মেয়ে, তুমি যোগ্য হও, বিকিও না নিজেকে

মোহছেনা ঝর্ণা: বিয়ের পর মানুষ যখন বাড়িতে নতুন বউ দেখতে আসে, সেখানে অনেকে শুধু নতুন বউ দেখতে আসে না, দেখতে আসে নতুন বউ আসার সময় বাবার বাড়ি থেকে কী কী জিনিসপত্র এনেছে। আমার একজন আপা আছেন। উনি গ্রামে থাকেন। পড়ালেখার সুবাদে ঢাকায় ছিলেন কিছুদিন। গ্রামে বেড়ে উঠলেও আপা কিন্তু আর সব সাধারণ গ্রামের মেয়েদের মতো সব মেনে নেয়ার কাতারে কখনোই ছিলেন না, এখনও নেই। 

jharna-mohsena
মোহছেনা ঝর্ণা

বিয়ের সময় বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক নামক কোনো মোড়ক-ঢাকা রক্তবিন্দু সাথে করে নিয়ে যাননি তিনি। এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল তার। আর তাই শ্বশুর বাড়ির লোকজন ছিলেন বেশ বিরাগভাজন। কিন্তু ভদ্রতার মুখোশের কারণে বিরাগটা নগ্নভাবে প্রকাশ করতে পারতেন না। কারণ যৌতুকের ব্যাপারে তারা প্রকাশ্যে কোনো দরদাম করেননি। কিন্তু মনে মনে যে অনেক আশা ছিল তা বিয়ের পর বউ যখন ঝাড়া হাত-পা নিয়ে বাড়ি এসেছে তখন তাদের হতাশায় স্পষ্ট হয়ে উঠে। আর তাই আকারে ইঙ্গিতে অনেক কথাই শুনিয়েছে আপাকে। অসহ্য হওয়া সত্ত্বেও সহ্য করেই যাওয়ার চেষ্টা করেছিল আপা।

একদিন আপার শ্বশুর বাড়ির এক নিকটাত্মীয় আপাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো, কত আশা করেছিলাম নতুন বউ এলে নতুন লেপ-তোষক আসবে, বিছানা-বালিশ আসবে, একটু আরাম করে ঘুমাবো, আহারে এমনই কপাল, কিছুই হলো না, আশা, আশাই থেকে গেলো।
যিনি কথাগুলো বললেন তিনি বোধহয় ঘূণাক্ষরেও টের পাননি যাকে বলছেন সে অনেকদিন ধরেই এমন কোনো জবাব দেয়ার জন্যই প্রস্তুত হয়েই আছে।
আপা বললেন, আপনাদের বাড়িতে যে শোয়ার জন্য বিছানা- বালিশ নেই তা তো আমার বাবা-মা জানতো না, তাই কিছু পাঠায়নি। এখন যখন জানবে নিশ্চয়ই পাঠাবে। আমার বাবার দয়ার শরীর। নিজের কষ্ট হলেও দুস্থদের সাহায্য করতে পিছপা হয়নি কখনো।

এ গল্প যখন শুনেছি, মুখ নিঃসৃত প্রথম শব্দই ছিল ,”সাবাশ”!
আর মনে মনে কতবার যে আপাকে স্যালুট জানিয়েছি। এ লেখার মাধ্যমে আজ আবার স্যালুট জানাচ্ছি। গল্পটা আপার ছোট বোনের কাছ থেকে শুনেছিলাম বলে আপার সাথে সরাসরি এ বিষয়ে কখনো কিছু বলিনি। তবে আপার এ গল্প সবসময়ই প্রেরণাদায়ক ছিল আমার জন্য।

আপার মা একবার মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার পর সে বাড়ির দু’একজন বউ বিয়ের সময় বাবার বাড়ি থেকে কী কী এনেছে সেগুলোর গল্প করছিল। সেসব গল্পে আপার মায়ের কোনো আগ্রহ না থাকা সত্বেও শুনেছিল। গল্পের এক পর্যায়ে একজন বউ জিজ্ঞেস করল, আপনি আপনার মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের জন্য কী কী পাঠিয়েছেন?
আপার মা তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, যাদের নিজেদের যোগ্যতায় ঘাটতি আছে তাদের ঘাটতি পূরণের জন্য ঘরভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে আসতে হয়। আমার জানামতে আমার মেয়ের তেমন কোনো ঘাটতি ছিল না, এখনো নেই। আমার মেয়ে নিজেই যথেষ্ট যোগ্য।

আপার মায়ের কথা শুনে আপার শ্বশুরবাড়ির সেই নতুন বউয়ের কী অবস্থা হয়েছিল আমি জানি না। তবে আপার মাকে মনে মনে আমি সাধুবাদ জানিয়েছি অনেকবার। আজ আবার জানাচ্ছি এ লেখার মাধ্যমে। কারণ সন্তানকে তিনি মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন স্পষ্টভাষী মানুষ বানাতে পুরোপুরি সক্ষম হয়েছিলেন।

আমাদের সব মায়েরা যদি মেয়েদের মনে আত্মসম্মানবোধের এই বীজ খুব শৈশবে মনের মধ্যে গেঁথে দিতে পারে তবে মেয়েটি এ জীবনে নিজের আত্মসম্মান বিকিয়ে দেয়ার মতো কোনো কাজ কখনো করবে না নিশ্চিত।
এতে করে বেঁচে যাবে আমাদের এই যুগের হৈমন্তীরা। যৌতুকের থাবা আর কাবু করতে পারবে না আমাদের হৈমন্তীদের। নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যই জাগিয়ে রাখতে হবে আত্মসম্মানবোধ।

শেয়ার করুন: