ইশরাত জাহান ঊর্মি: সারাদিন অফিস ক্লান্ত। এক মন্ত্রীর অপেক্ষায় বসে ছিলাম প্রায় পুরো দিন। তবু অফিস থেকে যখন বলল, কমলা ভাসিন এর প্রোগ্রাম, আমি নেচে উঠি। একা নই, সময় টিভির সাংবাদিক সতীর্থ বীথি হকও উত্তেজিত, দুপুরেই ফোন করে বলেছে, দিদি আমারে নিয়ে যেও কিন্তু। দুইজন যেতে যেতে একধরনের ইউনিটি ফিল করি, যেই ইউনিটির কথা সবসময় বলেন কমলা ভাসিন।

ছায়ানট ভবনে অনুষ্ঠান। ওয়ান বিলিয়ন ক্যাম্পেইন এ এসেছেন। দুএকজনের বক্তব্য, একটা দুটো গান, কবিতা আর নাচের পরে কমলা ভাসিন ওঠেন মঞ্চে। শুধু নারী নয়, অনেক পুরুষও মুগ্ধ হয়ে শোনেন তার বক্তব্য। নারীবাদী চিন্তাবিদ কমলা ভাসিন এর জন্ম ১৯৪৬ সালে, ভারতের রাজস্থানে।দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে কাজ করছেন নারীবাদ, শিক্ষা আরে গণমাধ্যম নিয়ে। সাউথ এশিয়ান ফেমিনিস্ট নেটওয়ার্ক নামে একটা নেটওয়ার্ক গড়তে কাজ করে চলেছেন এখনও। পড়াশোনা করেছেন জার্মানীর মুনসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। নারীবাদ একটা পাশ্চাত্য ধারনা এই ভাবনারে তিনি প্রত্যাখান করে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীবাদ বোঝার চেষ্টা করেছেন।
মঞ্চে কমলা ভাসিন বলেন, আজ দিওয়ালি উৎসব। কিন্তু আমার কাছে ধর্মীয় কোন উৎসব বড় নয় কারণ কোন ধর্মই আমারে শেকলমুক্ত করে না, বরং এই যে আমি উৎসবের দিন তোমাদের কাছে আসছি এইটাই আমারে সবথেকে আনন্দ দিচ্ছে।
অফিসের জন্য আমি একটা ইন্টারভিউ করেছিলাম তার ছায়ানটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ছবি ভালো না, লাইট ছিল না, কিন্তু চারটা প্রশ্ন করলাম, চারটার উত্তরই অমূল্য আমার কাছে। অফিসে এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনি, একটুও যেন পড়ে না যায় এমনভাবে আঁজলাভরে পান করি পুরো বক্তব্য।
জানতে চাই, এই যে আপনি বলেন, নারীবাদ কেবল নারীর বিষয় নয়, পৃথিবীতে বহু পুরুষ আছে যারা নারীবাদ ধারন করে আবার বহু নারী আছে যারা ধারন করে পুরুষতন্ত্র, একটু ইলাবোরেট করেন।বললেন,
: এইটা খুবই সত্যি। কত পুরুষ আছে যারা নারীর লড়াই এর পাশে দাঁড়ায়। নারীবাদের অর্থ কিন্তু পুরুষের বিরোধিতা না, পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা।যা কিছু অন্যায় ব্যবস্থা আমাদের লড়াইটা তার বিরুদ্ধে। যারা নারীবাদ বোঝে না বা না বোঝার ভান করে, তারা এইসব ছড়ায়।

আমার নারীবাদ মনে করে পুরুষতন্ত্রে পুরুষকেও সাফার করতে হয়। একজন পুরুষের কাঁদার অনুমতি নাই, বাচ্চা লালন-পালন করতে তারা পছন্দ করলেও সেটা তারা করতে পারবে না, সাংসারিক দায়দায়িত্ব পালনের জন্য শুধু পুরুষকেই উপার্জন করতে হবে, কেন? এইটা কেন ঘটে জানো? কারণ নারীকে ঠিকঠাক মানুষ মনে করা হয় না তাই। যদি নারী-পুরুষ সমান অধিকার পেতো তাহলে দায়িত্বটা ভাগাভাগি হতো।
দ্যাখো, এই সমাজে অনেক পুরুষও তার ইচ্ছা পূরণ করতে পারে না শুধুই সিস্টেমের কারণে। একজন পুরুষের হয়তো নাচ ভালো লাগে। কিন্তু এই শিল্পটাকে একজন পুরুষ নেশা বা পেশা হিসেবে নেবে তা ভালো চোখে দেখা হয় না এই অঞ্চলে।
আমি বলি, একটু আগে বললেন, নারী নিজেও নিজেকে অনেকসময় দুর্বল মনে করে, তাই অন্যরাও সেই সুযোগটা ভালোমতো নেয়।
কমলা ভাসিন বলেন, কতরকমের অদ্ভুত সব বিধিনিষেধ দিয়ে মেয়েদের ব্যারিয়ার দিয়ে রাখা হয় তোমরা তো জানোই। পিরিয়ডের সময় ধর্মগ্রন্থ ছোঁয়া যাবে না, কেন? এইসময় নাকি মেয়েরা অপবিত্র হয়ে যায়। আরে আমি তো বলি, পিরিওডের রক্ত হলো সবচেয়ে পিওর। এই রক্ত পুরুষদের নেই। কখনও আমরা প্রশ্ন কেন করি না যে পিরিওডের সময় কেন আমরা অপবিত্র? প্রশ্ন করি না কারণ আমরা তো চাঁদ থেকে আসিনি, এই সোসাইটিতেই আমাদের জন্ম। এই সমাজ আর ধর্মগ্রন্থ আমাদের ভয় করতে শেখায়, শেখায় যে আমরা অপবিত্র। এইজন্য আমাদের সবকিছুতে প্রশ্ন করাটা শিখতে হবে।
আমি বলি, পরিবর্তন কি কিছু দেখেন এখন? এই অঞ্চলে?

: অনেক অনেক। কতশত বছর ধরে এই অঞ্চলের নারীদের দাবিয়ে রাখা হয়েছে। কতভাবে নারীকে ছোট করা হয়েছে, অবমাননা, অপমান,অবমান করা হয়েছে। ধর্ষণ, খুন সব সব করা হয়েছে। সমাজ রাষ্ট্র ধর্ম আর ক্ষমতা এইসব বদমায়েশী করেছে। কিন্তু সময় বদলাচ্ছে। এই অঞ্চলের সত্যিকারের এনলাইটেন্ড মেয়েরা এখন স্বামী কনসেপ্টটাকেই বর্জন করছে। পুরুষকে সে সাথী বানাচ্ছে, স্বামী নয়। দেখো এই অঞ্চলটা অন্যরকম হয়ে যাবে। শুধু ইউনিটিটা রাখতে হবে, লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে।
ইন্টারভিউ শেষ হয়। আমার বন্ধুরা তাঁকে জড়িয়ে ধরে ছবি-টবি তোলে। ছবি তুলতে খুব পছন্দ করলেও আমি তাকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলি না। গভীর প্রেম কিছুটা দূরত্ব বোধহয় ডিজার্ভ করে। আমি বুঝতে পারি এই নারীর চিন্তার প্রেমে পড়ে গেছি আমি।