ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী: গত ৬ নভেম্বর গৃহকর্মী নির্যাতন মামলায় বেকসুর খালাস পেলো ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন ও তার স্ত্রী জেসমিন জাহান ওরফে নিত্য।
গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর মিরপুরের পল্লবী এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল এগারো বছরের শিশু গৃহকর্মী হ্যাপিকে। শিশুটির শরীরে মারাত্মক জখম এবং নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট ছিল। মুখমণ্ডল অস্বাভাবিক ফোলা আর চোখের নীচে কালশিটে। লাঠির আঘাতে শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্ষতবিক্ষত। উঠে দাঁড়ানোর, চোখ মেলার ক্ষমতা ছিল না হ্যাপির।
উদ্ধারের পর মেয়েটির জবানবন্দি অনুযায়ী জানা যায়, জাতীয় ক্রিকেট দলের পেস বোলার শাহাদাত হোসেনের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতো হ্যাপি। কাজেকর্মে দোষত্রুটি ধরা পড়লেই শাহাদাত এবং তার স্ত্রী নিত্য অমানবিক নির্যাতন চালাতো ছোট্ট মেয়েটির ওপর। দরিদ্র বাবা-মায়ের দুর্ভাগা সন্তান হ্যাপি। অথচ শাহাদাত আর নিত্য তখন দশ মাস বয়সী এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের বাবা-মা!
হ্যাপির সর্বাঙ্গ সেই বর্বর নির্যাতনের সাক্ষ্য বয়ে বেড়াচ্ছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যমে হ্যাপির যে ভয়াবহ ছবি আমরা দেখেছি সে সময়, তা যেকোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে ভুলে যাওয়া অসম্ভব। ঢাকা মেডিকেলের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিসে চিকিৎসাধীন ছিল মেয়েটি। চিকিৎসকেরাও তার শরীরে নির্যাতনের চিহ্নের কথা জানিয়েছিলেন।
ঘটনা জানাজানির পর মামলা হলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় এই দম্পতি। অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হয় শাহাদাতের স্ত্রী। আত্মসমর্পণ করে শাহাদাত। শাহাদাতের অনুপস্থিতির জন্য ক্রিকেটপ্রেমীদের কাউকে আজ পর্যন্ত আহাজারি করতে শুনিনি। বরং এই অপকর্মের উপযুক্ত শাস্তি যেন পায়, কোনো ছাড় যেন না পায় সেটাই ছিল একমাত্র চাওয়া।
গত এপ্রিল মাসে শাহাদাত জাতির কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল। ভুল শুধরানোর এবং জাতীয় দলে ফেরার সুযোগ পেতে চেয়েছিল।
কিছুদিন আগে বিসিবি থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটে শাহাদাতের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা তুলে নেয়া হয়।
এর মাঝেই আদালতের রায়ে বেকসুর খালাস এই দম্পতি! সেই হ্যাপিই নাকি তার প্রতি নির্যাতনের কথা আদালতে অস্বীকার করেছে!
আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। শাহাদাত ও তার স্ত্রীর অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা বেকসুর খালাস পেয়ে গেল এই মামলায়। এই মামলাটির রায় কী হয় তা জানার জন্য উদ্বেগ ছিল সবার মধ্যে। বিজ্ঞ বিচারক রায় দিয়েছেন। আমাদের কিছু বলার নেই।

শুধু কয়েকটি প্রশ্ন রাখতে চাই, যদি কারো কাছে উত্তর মেলে!
১. গত ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, শাহাদাত হোসেন এবং জেসমিন জাহান নিত্যর বাড়ি থেকেই হারিয়েছিল হ্যাপি। থানায় জানানোও হয়েছিল তা। ওইদিন রাতেই মেয়েটিকে গুরুতর জখম অবস্থায় উদ্ধার করেন এক সাংবাদিক। শাহাদাত -নিত্য দম্পতি নিরপরাধ। কিন্তু মেয়েটিকে কেউ তো নির্যাতন করেছিল? তাহলে কে বা কারা তাকে আঘাত করেছিল সারা শরীরে?
২. হ্যাপির চোখের নীচের কালশিটেটা কী মিথ্যে ছিল?
৩. শাহাদাত হোসেন “বেকসুর”। জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটার, একজন “পাবলিক ফিগার”। তবে প্রথমেই কেন আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে বিষয়টি মোকাবেলা না করে পলাতক থাকতে হলো তাকে?
৪. প্রথমে শাহাদাত ও তার স্ত্রীর নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা দিলেও হঠাৎ হ্যাপির জবানবন্দী পাল্টে গেল কেন?
৬. হ্যাপির কাছেই জানতে চাইছি, তাহলে কে বা কারা তোমাকে নির্যাতন করেছিল মাগো?
৫. যে চিকিৎসকরা হ্যাপির চিকিৎসা করেছিল, তাঁরা কী বলছেন?
৬. গত এপ্রিল মাসে শাহাদাত হোসেন তার “ভুল” স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে গেল কেন? কী সেই “ভুল”?
৭. একজন ক্রিকেটারের জীবন থেকে এক বছরের বেশি সময় ঝরে পরা মানে তার খেলোয়াড় জীবনের যথেষ্ট ক্ষতি হওয়া। শিশু নির্যাতনের অভিযোগে মামলা। তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনেও বোধকরি এর প্রভাব কম না। তাহলে বিনা অপরাধে এভাবে তার ক্যারিয়ার, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনের সম্মান ক্ষুণ্ণ হওয়ার জন্য শাহাদাত হোসেন কী মানহানির মামলা করবে? রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ বা বিচার চাইবে?
“বেকসুর ” হলে তো তাই চাওয়া উচিৎ!
৮. জাতীয় দলে একজন বিবেকহীন “ভালো খেলোয়াড়”, নাকি রাষ্ট্রে একজন সুসভ্য নাগরিক, একজন “ভালো মানুষ” কোনটি বেশি জরুরী?
বেশ কিছুদিন ধরে সারাদেশব্যাপী শিশু ও নারী নির্যাতনের তাণ্ডবলীলা চরম আকার ধারণ করেছে যা গভীরভাবে উদ্বেগজনক।
এ পরিস্থিতিতে সকলেই চেয়ে আছে অন্তত একটি দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক।
শাহাদাত হোসেন আর জেসমিন জাহান নিত্য বেকসুর খালাস।
আমাদের আর কিছু বলার নেই।