তোরা কি সাঁওতালই থাকবি, মানুষ হবি না!  

কামরুন নাহার রুমা: ইনবক্সে ম্যাসেজ “গুড মর্নিং ম্যাম,  এখন প্রেসক্লাবে যাচ্ছি মানববন্ধন করতে, আমাদের গাইবান্ধার ঘটনার জন্য, দোয়া করবেন ম্যাম”। আমার উত্তর ছিল ‘দোয়া করি বাবা, অনেক দোয়া, সাবধানে থেকো’।

যে মানুষটির কথা বললাম ও আমার  সন্তান, আমার বিভাগের ছাত্র তার নাম ম্যানুয়েল মুরমু – ও মানুষ (!) কীনা জানি না, তবে সাঁওতাল এটা জানি!  গোবিন্দগঞ্জে যারা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে, যাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে , যারা হাসপাতালের বেডে হাতকড়া পরে দৃষ্টিহীন চোখ নিয়ে শুয়ে আছে, ম্যানুয়েল তাদেরই একজন।

santalsসিধু মাঝি, কানু মাঝি এবং কলিয়ান হরামের নেতৃত্বে ভারতবর্ষের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ হয়েছিলো ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন থেকে ১৮৫৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। ১৮৫৫ সালে সাঁওতালরা সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। তারা এ যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল ইংরেজদের শাসন-শোষণ, সুদখোর, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ সৈন্য ও তাদের দোসর অসৎ ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর ও মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। সান্তাল হুলের ইতিহাস হতে জানা যায় দামিন-ই কোহ ছিল সাঁওতালদের নিজস্ব গ্রাম, নিজস্ব দেশ। এ যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যসহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল যোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন। সাঁওতাল বিদ্রোহের লেলিহান শিখা বৃটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধে সিদ-কানহু-চান্দ ও ভাইরব পর্যায়ক্রমে নিহত হলে ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হয় ও বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে।

সাঁওতাল জাতির ইতিহাসে সিধো-কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল যুদ্ধই ছিলো বৃহত্তম এবং গৌরবের বিষয়। তাদের এই বিদ্রোহই ভারতবর্ষে স্বাধীনতার বীজ বপন করে গিয়েছিল। এই যুদ্ধের ফলাফল হলো এই যে, ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের ব্যবস্থা করলেন। ম্যাজিট্রেট এডন সাহেব সাঁওতালদের আবেদন শুনলেন। যুদ্ধের পরে সাঁওতালদের সমস্যা বিবেচনা করে আদিবাসী সাঁওতালদের জন্য একটি জেলা বরাদ্দ করা হলো। এই জেলার নাম হলো ডুমকা। এটাই সাঁওতাল পরগনা নামে পরিচিত।

agunএখানে সাঁওতাল মানঝি্, পরানিক, পরগনা জেলার শাসন পরিচালনার জন্য দারোগা, পুলিশ ও বিভিন্ন সরকারি কমকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতা প্রাপ্ত হলো। সাঁওতালদের বিচার সালিশ তাদের আইনে করার জন্য সরকার ক্ষমতা প্রদান করলেন। খাজনা, কর প্রভৃতি তাদের হাতে অর্পণ করা হলো। তারা জেলা প্রশাসক বা ডিসির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতে থাকলো। ১৮৮৫ সালে বেঙ্গল টেনান্সি এ্যাক্ট অনুযায়ী আদিবাসীরা তাদের জমি সরকারী অনুমতি ছাড়া বিক্রি করতে পারতো না। এই আইন এখন পর্যন্ত কার্যকর আছে।

১৮৫৫ তে বিদ্রোহের যে কারণ ছিল, আজকের  কারণটা একই। তখন প্রতিপক্ষ ছিল বর্গীরা আর আজ প্রতিপক্ষ নিজের ভাই ব্রাদাররা। সে সময় সাঁওতালদের হাতে ছিল তীর ধনুক আজ তারা নিরস্ত্র; ব্রিটিশদের ছিল কামান গোলা আজ পুলিশের আছে বন্দুক। সেই কবে ব্রিটিশরা যেকোনভাবেই হোক সাঁওতালদের একটি জেলা বরাদ্দ দিয়েছিল যদিও সেখানেও ক্ষমতা প্রাপ্ত ছিল মূলত দারোগা, পুলিশ ও বিভিন্ন সরকারি কমকর্তা-কর্মচারী। ক্ষমতাপ্রাপ্তদের সেই চিত্রটাত আজও তেমনি আছে । বলা চলে তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। গত ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জে যা হলো এবং যা এখনও চলছে, তা কোথাও কোথাও সেই ১৮৫৫ এর নির্মমতাকেও হার মানাচ্ছে।

নিজের অধিকার চাইতে গিয়ে লাশ হয়েছে শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মাড্ডি, রমেশ টুডু এবং নাম না জানা আরো কেউ কেউ। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে দ্বিজেন টুডু, বিমল কিসকু এবং আরো অনেকে।

যারা এই লেখাটি পড়বেন ৬ নভেম্বরের ঘটনা তাদের সবার  জানা। সেটা বিস্তারিত লিখে কারো সময় নষ্ট করবো না।  নিজেদের জমি ফেরত চাইতে গিয়ে অবৈধ দখলদার হিসেবে বিবেচিত হয়ে যারা আজ এই স্বাধীন দেশে এমন নির্মমতার শিকার , লুণ্ঠনের শিকার, যারা একঘরে মাঝে আঝে ভাবি তাদেরকে কি ভগবান আসলেও মানুষ করে পাঠাননি!

13718818_10209779913793035_8298398876742133564_n
কামরুন নাহার রুমা

এই শহরে রোজ দখল হয়ে যাচ্ছে স্কুলের জায়গা, দখল হয়ে যাচ্ছে পুকুর, দখল হয়ে যাচ্ছে বহু গরীবের জায়গা-জমি বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্দেশ্যে, শিল্প কারখানা নির্মাণের উদ্দেশ্যে। যারা করছে তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাধর। তাদের জন্য এই দেশের আইন, পুলিশ কোনকিছুই প্রয়োজন নেই। তারা পুলিশের, আইনের ছত্রছায়ায় দখল করে, লুন্ঠন করে খুব ভদ্র কায়দায়। সেই অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোন উচ্চবাচ্য করে না। বরং প্রশাসনই উল্টো সাহায্য করে দখলবাজিতে।  

একটা কথা তো সত্যি আর তাহলো অবৈধ দখলবাজি আইনের পরিপন্থী। আমাদের দেশে আইনের শাসন বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত! সাঁওতালরা জানে না এই দেশে যেকোনো অপরাধের বিচার খুব সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় অতি দ্রুত সম্পন্ন হয়ে যায়! এই দেশে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে না তারা জানে না! যে দেশে আইনের শাসন আছে, বিচার আছে সে দেশে সাঁওতালরা দখলবাজিতে যায় তাদের এতো বড় স্পর্ধা ! তারা জানে না আইন রেডি তাদের এই সন্ত্রাসী আচরণকে দমন করতে! তারা জানে না, আমরা বোবা কালা!

সাঁওতাল বিদ্রোহ নভেম্বরে থেমেছিল, এটাও আর এক নভেম্বর। যার শুরু নভেম্বরে, তার শেষও নভেম্বরেই হোক। আসুন আমরা বদলে দেই কথাগুলো “সাঁওতাল করেনি ভগবান গো আমায় মানুষ করেছে ভগবান”!

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, পত্রপত্রিকা

কামরুন নাহার, জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

 

শেয়ার করুন: