ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী: এবার মনে হয় ঢাকাতে একটু আগেভাগেই শীত নামবে। শীতের কাপড় কিনতে মেয়েকে নিয়ে বঙ্গবাজারে ঘুরছেন সজীব আর সামিনা দম্পতি। মধ্যবিত্ত সামর্থ্যানুযায়ী দরদাম করে কেনাকাটা চলছে। শীত আসার আগেই বাজার বেশ চড়া মনে হচ্ছে। আট বছরের ছোট্ট মেয়ে, ছিপছিপে তিতলী তার চাকরীজীবী ব্যস্ত বাবা-মায়ের সাথে মার্কেটে এসে খুবই উৎফুল্ল।
তিতলী নামের অর্থ প্রজাপতি। প্রজাপতির মতোই ফুরফুরে হয়ে বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এ দোকান- সে দোকান।আজকে তারা সোয়েটার কিনবে, ডিজনি প্রিন্সেস এর ছবিওয়ালা টি-শার্ট কিনবে। তারপর গল্পের বই কিনবে। কেনাকাটা শেষ হলে চাইনিজ খাবে – অনেক মজার একটা দিন আজকে। বাবা-মা দুজনকে একসাথে পাওয়া মানে ছোট্ট তিতলীর হাতের মুঠোয় পৃথিবীর সবটুকু আনন্দ।
সজীব আর সামিনা একটা দোকানে টুলে বসে পছন্দ আর দামাদামিতে ব্যস্ত। তিতলী এক মনে দোকানের সামনের দিকে ঝুলিয়ে রাখা ফুলেল ছাপা স্কার্ট গুলো দেখতে থাকে ঘাড় উঁচু করে।
আচমকা ঝড়ের গতিতে পেছন থেকে তিতলীর কোয়ার্টার প্যান্টের ভেতরে অতর্কিতে একটা কর্কশ হাত ঢুকিয়ে অতি নোংরা, কদর্য আঙুল চালিয়ে দেয় কে যেন। ঘটনা বুঝে ওঠার আগেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ইতর লোকটা। মাত্র আট বছর বয়সী মেয়েটি লজ্জায়, ঘৃণায় কুঁকড়ে যায়। হতভম্ব চোখে এদিক-ওদিক তাকায়, আর কেউ দেখেনি তো একটু আগে তার সাথে ঘটে যাওয়া লজ্জাকর এই দৃশ্য? এমন আচরণ কেউ করতে পারে তার কোনো ধারণাই ছিলো না।
তিতলীর সারল্যমাখা চোখের কোণ জলে টলমল। সেই জল আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে সে। অদ্ভুত এক অজানা ভয় আর অপরাধবোধে ভুগতে থাকে সে। যেন কেউ জেনে ফেললে তাকেই লজ্জা পেতে হবে। ভীষণ লজ্জা।
তিতলী জানে না, কিছুতেই এ লজ্জা তার নয়।
তিতলীর জন্য সেদিন ডিজনি প্রিন্সেসদের ছবি সম্বলিত আকাশী আর গোলাপি রঙা সোয়েটার কেনা হলো, বইয়ের দোকান থেকে বই কেনা হলো- সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল, চাইনিজেও তিতলীর পছন্দের ঝাল ঝাল থাই স্যুপ আর আমেরিকান চপসি অর্ডার করা হয়েছে। কিন্তু অন্যদিনের মতো তিতলী বইটা বারবার নাড়াচাড়া করে দেখেনি, খাবার খেতে পারেনি একটুও, বাবার সাথে গল্প করেনি। বাবা-মায়ের কোনো কথাই ঠিক তার কানে পৌঁছুতে পারছিল না। সজীব আর সামিনা মেয়ের হঠাৎ চুপসে যাওয়া খেয়াল করে ঠিকই, কিন্তু ভাবে হয়তো অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
বাড়ি ফিরে সেই রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে তিতলীর, সমানে বমি করতে থাকে। জ্বরের ঘোরে মায়ের হাত কিছুতেই ছাড়ে না সে। বাবা-মা বুঝতেই পারে না কী সাংঘাতিক এক ট্রমার মধ্যে আছে তাদের আদরের রাজকন্যা, যা তাকে সারাজীবন দুঃস্বপ্ন দেখাবে।
মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগের সেই উড়তে থাকা প্রজাপতিটা যেন তার ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা পাখা দুটো নিমেষে কোথায় হারিয়ে ফেললো! এখন তিতলী মানে এক বিবর্ণ প্রজাপতি।
তিতলীর ঘটনাটি প্রতিদিন আমাদের চারপাশে শিশুদের সাথে অহরহ ঘটতে থাকা যৌন হয়রানির এক ছিটেফোঁটা উদাহরণমাত্র। আজকে নারী ও শিশু ধর্ষণের যে হিড়িক পড়ে গেছে তার কাছে এ এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনা ছাড়া কিছুই না। কিন্তু বাবা-মায়ের অজান্তে তাদের চোখের আড়ালে বা সামনেই তিতলীর মতো অসংখ্য শিশুর জীবনে প্রতিনিয়ত এহেন যৌন হয়রানির ঘটনা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে শিশুর শৈশব- কৈশোর, কখনো বা বাকীটা জীবন।

একজন নারী তার জীবনে কতবার যৌন হয়রানির শিকার হয়, তার কী কোনো হিসেব আছে? কোন বয়স থেকে এ হয়রানি শুরু হয়, তাও কি নির্দিষ্ট করে বলা যায়? আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি ছয় মাসের শিশুও ধর্ষকের ধারালো নখ আর বিষদাঁতের ছোবল থেকে মুক্ত নয়। ধর্ষণের যে সংবাদগুলো গণমাধ্যমে আসে কেবল সে ঘটনাগুলো নিয়েই আলোচনা বা প্রতিবাদ শুরু হয়। কিন্তু যে খবর গণমাধ্যম পর্যন্ত পৌঁছায় না, সেগুলোর খোঁজ কে নেবে? নিজের বাড়িতে নিকটতম আত্মীয় বা পরিবারের আস্থাভাজন লোকদের হাতে যেসব মেয়েরা হেনস্থা হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে তার বেলায় কী হবে?
আমি মনে করি ইভটিজিং এর মধ্যে দিয়ে অনবরত ধর্ষণের বীজ বপন করা হচ্ছে। যৌন হয়রানি এই বিষবৃক্ষের কণ্টকপূর্ণ শাখা-প্রশাখা।
কেবল শারীরিকভাবে ধর্ষিত হলেই আমরা তাকে ধর্ষণের শিকার বলে থাকি। প্রকৃত অর্থে নারীমাত্রই জানেন প্রতিদিন ঘরেবাইরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে, রাস্তাঘাটে কত বিচিত্র সব পন্থায় তাদেরকে হয়রানির শিকার হতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক ধর্ষণের শামিল। “মানসিক ধর্ষণ” শব্দটির সাথে প্রত্যেক নারীই গভীরভাবে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ সব নারীই তার সমগ্র জীবনে শারীরিক ধর্ষণের শিকার হয়তো হন না। কিন্তু “মানসিক ধর্ষণ” থেকে কোনো নারীই রেহাই পান না।
ঢাকা নিউমার্কেটে হাঁটার সময় সুঁচ বিক্রেতা বাচ্চা বয়সী হকার ছেলেটি যখন কানের পাশে এসে “সুঁই” এর বদলে “আপা, আসেন শুই” বলে নির্বিকার ভঙ্গিতে আরেক নারীর দিকে একই কথা বলতে এগিয়ে যায় – একে আমরা কী বলবো কলেজ পড়ুয়া দুই বান্ধবী গাউসিয়ায় গয়নার দরদামে ব্যর্থ হয়ে পাশের দোকানে পা বাড়াতে গেলে পেছন থেকে দোকানদার উচ্চস্বরে বলে, “কী আপা, নিবেন না? রাগ করেন ক্যান.?…. মাল মাথায়!
কিশোরী ছাত্রীকে পড়াতে বসে প্রাইভেট টিউটর যখন খাতায় লিখে প্রশ্ন করে, “স্কার্টের নিচে কী পরো তুমি?”
কী নাম দেব এই বিকৃতির? একজন সন্তানসম্ভবা কর্মজীবী নারীকে যখন কর্মস্থলে অযোগ্য প্রমাণের অপচেষ্টা করা হয়, সেই অবস্থায় তার মানসিক বিষাদ কী শরীরে প্রভাব ফেলে না? বিশ্বাস করুন, এই চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও একটা ঘটনাও কাল্পনিক নয়। বরং এর চেয়ে আরো বেশি ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটেই চলেছে আমার সাথে, আপনার সাথে, আমাদের শিশুদের সাথে।
হ্যাঁ, বাস্তব অবস্থা হলো, অবুঝ শিশুকে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তার ফুলের মতো শরীরকে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে বিকৃত আনন্দে উন্মত্ত হতেও দ্বিধা করছেনা অপরাধী।
দর্জি থেকে দোকানদার, সহপাঠী থেকে সহকর্মী, হকার থেকে হাসব্যান্ড, শিক্ষক থেকে রক্ষক – সর্বত্রই তো ভক্ষক হায়েনাদের দেখা মিলছে! এদের চিহ্নিত করাটা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। সময় এসেছে প্রতিরোধের, প্রতিকারের। যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করার, সমূলে উৎপাটনের। এমন শাস্তি চাই যেন এমন অপরাধ করার স্পর্ধা না দেখায় কেউ।
কচু গাছ কাটতে কাটতে নাকি মানুষ খুন করার ট্রেনিং হয়ে যায়! তেমনি ইভ টিজিং করতে করতেই ধর্ষণের নেশা পেয়ে বসে! কিলিয়ে, লাথিয়ে, ঝেঁটিয়ে এই নেশা তাড়াতে হবে।
এভাবে চলতে দেয়া যায় না। তিতলীদের প্রজাপতিকাল ফিরিয়ে দিতেই হবে।