শান্তা মারিয়া: নিজের ভালো নাকি পাগলেও বোঝে। কিন্তু প্রেমে পাগল সেটুকুও বোঝে না। একথা কেন বলছি তা বুঝিয়ে বলার আগে একটা ঘটনা শুনুন।
কিছুদিন আগে এক আত্মীয়ার আকদ হলো। মানে বিয়ের বড় অনুষ্ঠান নয়, ঘরোয়াভাবে শুধু কাবিন হয়ে গেল। পাত্রী ডাক্তার। এক বছর হলো পাশ করেছে। ছেলেটি সাধারণ গ্র্যাজুয়েট এবং ‘হুজুর’ টাইপ। এই ছেলের সঙ্গে প্রেম হওয়ার পর থেকে মেয়েটি হিজাবও ধরেছে। পাত্রপাত্রী দুজন দুজনকে পছন্দ করেছে সুতরাং কারও কিছু বলার নেই। আকদের সময় যখন কাবিন নামা লেখা হচ্ছে তখন কনে হঠাৎ কথা বলে উঠলো।
‘আমার একটি শর্ত আছে’।
তার এ কথায় সবাই চমকে ওঠে। কী কথা?

কনে বলে, সে তালাকের অধিকার চায় না। বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বিয়ের কাবিননামা সম্পর্কে যারা জানেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, কাবিন নামার ১৮ নম্বর ঘরে লেখা থাকে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাকের অধিকার দেওয়া হলো কিনা। আজকাল সেখানে কাজী নিজে থেকেই ‘হ্যাঁ’ লিখে দেন। কারণ এখানে যদি ‘হ্যাঁ’ লেখা না থাকে তাহলে স্ত্রী তালাকের অধিকার পান না। তার মানে স্ত্রী তখন স্বামীকে তালাক দিতে পারবেন না। এরকম বিয়েতে যদি স্ত্রী কখনও তালাক দিতে চান তাহলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। সে বিশাল ঝামেলার বিষয়। ঝামেলার পরও যে তালাক দিতে পারবেন তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
‘স্ত্রীকে তালাকের অধিকার প্রদান’ এর ক্ষেত্রে আমাদের দেশে এখন কাবিন নামায় বাধ্যতামূলকভাবে ‘হ্যাঁ’ শব্দের মাধ্যমে অধিকারটি দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই মেয়েটি তার হবু স্বামীর প্রতি প্রেমের নিদর্শন দেখাতে গিয়ে বলছে, তার নাকি তালাকের অধিকার প্রয়োজন নাই। কারণ সে নাকি কখনও এই স্বামীকে তালাক দিবে না। যদিও কাজী সাহেব এবং মেয়েটির অন্য পুরুষ আত্মীয়দের চাপে শেষ পর্যন্ত কাবিননামায় তালাকের অধিকার তাকে নিতে বাধ্য করা হয়।
শুধু তাই না, আকদ হয়ে যাবার পরই মেয়েটি ঘোষণা করে যে, সে এখন থেকে আর ডাক্তারি পেশায় থাকবে না। সে চাকরি করবে না, প্র্যাকটিসও করবে না। সে শুধু নিজের পরিবারের (স্বামী ও তার পরিবার এবং নিজের মা-বোন) সদস্যদের চিকিৎসা করবে। কারণ সে যদি বাইরে প্র্যাকটিস করে তাহলে নাকি স্বামী ও অনাগত সন্তানদের সময় দিতে পারবে না। তার নিজস্ব উপার্জনেরও প্রয়োজন নেই। স্বামী তাকে যা খাওয়াবে তাতেই সে খুশি।
এই পর্যন্ত শোনার পর আমি ওই আসর ত্যাগ করি কারণ আমার মনে হচ্ছিল অবিলম্বে মেয়েটির মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন।
এই ধরনের মেয়েরা ‘প্রেমে পাগল’ হয়। পাগল হয়ে তারা নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারা মনে করে সকল প্রকার আত্মসম্মান ও অধিকার বিসর্জন দিলে প্রেমের প্রমাণ দেওয়া যাবে। এরা এক ধরনের অবসেশনের মধ্যে থাকে। যখন এই ঘোর কাটে তারপরের অবস্থা হয় বড় করুণ। নিজের হাতে নিজের দাসখত লিখে দেওয়ার পর মানুষের যে অনুভূতি হতে পারে তাদেরও অনুরূপ অনুভূতি হয়।
তখন আসে হতাশা, গ্লানি, বিষন্নতা এবং তিক্ততা।
যে মেয়েটি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পরও পেশাগত জীবন বেছে নেয় না, তাকে জরিমানা করা উচিত এই কারণে সে যে আসনটি নষ্ট করেছে, সেখানে অন্য কোনো মেয়ে বা ছেলে সুযোগ পেতে পারতো। লেখাপড়া করা, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ ইত্যাদি যে বিষয়গুলোকে সে অবহেলার চোখে দেখছে, সেই সুযোগগুলো পেতে নারীকে অনেক বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। প্রাচীনকালে এবং মধ্যযুগের প্রারম্ভে বিদুষী নারীর দেখা পাওয়া গেলেও, পরে পুরুষতন্ত্র আরও শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীর ‘আত্মা’ আছে কি না সেই বিতর্কও শুরু হয়।
বিদ্যাশিক্ষা, পেশাজীবন, স্বাধীন উপার্জন নারীর জন্য হয়ে দাঁড়ায় নিষিদ্ধ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়ার মতো মহামানবদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে বাঙালি নারীরা লেখাপড়া শেখার অধিকার ফিরে পেয়েছে। স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য, চিকিৎসা বিদ্যা শেখার অনুমতি পাওয়ার জন্য তাদের দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। চাকরি পাবার জন্য, পেশাজীবন বেছে নেবার জন্য, নিজস্ব উপার্জনের জন্য পদে পদে নারীকে দীর্ঘ সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। যে মেয়েটি ঘোষণা দেয় সে স্বামীর প্রেমে নিজেকে বিলীন করে দিয়ে পেশাজীবন ত্যাগ করলো, সে শুধু নিজের মর্যাদাকেই বিসর্জন দেয় না, নারীর দীর্ঘদিনের সংগ্রামের মুখেও চপেটাঘাত করে।

পুরুষতন্ত্র নারীর চেতনে ও মননে এ কথা খুব শক্ত করে গেঁথে দিতে চায় যে, পুরুষের ইচ্ছা মেনে নিয়ে, পুরুষের সুখের জন্য, পুরুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য জীবন ধারণ করাই নারীর জন্মের সার্থকতা। পুরুষতন্ত্রের এই জালের ভিতর যে নারী একবার নিজেকে বিসর্জন দেয়, যে ‘পুরুষতান্ত্রিক’ নারী হয়ে ওঠে, সে এই সমাজে ‘ভালো নারী’র তকমা পায় বটে, কিন্তু স্বাধীনতার আনন্দ সে আর অনুভব করতে পারে না।
আমাদের স্কুল কলেজ এবং পরিবারগুলো যদি পুরুষতন্ত্রের প্রচলিত ফ্রেম অনুযায়ী নারীকে শিক্ষা না দিয়ে, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ হতে শেখায়, তাহলে এ ধরনের পুরুষের হাতের পুতুল নারী না হয়ে তারা স্বাধীনভাবে মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারবে। তখন আর প্রেম প্রমাণ করার জন্য তাকে ‘দাস’ হতে হবে না।