
গোধূলি খান: সারা পৃথিবী তাকিয়ে আছে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফলের দিকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা যাবে ৪৫তম রাষ্ট্রপতি কে হতে চলেছেন। আগামী চার বছর কে থাকবেন ওয়াশিংটন ডিসির সাদা বাড়িটায়।
বাব্বা বিশাল ব্যাপার। এই নির্বাচনের খবরাখবর না জেনে উপায় আছে? বিশ্ব মোড়লের নির্বাচন বলে কথা! শুধু কী মোড়ল, পৃথিবীর সব থেকে ক্ষমতাবান দেশের ক্ষমতাধর মানুষটি নির্বাচিত হবেন। চার বছর আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে আটটি বছর ধরে বিশ্বকে শাসন করবেন। সেই মোড়লি কে করবে আর সেই খবর সশরীরে কভার না করলে সাংবাদিকতাই বা কীসের!
আবার দেখতে হবে না কী ঝলমলে, গ্ল্যামারাস একটা ইভেন্ট। ওই ইভেন্টে শরীক হতে শুধু আমাদের মতো গরীব দেশ থেকেই না, মোটামুটি প্রায় সব দেশ থেকে সাংবাদিক এসেছে আমেরিকাতে। নিউইয়র্ক শহরে ভীড় বাড়াচ্ছেন তারা।
এ যে সব থেকে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপতি নির্ধারণ নির্বাচন। ছোট-বড়, হালকা-পাতলা, মোটা-চিকন, চালু-অচল প্রায় সব মিডিয়ার বাংলাদেশী সাংবাদিক এসে জড়ো হয়েছেন। মোটা টাকার বিজ্ঞাপন বাগিয়ে অধিকাংশ সাংবাদিক চলে এসেছেন। ছুটে বেড়াচ্ছেন এদেশে। ছুটছেন যতটা সংবাদের পিছনে তার থেকেও বেশি ছুটে বেড়াচ্ছেন ঘুরে বেড়াতে আর সেলফি তুলে ফেসবুকে দিতে।
আমার দেশের সাংবাদিকগণ যতবেশী আগ্রহী আমেরিকার নির্বাচন কভার করতে যেতে, আর এক হাজারভাগের একভাগ আগ্রহী নন দেশের আদিবাসী উপর হামলা, খুন অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, দুর্নীতি নিয়ে খবর নিতে বা তার পরিবেশন করতে। একেবারে যে কেউ করছে না তা নয়, করছেন কেউ কেউ, যার সংখ্যা নগণ্য।
আমেরিকার নির্বাচন আমাদের দেশের মানুষের কাছে কি এতোটাই গ্রহণীয় যে ঘন্টায় ঘন্টায় তার পরিবেশন করতে হবে? আর অন্য ধর্মের মানুষকে পুড়িয়ে মারা, কন্যা শিশুকে ধর্ষণ (সে যে বয়সীর হোক) নারী নির্যাতন, দুর্নীতি, অন্যায় অবিচারের সংবাদ কি ঘন্টায় ঘন্টায় প্রচার যোগ্য নয়!
কী জানি বাপু, ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছিলাম সংবাদপত্র হলো সমাজের দর্পণ। আমাদের সমাজের দর্পণে অন্য সমাজের ছবি যতটা গুরুত্ব পেয়ে থাকে, আমাদের দেশের খবর ততোটা মূল্যায়িত হয় না। সব যেন বিজ্ঞাপনের খেলা। সব কিছুর আগে বিজ্ঞাপনের প্রচার। কর্পোরেটের হাতে বন্দি সংবাদপত্র আর আমজনতার কথা বলে না। সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় শুধু আজ কপোরেটের ছাপ আর প্রভাব। সংবাদ পরিবেশনায় চলে লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ। প্রান্তিক দুর্ভাগা জনপদের সংবাদ তো আর গ্ল্যামারাস, ক্লাসি না।
রাষ্ট্রযন্ত্রও চোখ রাখে কে, কী সংবাদ পরিবেশন করলো, তাদের পক্ষে গেলে ভাল, বিরুদ্ধে গেলে যাবে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে। তাই বুঝি আর সরকারকে কেউ চটাতে চায় না। মিডিয়া মুঘলরা সরকারের সাথে সদ্ভাব রেখে ব্যবসা চালায়, তাই সংবাদকর্মীরা সেইমতো সংবাদ পরিবেশন করে। নামেই উন্নয়নের ডংকা বাজে, দুর্নীতির জোরে ন্যায় দাবিয়ে, তার উপর পলি জমায় মিডিয়া।
আগে দেখতাম, দুর্নীতিবাজ নেতা, মন্ত্রী, আমলা, এমপি, সন্ত্রাসী, গুণ্ডা-বদমায়েশ সবাই সাংবাদিকদের সমীহ করতো, অন্যায়কারীরা লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতেই পছন্দ করতো। জনসম্মুখে তেমন আসতো না। কিন্তু মালিকপক্ষ যখন থেকে মিডিয়াকে নিজেদের রক্ষাকবচ আর টাকা কামানোর মাধ্যম করলো, তখন সংবাদকর্মীরা কেন পিছিয়ে থাকবে!
নীতির বদলে ভালবাসছে প্লট, গাড়ি-বাড়ি, ব্যাংক ব্যালান্স, বিদেশ ভ্রমণ। রাজনীতিকদের সাথে দহরম-মহরম, কে কত বেশি ক্ষমতার কাছে যেতে পারে, তার পাল্লা। আর যে দুর্নীতিবাজ নেতা, মন্ত্রী, আমলা, এমপি, সন্ত্রাসী, গুণ্ডা, বদমায়েশরা সাংবাদিকদের সমীহ করতো, আজ তারা সারমেয় তুল্য মনে করে সাংবাদিকদের।
পোষা গুণ্ডার মতো পোষা সাংবাদিক থাকে এখন। এখন সাংবাদিকরা ব্যস্ত থাকে সেইসব দুর্নীতিবাজদের পিছে পিছে ঘুরতে, একটু অনুগ্রহের আশায়, সেলফি তুলে প্রমাণ করে কার কতো ভাল সম্পর্ক। আজ সাংবাদিকরা তাই দেশ আর দেশের নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকার চেয়ে রাজনৈতিক নেতাদের পায়ের কাছে বসে অদৃশ্য লেজ নাড়াতেই ব্যস্ত। তাদের চোখের লোভের পর্দার ভাড়ে চোখে পড়ে না কোনো অন্যায়, কানে যায় না নির্যাতিতের আর্তনাদ।
মালিকপক্ষের নির্দেশে কিছু নিউজ করে ভাসা ভাসা, বেপথে যায় না কেউ। কেউ কেউ নিউজ করলেও ফলোআপের ধার ধারে না। মিডিয়া আর সাংবাদিকরা ভুলে গেছে তাদের পাইয়োরিটি। সেকারণেই আলোর মুখ দেখে না অধিকাংশ সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষের উপর অত্যাচার, কঠোর আইন ও তার প্রয়োগ হয় না নারীর ও কন্যাশিশু নিরাপত্তায়।
দেশে চলে দুই ধরনের শাসন, একই অপরাধের জন্য গরীব আর ধনী পায় দুই ধরনের বিচার। এই দেশে চলে দুই ধরনের শাসন। ক্ষমতাবান ও ধনীদের জন্য এক রকম, গরীব আর অসহায়দের জন্য আরেক শাসন। তার কারণ মিডিয়া মুঘলদের রাষ্ট্রচালকদের দুর্নীতির সহায়ক হয়ে ওঠা।
হোক শুভ বুদ্ধির উদয়। আমজনতার অন্ধকার জীবনের খবর উঠে আসুক জনসম্মুখে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ, আর তার প্রতিকার চেয়ে সংবাদকর্মীরা হয়ে উঠুক আরো সোচ্চার। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অন্ধকার জীবনে আলোর জোয়ার আসুক, আর তার কারণ হোক এই সাংবাদিকরাই।
: প্রবাসী সাংবাদিক