চেনা অপরিচিতা: মাস্টার্সে ভর্তি হতে পেরেছিলাম শেষপর্যন্ত। অনেক কান্নাকাটি করে। মা দেননি, বাবার কাছ থেকে ভর্তির টাকা পেয়েছিলাম। অভিনয়ের স্কুল সমাপনীতে প্রথম শ্রেণীর সাথে সাথে আরেকটা পুরস্কার জুটেছিল। সমাপনী অনুষ্ঠানের নাটকে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন শেষে খুব বড় মাপের একজন নাট্যব্যক্তিত্ব তার দলে আমাকে যোগ দিতে বলেন। শুধুমাত্র তার অনুরোধের সম্মান রক্ষার্থে আমি দলটিতে যোগ দেই। এছাড়া গানের বাইরে আমার নাটকের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ ছিল না।
অভিনয়ের স্কুলটিতে আমার মতো ইনট্রোভার্ট কিভাবে টিকে ছিলাম সে এক রহস্য। আমি আমার দৈহিক গড়ন নিয়ে যারপরনাই লজ্জিত ও আড়ষ্ট থাকতাম। নানান সময় লজ্জাকর কিছু পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো। আমাদের যোগ ব্যায়ামের ক্লাস নিতেন বেশ পরিচিত এক প্রবীণ অভিনেতা। একদিন ক্লাস শেষে প্রশ্ন করলেন, “ তুমি কি ম্যারিড?”
আমি লাল হয়ে বললাম, “জী না স্যার!”
আমার শরীরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “তাহলে এই অবস্থা কেন?”
ক্লাসে অনেকেই ছিল। তাদের সামনে লজ্জায় আরও লাল হয়ে বললাম, “ স্যার, ব্যায়াম হঠাৎ ছেড়ে দিছলাম তো, তাই।“
কী বলবো, আমি নিজেই কি জানি? সবকিছুতেই বড় বেমানান আমি। লজ্জার সাথে সাথে রাগ হতো। নিজের বেখাপ্পা শরীরটার জন্য।
অভিনয়ের ক্লাস আর কম্পিউটার ক্লাস প্রায় একই সময় ছিল। খুব কষ্ট করে ব্যাল্যান্স করতে হ’তো। এরকম একদিন কম্পিউটার ক্লাস করে অভিনয়ের ক্লাসে রুদ্ধ শ্বাসে দৌড়াচ্ছি। এর মধ্যে সিঁড়িতে স্কুলটির সমন্বয়ক অসভ্য একটা হাসি দিয়ে বললো, “আসছ? আমি তো ভাবলাম শ্বশুরবাড়ীতে গিয়ে বাচ্চাকে দুধ-টুধ খাওয়ায়ে আসছো!” একটি স্বনামধন্য গ্রুপ থিয়েটারের কেউ যে এমনভাবে কথা বলতে পারে তা সত্যি অকল্পনীয়। একজন মধ্যবয়সী পুরুষ একজন অবিবাহিতা তরুণীকে যে এভাবে বলতে পারেন না সেটা ঊনার জানা উচিৎ ছিল। কিন্তু ঊনি এভাবেই কথা বলতেন। সারা বছর আমার প্রিয় বন্ধুটির পেছনে লুকিয়ে যেতাম ঊনি সামনে এলেই। কী জানি আবার কোন নোংরা কথা শুনতে হয়! আবার কোন বিশ্রী চাউনি আমাকে ঠোকর মারে!
তবে অভিনয় স্কুলে এই যন্ত্রণা ছাড়া বাকি সময়টায় অনেক শিখেছি, আনন্দ পেয়েছি।
এই স্কুল আমাদের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। আমার আড়ষ্টতা অনেক কেটেছে। আমাদের সাথে একটি মেয়েকে ওর বাবা জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। আমরা সবাই ভাবছিলাম কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় এই অন্যায়। আমরা আমাদের শিক্ষককে বললাম। ঊনি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ছেলেটাকে ভালবাসো?” মেয়েটি আকাশ থেকে পড়ে বললো, “আমার বাবা বিয়ে ঠিক করেছে স্যার। একবার দেখেছি”।
স্যার বললেন, “ভালো না বাসলে বিয়ে করবে না”।
মেয়েটি যথেষ্ট তেজী ছিল। এই কথায় আরও জোর পেয়েছিল। বিয়েটা হয়নি।
আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন অযথা দেহগত কিছু নাটকের লাইন, অশ্লীল গালির উদাহরণ অপ্রয়োজনীয়ভাবে টেনে আনতেন। আমাদের সাথের ছেলেরা বেশ আমোদ পেতো। আমরা পেতাম লজ্জা। মেয়েদের ব্রা’র ফিতে বা পুং জননেন্দ্রিয়ের অশালীন ভাষ্য নাটকের ক্লাসে খুব প্রয়োজন মনে হয়নি। কিন্তু ছেলেদের হর্ষধ্বনি বলে দিত তার জনপ্রিয়তার মাত্রা। তিনিও হয়তো উপভোগ করতেন।
নাটকের গ্রুপে যুক্ত হওয়ার পর কিছুই করার ছিল না। আমরা যারা নতুন তারা হা করে নাটকের রিহারসেল দেখতাম। অনেক যন্ত্রণার পর মাস্টার্সে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। তাই বেশিদিন আর দলে যাওয়া হলো না। মাস্টার্স পরীক্ষার পর একটি শীর্ষস্থানীয় করপোরেট হাউজে চাকরি হয়ে গেল। কর্মক্ষেত্রটি চমৎকার ছিল। তবে এখানে পুরুষরা যতোটা সহযোগী মনোভাবাপন্ন ছিলেন, নারী বসদের ছিল মেয়েদের নিয়ে নানান ইস্যু।
পোষাক থেকে শুরু করে কারও সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, প্রসূতি মাকে গা জ্বালানো পরামর্শের বাহানায় কথা শোনানো, ইত্যাদি। শুধু মেয়েদের নয়, ছেলেদেরকেও ক্যারিয়ার বিষয়ক নানা কিছুতে হয়রান করতেন তারা। এইসব পুরুষতান্ত্রিক নারী বস নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে যে খুব সুদক্ষ ছিলেন সেটা বলা যায় না। তবে কে কার সাথে প্রেম করছে, কে কী ড্রেস বা স্যান্ডেল পরে এসেছে, কে কী বলল, এগুলো খেয়ালে এনারা বেশ তৎপর ছিলেন।
চাকরির পাশাপাশি যে ব্যাপারটি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠছিল তা হ’লো বাসায় আমার বিয়ে নিয়ে তৎপরতা। নানান জায়গার ঘটক আসতো। শাড়ীর দোকানে যেভাবে শাড়ী দেখায় সেভাবে পাত্রদের বায়োডাটা দেখাতো।
ব্যাপারটা আরও লজ্জার হয়ে উঠতো যখন আমাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পাত্র দেখাতে নিয়ে যেত, বিশেষ করে ঘটকের অফিসে। জিনিসটা কতোটা অপমানের তা যার উপর দিয়ে যায় সে বোঝে।
এর মাঝে স্বল্পভাষী আমার এক সহকর্মী আমার প্রতি তার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিষয়টি বাসায় জানানো একটা বিশাল চ্যালঞ্জ ছিল। বিয়ে ব্যাপারটি আমার কাছে মুখ্য ছিল না, মুখ্য ছিল বাসায় বিয়ের তোড়জোড় নিয়ে যে প্রহসন চলছে তা থেকে উদ্ধার পাওয়া। বিষয়টি তিনবার জানানো হয়। প্রথমবার আমার সহপাঠী আমার মাকে বলে। কিন্তু তাতে মায়ের ব্যবহারে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় না। দ্বিতীয়বার এক পরিচিত ভাই-ভাবী বলেন, তাতে বাসায় অবস্থা বেশ গুরুতর হয়ে ওঠে আমার। আমার মা তীব্রভাবে বিরোধিতা করেন। তাও, সেসময় তার সাথে কথা বলে এটুকু আশ্বাস পাই যে, এ ব্যাপারে পরে ভাবা হবে।
তৃতীয়বার বলে আমার ভাই। তবে তার আগের ঘটনাগুলো বলা দরকার।
একদিন সেই ভদ্রলোক আমাকে ফোন করেন। সেই ফোনালাপ আমার মা আড়ি পেতে শুনে ফেলেন। আলোচনার প্রধান বিষয় বিয়ে থাকলেও আমার মা কিছু কুৎসিত সন্দেহমূলক জেরা করেন আমায়। আমি লজ্জার সাথে অস্বীকার করলেও তাতে আমার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাসহীনতা একই থাকে। আমি আমার মায়ের কুঁচকে ওঠা নাকে ঘৃণা দেখি।
আমার মা অস্থির হয়ে যান তার “বিপথগামী(!)” কন্যা কে উপযুক্ত পাত্রস্থ করতে। কোনো অন্যায় না করেও আমি চোরের মতো আমার পড়ার ঘরে মাথা নিচু করে বসে থাকি সারাদিন। আমার মা-বাবা আমার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকান তা দেখে রাস্তায় রং মেখে দাঁড়ানো মেয়েটির জায়গায় নিজেকে ভাবতে একটু আটকায় না আমার। বড় লজ্জার, বড় কষ্টের, বড় অপমানের সেই সময়। বসে থাকতে থাকতে মেরুদণ্ড ব্যথা হয়ে যেতো। তবু উঠতাম না। বাবা-মায়ের সামনে পড়তে চাইতাম না আদৌ। মা বিয়ের চেষ্টা করতো, আর বাবার সাথে নাক-মুখ কুঁচকে আলাপ করতো, “দেখেছো শাড়ী পরলে ওকে কেমন লাগে!” আমার গর্ভধারিণী, আমার পিতা, আমার দৈহিক অবয়ব নিয়ে বিয়ের বাজারে নেমে যারপরনাই লজ্জিত ছিলেন। অবচেতনে ঘেন্নাও করতেন কি? আমি জানতে চাই না।
যাই হোক, কেউ আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে এবং আমার মায়ের ধারণা তার সাথে আমার চরম অন্তরঙ্গতা ঘটেছে বলেই আমি তার কথা বলছি। সেই ধারণা মাথায় নিয়ে এক পাত্রের সাথে তিনি আমার বিয়ে ঠিক করলেন।
এখানে একটু বলতে হয়। ঘটকের অফিস থেকে একগাদা বায়োডাটা আমার বাবা-মা কর্তৃক যাচাই-বাছাই হওয়ার পর আমাকে বাছতে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে যেগুলো বাদ দিয়েছিলাম সেখান থেকে একজনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করা হয়। আমি ঝামেলা করিনি। কারণ যিনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। আমি তাকে জানিয়ে দিলাম, আমার বিয়ে ঠিক। ঊনিও বুঝলেন।
আমিও মানসিকভাবে সেই বাবা-মায়ের পছন্দের পাত্রকে মেনে নিতে চেষ্টা করতে লাগলাম। পাত্রপক্ষ থেকে দু’বার আমাকে দেখে গেল। আমার মা রং-মিস্ত্রি ডেকে বাড়ি রং করানোর ব্যবস্থা নিচ্ছেন এমন সময় এক শুক্রবার আমার মাকে বেশ বিমর্ষ দেখলাম। সন্ধ্যার দিকে আমাকে নানা অদ্ভুত এবং তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে বললেন যে, এখানে বিয়ে আমার জন্য ভালো হবে না। আমার আপত্তি বা বিরোধিতা করার প্রশ্ন আসে না। কারণ বিয়েটা তাদের সিদ্ধান্তে হচ্ছিল। আমি কাউকে ভালোবাসিনি যে প্রশ্ন তুলবো।
কিন্তু কিছু টেলিফোনিক কনভারসেশন আমার কানেও এসেছিল। যেগুলোর যোগফল দাঁড়ায়, আমার মা যে হুজুরের সাথে পরামর্শ করতেন সবসময়, তিনি বলেছেন, এই পাত্রের সাথে বিয়ে হলে আমি সুখী হবো না। মূলত এ কারণেই বিয়েটা ভেঙে দেওয়া হয়। আমি কিছুটা হাঁফ ছাড়তে চাইলাম। কিন্তু আসল অত্যাচার শুরু হলো তারপর থেকে।
( চলবে…)