জয়শ্রী দত্ত: গত জুনে পপুলিস্ট থিওরি দিয়ে ইউকে’তে যে অপ্রত্যাশিত ব্রেক্সিট ফলাফল জিতে গেলো, অনেকটা একইরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবারের আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পও জিতে গেলেন। এই পপুলিস্ট থিওরিটা ইদানিংকালে বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলোতে ভোট কৌশলে খুব কাজে লাগানো হচ্ছে, যার মাধ্যমে সে দেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে এই বলে যে আমরা তোমাদের জীবনযাপনের মানোন্নয়ন করবো ক্ষমতায় গেলে।
আর সেটা বিশ্বাস করানোর জন্য দেশগুলির জাতীয়তাবাদী নেতারা নিজ নিজ দেশের মানুষকে খুশি করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিবাসন সংক্রান্ত আইন কঠোর করাকেই বেছে নেন, কারণ সাধারণ মানুষ মাল্টি কালচারের সহাবস্থান বা ইমিগ্রেশন এর উদারপন্থা অবলম্বনের সুবিধাটা খুব একটা বুঝতে পারে না জ্ঞানের বা উদারতার স্বল্পতার জন্যে। আর সেটাকেই পুঁজি করে চরম জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে সবখানে।
যেমনটি ঘটলো আমেরিকার নির্বাচনেও! ঘরোয়া পলিসিতে ট্রাম্প হিলারিকে হারিয়ে দিয়েছে, যে ট্রাম্পের কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডই ছিলো না। পুরোপুরি আউটসাইডার।
এই ‘আউটসাইডার’ ইমেজ নামক দুর্বলতাকেও ট্রাম্প কাজে লাগিয়েছেন পুরনো রাজনীতিবিদ হিলারীর বিপক্ষে! তিনি জনগণকে বিশ্বাস করাতে সমর্থ হয়েছেন যে, একজন পুরোনো নেতা এতো বছর রাজনৈতিক পদে থেকেও তুলনামূলক কম আয়ের গোষ্ঠীর জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেননি। উল্টো অতিরিক্ত লিবারেল ইমিগ্রেশন পন্থা অবলম্বন করে খোদ আমেরিকানদের চাকুরী, ব্যবসা, ভাতা ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা থেকে পশ্চাদপদ করে রাখা হয়েছে! সুতরাং ট্রাম্প কঠোরভাবে ইমিগ্রেশন কন্ট্রোল করবেন এবং নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মসংস্থান করবেন এই প্রতিশ্রুতি দেয়ায় তিনি একজন ‘পরিবর্তনের নায়ক’ বনে গেলেন!
তাছাড়া ট্রাম্পের আরেকটা কৌশল কাজে লেগেছে তার জয়ের ক্ষেত্রে, সেটি হলো তিনি প্রথাগত নির্বাচনী প্রচার প্রক্রিয়া ফলো করেন নি ,তিনি আগে থেকেই বহুল পরিচিত সমালোচিত ব্যবসায়ী ছিলেন, এটাও তার দুর্বলতা ছিল, কেননা তিনি দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ব্যবসায়ী, সেই সাথে নারী অবমাননাকারীও! কিন্তু কোনোটাই তার বিপক্ষে ধোপে টেকেনি। কারণ তিনি সমস্ত দুর্বলতাকে হেয় জ্ঞান করে উল্টো সেই সমালোচনার ঝড়ে টুপ্ টুপ্ করে মাটিতে পড়া মিষ্টি আম কুড়িয়েছেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, যেটা তার প্রায় বিনা কষ্টে ভিন্নধর্মী প্রচারণা হিসেবে খুব কাজে দিয়েছে!তার উপর তো হিলারীর বিরুদ্ধে নিজের দলেরই বঞ্চিত প্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্সের সমর্থকদের নিষ্ক্রিয়তা ছিলই, যা হিলারিকে পিছিয়ে রেখেছিলো।
আর ফরেন পলিসির কথা যদি বলা হয়, তাহলে পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে দুজনের ডাইরেক্ট রেটোরিক, স্পিচ ডেলিভারির মধ্যে পার্থক্যটুকু ছাড়া ফরেইন পলিসিতে মানব কল্যাণ করার মতো ইচ্ছে বা মানসিকতা কি বস্তুত দুজনের কারুরই খুব একটা আছে? এমন কি ওবামা, ক্লিনটন তাদেরও সেই ইচ্ছে ছিলোনা স্পষ্টত! সেক্ষেত্রে হিলারি জয়ী হলেও পররাষ্ট্রনীতির কি খুব বেশি পরিবর্তন হতো?
হিলারির কথাই আগে ধরা যাক৷ অনেকে এটাও বলছেন, তিনি তো ফরেন সেক্রেটারি ছিলেনই অনেক বছর৷ তবু কেন গালফ স্টেট্গুলো থেকে অঢেল অর্থ নিয়ে জঙ্গিদের অস্ত্র সাপ্লাই এ প্রত্যক্ষ সাহায্য করলেন যদি মানব কল্যাণ করতেই চাইতেন? অনেকে আবার হিলারির প্রেসিডেন্ট হবার মধ্যদিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘নারী’ মন্ত্রী বা সিনেটর হিসেবে তিনি এমনকি যুগান্তকারী নারী অধিকার বিষয়ক উদ্যোগ নিয়েছিলেন এতোটা বছর, তারও কোনো সুস্পষ্ট নজির নেই, সেটাও নেগেটিভ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে হিলারির জন্য।
আর অনেকেই আমাদের দেশের তুলনা করেছেন নারী নেতৃত্বের সুযোগ পাওয়ার সাথে। আমাদের দেশের উদাহরণই যদি টানা হয়, তাহলেও একই প্রশ্ন- আমাদের নারী প্রধানমন্ত্রীরাই বা দেশের সর্বস্তরের নারীদের সার্বিক অধিকার রক্ষা ও সমুন্নত রাখতে কী উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তটা রেখে যাচ্ছেন? দেশের নেতৃত্ব দেবার জন্য, সামগ্রিক অধিকার বাস্তবায়নের জন্য, মানবকল্যাণ করার জন্য কি বিশেষ কোনো জেন্ডার এর প্রাধান্য দেখানো মানে তো নিজেরাই নিজেদের বিস্তৃত সুযোগকে আবদ্ধ করে প্রশ্নবিদ্ধ করা। সুতরাং এই তুলনা এই নির্বাচনে বাহুল্যমাত্র।
কেউ কেউ যখন কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার রক্ষার জন্য ডেমোক্রেট পার্টির কাউকে চাইছিলেন, তখন অন্যদিকে এটাও কেউ কেউ ভেবেছে খোদ ওবামাই তো কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিনিধি ছিলেন কয়েকদিন আগে পর্যন্তও! তাহলে কেন আমেরিকা জুড়ে ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে কালোদের নাভিশ্বাস উঠলো, রাস্তায় মরতে হলো ?
আবার এই প্রশ্নও এসেছে, নারীর, সমগোত্রের অধিকার হরণকারী, সাম্প্রদায়িক ট্রাম্পকে কি করে নির্বাচন করলো সে দেশের মানুষ? কিন্তু কথা হচ্ছে মানুষ যখন দরিদ্র, সুযোগ সুবিধাবঞ্চিতরা কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা পায়না, তখন তারা কোনটা বেছে নেবে- আদর্শ নাকি অন্ন?
এখানে প্রশ্ন নারীবিদ্বেষী, লম্পট ব্যবসায়ী, ডানপন্থী ট্রাম্প কেন জিতলো -তা কিন্তু নয়, তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল হতাশ আমেরিকানদের কাছে যে কেন হিলারি কে শুধুমাত্র মহিলা বলেই জেতাতে হবে যদি অন্য কোনো ‘আউটস্ট্যান্ডিং’ কোয়ালিটি দিয়ে সে ট্রাম্পকে ‘আউট ভোট’ না করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই রকম জাদুকরী কোনো যোগ্যতা দিয়ে হিলারি জনগণের মন জয় করতে পারেননি।
আর এটাও আমেরিকানরা বিবেচনা থেকে উড়িয়ে দেয়নি – সেক্সুয়াল স্ক্যান্ডাল তো স্বয়ং হিলারির হাসব্যান্ড বিল ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায়ই ঘটেছে, সেক্ষেত্রে তো ট্রাম্পের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট হবার আগেই ঘটেছে! তারা ভাবলো ক্লিনটনকে যদি আমেরিকানরা ক্ষমা করে দিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসাতে পারে, তবে ট্রাম্পকে প্রথমবারেই সুযোগ দেয়া নয় কেন? আসলে নারী অধিকার, কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার এসব কিছু নয়, এমন কি ট্রাম্পকে ভালোবেসেও নয়, বরং আমেরিকানরা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, গৎবাঁধা প্রথায় রাষ্ট্র পরিচালনা, নেটিভ ক্রাইম বৃদ্ধি, যুদ্ধবাজিতে অর্থপ্রদান, আন্তর্জাতিক সহিংসতা ইত্যাদি থেকে হতাশ হয়েই নতুনত্বে চেষ্টা করলো, এই যা। তার উপর বেটার অপশনও ছিলো না তাদের কাছে। তবে ট্রাম্পের কিছু নীরব ভোটার ছিল যারা বছরের পর বছর একই রকম আমেরিকান রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা পদ্ধতি থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলো, এমনকি ভোট জরিপেও তারা সাইলেন্ট ছিল।

তবে পররাষ্ট্রনীতিতে খুব পরিবর্তন হবে কি হবেনা ,তা নিশ্চিত করে এখনো বলাটা সমীচীন নয়, কেননা কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্সি- উভয় জায়গায় রিপাবলিকান জয় পেয়েছে। কাজেই সেক্ষেত্রে দলের চাপের মুখে না থাকলে ট্রাম্পের পক্ষে তাঁর অনুকূলে আইন পাশ করিয়ে নেয়াটা খুব কষ্টকর হবেনা। আর সেক্ষেত্রে তিনি যদি চরম জাতীয়তাবাদী কোনো আইন পাশ করিয়ে নিতে পারেন, তবে অবশ্যই বিশ্বের অন্যান্য দেশে তার প্রভাব পড়বেই, যেমন ইমিগ্রেশন, ক্লাইমেট চেঞ্জ সংক্রান্ত ইত্যাদি বিষয়ে চরম অনুদারতা দেখা যেতে পারে।
আর ঘরোয়া ক্ষেত্রে যেটা হবে তা হচ্ছে সমগোত্রীয় মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন হবে, নারীদের গর্ভপাত করার অধিকার সংক্রান্ত আইন রহিত হতে পারে- যেগুলো হিউম্যান রাইটসের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ।
অন্যদিকে নানান জায়গায় মুসলিম সম্প্রদায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে ট্রাম্পের জয়ে। কোণঠাসা হয়ে পড়ার বা প্রেজুডিসের শিকার হওয়ার ভয় ঢুকেছে ব্যাপকভাবে। কিন্তু আমেরিকান ভোটারদের ভোট প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে বিশ্লেষকরা বলছেন এই জয়ের পেছনে ধর্মীয় বা জাতিগত প্রেজুডিস খুব বড় ভূমিকা রাখেনি। তাছাড়া আমেরিকার পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র এমনভাবে তৈরী হয়ে গেছে যেখানে এই প্রেজুডিস ইস্যু দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সফল হবে না, যদি খুব কড়াকড়ি করতে চায়। তবে অবৈধ এবং ক্রিমিনাল রেকর্ডধারী ইমিগ্রান্টদের (ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে) ব্যাপারে ট্রাম্প শক্তপোক্ত অবস্থানে থাকবে বলে বোঝা গেলো।
তারপরও কিছুটা দুশ্চিন্তা রয়েই যায় যখন যেকোনো রাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদ চরম আকারে সমর্থন করা হয়, তাতে মুক্তবুদ্ধি ও বহুজাতিক সংস্কৃতির প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহনশীলতা কমতে শুরু করে, যা কিনা জেঁকে বসলে তার শিকড় উপরে ফেলা তো দুঃসাধ্য বটেই, এমনকি আশপাশের রাষ্ট্রেও সেই শিকড় বিস্তৃত হয়। আর এটা হতে থাকলে এসব দেশে শুধু কোনো এক ধর্মের , বর্ণের বা জাতির ক্ষতি নয়, বরং অন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সব শ্রেণীর ও প্রকৃতির মানুষের অস্তিত্বের বিপর্যয়ের আশংকা প্রবল হয়ে ওঠে।
তবু আশায় বাঁধি বুক। দেশ, ধর্ম, জাতি,বর্ণ -সব কিছুর আগে খেয়েপড়ে মানবতা বাঁচুক।