্ডা। এখন যেহেতু বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা জঙ্গি হামলা, আইএস, তালেবান, বোকো হারাম ইত্যাদি সেহেতু এসবের সাথে সম্পর্কিত পোশাক-আশাকও অনেকের আশংকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিজাবের কারণে অনেকে হেনস্ত হন, অনেক দেশে হিজাব নিষিদ্ধ করার কথাও শোনা যায়।
ইউরোপ-আমেরিকায় সাধারণতই পোশাক-আশাক নিয়ে কারো কোন বিধিনিষেধ নেই। জঙ্গি হামলা বা নয়/এগারোর আগে এসব নিয়ে কারো মাথাব্যথাই ছিল না। যে যার যেমন ইচ্ছে পরছেন। কেউ কৌতুহলী হয়ে তাকালেই সেটা অসভ্যতার পর্যায়ে পড়ে। না তাকানোটাই সভ্যতা। যেসকল বাঙালি পুঙ্গব নিজের দেশে ওড়না-ছাড়া বা শার্ট-প্যান্ট পরা মেয়ে দেখলে উত্ত্যক্ত করে তারাই আবার আমেরিকায় গিয়ে সোজা হয়ে যায়। কারণ ওদেশের আইন শক্ত ও নারীবান্ধব। আমাদের দেশেও উত্ত্যক্ত হলে সম্প্রতি পুলিশ ডাকার জন্য টেলিফোন নম্বর প্রচার করা হচ্ছে। একজন হিজাবহীন নারী এরকম বিপদে পড়ে পুলিশের সাহায্য চেয়েছিলেন। পুলিশ সবকিছু শোনার পর বললেন ‘আপনারাও একটু রেখে-ঢেকে চলবেন’।
জ্বর তো নাহয় সারলো, কুইনাইন সারাবে কে?
শুধু চোখ দুটো খোলা রেখে সারা শরীর ঢেকে রাখার সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অসুবিধাও অনেক। এ ধরনের পোশাক পরিহিতদের সন্দেহজনক চিহ্নিত করে তল্লাশি বা জিজ্ঞাসাবাদ করতেও অনেকের ধর্মীয় অনুভূতি সহায়ক হয় না। এ পোশাক পরে শুধু নারীই নন পুরুষও অপকর্মে জড়িত হতে পারেন। সম্প্রতি ফরিদপুরের মধুখালি উপজেলায় বোরকা পরে বাড়িতে ঢুকে গৃহবধুকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
বগুড়ার একজন প্রগতিশীল কলেজ শিক্ষক বলছিলেন তার কলেজের অধিকাংশ মেয়েই হিজাব করেন, এতে পাঠদানে তেমন কোন অসুবিধা হয় না। কেবল নারীর উন্নয়ন, নারীর অগ্রগতি, নারীর মুক্তির পাঠ দেবার সময় তারা রা কাড়েন না। তবে যেসব মেয়ে শুধু চোখ খোলা রেখে (কেউ কেউ কালো চশমা পরে চোখের আকৃতি প্রকাশেও অনিচ্ছুক) পুরো মুখমণ্ডল ঢেকে রাখেন তাদেরকে চেনা এবং পাঠের প্রতিক্রিয়ায় তাদের মুখের অভিব্যক্তি প্রত্যক্ষ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এসকল নেকাবধারীদের মধ্যে ভালো ছাত্রীও থাকেন। কিন্তু শিক্ষক জ্যোতিষী নন। তার পক্ষে একজন ভালো ছাত্রীকে শনাক্ত ও প্রশংসা করা রীতিমত দুরূহ।
হিজাব, বোরকা বা টুপি-দাড়ি কি বয়সের স্বধর্মকে রুখতে পারে? কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর এক উপন্যাসে লিখেছিলেন ‘অন্তর শূন্য থাকতে চায় না, হাতড়ে বেড়ায় চারদিক। হয়তো এটাই বয়সের স্বধর্ম’। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যেসব মেয়ে হিজাব করেন, বা করতে বাধ্য হন, আমাদের সমাজ তাদের ‘সভ্য’ বা ‘ভালো’ মেয়ে বলে চিহ্নিত করে। এসব সভ্য মেয়েরা মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটবেন, পরপুরুষের সাথে কথা বলবেন না, প্রেম-ভালবাসা করা পাপ।
সেদিন দুপুরের পর জাতীয় উদ্যানে হাঁটতে গিয়ে দেখি খানিক পরপরই জোড়া ধরে প্রেমিক-প্রেমিকেরা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে গল্প করছেন। মেয়েদের প্রত্যেকের মাথায় হিজাব শোভা পাচ্ছে। ছেলেদের কারো কারো মুখে দাড়ি, কিন্তু পরনে শার্ট-প্যান্ট। গ্রামাঞ্চলের মানুষ ছড়া কাটেন ‘লজ্জার বিবি লজ্জায় মরে, গাঙ থেকে পানি এনে বাড়িতে স্নান করে’। গ্রামের বউ-ঝিদের একমাত্র ফুরসৎ বা বিনোদন ঘাটের পথে বা গোসলের সময় একে অন্যের সাথে গল্পগুজব, হাস্য-রসিকতা, যা তাদের সহজাত। রবীন্দ্রনাথের চন্দরাও ‘কুম্ভকক্ষে ঘাটে যাইতে আসিতে দুই অঙ্গুলি দিয়া ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করিয়া উজ্জ্বল চঞ্চল ঘনকৃষ্ণ চোখ দুটি দিয়া পথের মধ্যে দর্শনযোগ্য যাহা-কিছু সমস্ত দেখিয়া লয়’।
আগে করতেন না এমন ঘনিষ্টদের কয়েকজনকে হিজাব করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা ধর্মীয় কারণে নিজেদের ইচ্ছায় করেন বলে জানান। কোনো কোনো অফিসের বড়কর্তার ইচ্ছায় বা নির্দেশে তাদের নারী সহকর্মীরা হিজাব করেন। বলা বাহুল্য বড়কর্তাদের অধিকাংশই পুরুষ। বেশিরভাগ নারী তাদের বাবা-চাচা-স্বামী-ভাইদের ইচ্ছাকে সম্মান দেখান। যখন একটা প্রতিষ্ঠান বা এলাকার সিংহভাগ নারী একই ভাবাদর্শে উজ্জীবিত হন তখন বিপরীত স্রোতের নারীরা হয়ে পড়েন সংখ্যালঘু। অনেকসময় তাদের নিজের মতো করে টিকে থাকাও কঠিন হয়ে পড়ে।
আচ্ছা না হয় বুঝলাম ধনী, উচ্চশিক্ষিতদের ধর্মীয় অনুপ্রেরণা রয়েছে, কিন্তু ঐ যে কাকভোরে ও রাত ঘন হয়ে এলে যে সকল লাখ লাখ পোশাকশ্রমিক নারী কাজে যান ও ঘরে ফেরেন তারাও মাথা ঢাকেন কেন? তাদের একটাই উত্তর – নিরাপত্তার জন্য। কী থেকে নিরাপত্তা? না, বাজে পুরুষদের থেকে। কারণ পুরুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলাফেরার শাস্তি ওঁত পেতে থাকে।

পোশাক যে মানুষকে একেবারে পরিবর্তন করে না – তা নয়। পুলিশ বা সেনা সদস্য এমন কি চৌকিদার পেয়াদারাও যখন সাধারণ পোশাক ছেড়ে পেশাদারি পোশাক গায়ে চাপান তখন তাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন সাধিত হয়। হয়তো হিজাব-নেকাবও কোন কোন নারীকে নম্রতা, বিনয় বা তথাকথিত ধার্মিকতার পাঠ দেয়। কিন্তু অধিকাংশ হিজাবির ধারণা হিজাবহীনরা অধার্মিক। এদের তারা বাঁকা চোখে দেখেন। কিন্তু একধরনের পোশাক যখন সার্বজনীন হয়ে ওঠে তখন তা তার আরোপিত তাৎপর্য হারায়। তাই সোহাগী জাহান তনু, মরিয়ম আক্তার, খাদিজার মত ‘শালীন’ পোশাকের মেয়েরাও রক্ষা পান না।
আরবের নারীরা পর্দাপুশিদায় থেকেও তারা পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতনের শিকার হন না – এমন অলীক কথা কেউ বলতে পারবেন? নিজেকে সুন্দর দেখাক কে না চায়? বার্ট্যান্ড রাসেল বলেছেন ‘মানুষের হৃদয়ের সবচে মৌলিক আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে – আমাকে দেখ’। তাই বাজার বাহারি হিজাবে ছেয়ে গেছে। দোকানে হিজাবের গয়নার আলাদা কম্পোনেন্ট তৈরী হয়েছে। প্রসাধন চর্চা কয়েকগুণ বেড়েছে। এমন অনেক মেয়ে আছেন যারা নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে ঘর থেকে পর্দা করে বের হন, গন্তব্যে পৌঁছে তা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেন।
পুরুষতান্ত্রিক অভিলাষ চরিতার্থ করার সাধ পেয়ে বসলে কেবল প্রতারণাই সম্বল হবে, ওতে নিয়ন্ত্রকের মানসিকতার বিন্দুমাত্র হেরফের হবে না।