মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, উত্তর আপনাকে দিতেই হবে

রুমা মোদক (কানাডা থেকে): দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (নাসিরনগরের হিন্দু, গোবিন্দগঞ্জের আদিবাসী) কয়েক হাজার ‘ ঊন-মানুষ’ এই মুহূর্তে না খেয়ে, শীত-বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নিচে আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের কথা তো এখন সবারই জানা।

এই ন-মানুষগুলো এখন খোলা আকাশের নিচে আছে, কারণ তাদের থাকার জায়গা দখলের বিশাল ষড়যন্ত্র আপাতত সাকসেসফুল। শ্যামল হেমব্রম নামের একজন মারা গেছেন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে নিজের জায়গা-জমি রক্ষা করতে গিয়ে।

santalsসাঁওতাল সম্প্রদায়ের প্রায় তিন হাজার লোকজনের ঘরে খাবারও নেই।

খবরে প্রকাশ, গোবিন্দগঞ্জে সাহেবগঞ্জ বাগদা-ফার্ম এলাকায় রোববার সকালে আবারো সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন মিল কর্তৃপক্ষ ইক্ষু কাটার নামে আদিবাসীদের বাড়ি-ঘরে, বিদ্যালয়ে আগুন লাগিয়ে উচ্ছেদ করতে গেলে এই সংঘর্ষ বাঁধে। পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটের আঘাতে অনেক আদিবাসী আহত হয়েছে। আদিবাসী সাঁওতাল পল্লীতে পুলিশের গুলি, একজন নিহত। তিনজন গুরুতর আহত। একজনের মাথার ঘিলু বের হয়ে গেছে।

তাদের সর্বস্ব লুট করে ঘরের টিন এমনভাবে কুপিয়ে নষ্ট করা হয়েছে যে, ঐগুলি দিয়ে আর ঘর বানানো সম্ভব নয়। বাচ্চাদের বই-পত্র সব নষ্ট, ওদের পড়াশোনা পরীক্ষা সব বন্ধ। তারা এখন আতংকে কোনরকমে জীবনটা নিয়ে ঘুরছে। আমার পরিবার ১৯৭১ সালে এবং পরে এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। আমি জানি এই অসহায়ত্বের যন্ত্রণা।

attack-4মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমায় বলেন, কেন এই অপরাধগুলির বিচার হয় না? কেন দিনের পর দিন আপনাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে এই সংখ্যালঘুরা থাকতে পারছে না, আক্রান্ত হচ্ছে বার বার? পারবেন আপনি রামু, পাবনা, নোয়াখালী, নাসিরনগরসহ দেশের আক্রান্ত বৌদ্ধ, হিন্দু এবং আদিবাসীদের মনে শান্তি ফিরিয়ে দিতে? পারবেন তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে। আর কোনদিন সম্ভব হবে তা? এই যে ক্ষত, কোন মলম দিয়ে সারবেন আপনি? এক বান্ডিল ঢেউটিন আর নগদ কয়েক হাজার টাকা দিয়ে?

যে ভক্তিভরে মাটির প্রতিমাকেই ভগবান ধ্যান করে এই সম্প্রদায়ের মানুষ, সেই প্রতিমাই যখন মাটিতে ভূলুণ্ঠিত হয়, তখন কী সেখানে আর কোনো সান্ত্বনা কাজ করে? সংখ্যালঘুদের অনুভূতির কথা বাদই দিলাম, হাত-পা বিশিষ্ট এই প্রাণীরা এখন কী ভাবছে, বলতে পারেন?

বার বার ফটোশপ করে হিন্দুদের/বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে। এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় একইভাবে ফটোশপ করে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের চেষ্টা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনি আমায় বলেন, সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচারের বিচার কেন আজ পর্যন্ত আপনার আমলে হলো না? যদি বলি, বার বার এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির জন্য আপনার নীরবতা এবং বিচারহীনতা দায়ী, কী জবাব দেবেন?

attack-2হাজারের উপর মন্দির ভাঙা হয়েছে এই পর্যন্ত। এইগুলি কি ধর্মের অবমাননা নয়? নাকি সংখ্যালঘুদের কোনো ধর্মীয় অনুভূতি নেই? সিরাজগঞ্জে শুনলাম পারিবারিক ও বারোয়ারি মন্দিরের মূর্তি বিসর্জন দিতে বাধ্য করছে উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা। বাহ, কী অপূর্ব কৌশল! মূর্তিই যদি না থাকে তাহলে ভাঙ্গবে আর কী? নিরাপত্তা দেয়ার কষ্টও আর রইলো না। আপনাদের উদ্ভাবনী শক্তির সত্যিই কোন তুলনা নেই। একটা কাজ করেন না আপনারা সিরাজগঞ্জ থেকে সব হিন্দুদেরই বের করে দেন, তাহলে আরো ভালো হয়। আস্তে আস্তে আপনাদের এই ফর্মুলা ছড়িয়ে পড়বে দেশব্যাপি। এক সময় মালাউন শূন্য হয়ে যাবে দেশ। থাকবে না আর কোন ঝুট ঝামেলা।

আর কতো চলবে এই অত্যাচার আর আপনাদের না দেখার ভান করা?

যদি বিচার না করেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের “মালাউন” ঘোষণা করুন। অসহায় মানুষগুলি বহির্বিশ্বে আসবার সুযোগ পাবে আর সংখ্যাগুরুরা আনন্দে বাঁচতে পারবেন ‘নিজ দেশে’।

প্রধানমন্ত্রী, আপনি মমতাময়ী। আপনি মিরাজের ঘর করে দিচ্ছেন, ঘটনার পরে এতোদিন পার হয়ে গেলো, নাসিরনগরের অসহায় মানুষগুলিকে ঘর বানিয়ে দেবার কথা তো বললেন না! ব্যাপারটা তো আরো বেশী মানবিক ছিল, তাই না? ওই লোকগুলির কথা কিছু ভাবলেন? খুব জানতে ইচ্ছা করে।

আর অসহায় রসরাজ! মিথ্যা অপরাধে পিটিয়ে তাকে আধমরা করা হয়েছে। সাজানো নাটকের হোতা ফারুক কেন এখনো আইনের বাইরে? বলতে পারেন? কোন শক্তিতে সে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে?

রসরাজকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতে কোনো কথা বলতে দেয়া হয়নি, আইজীবীরা তার পক্ষে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, তাদের থামিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা কী জানতে পারি কেন রসরাজকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতে বিচারক আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেননি?

অথচ আপনার ‘গালিবাজ’ মন্ত্রী ‘ছায়েদুল হক’সহ শত শত এলাকাবাসী বলেছেন, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার রসরাজ এবং ফটোশপ করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা তার নেই !!

attack-3খুনের আসামীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশে কেমন করে আইন সংখ্যালঘুর জন্য বদলে যায়? কেমন করে আপনার সরকারি কর্মকর্তারা ধর্মীয় সংগঠনের অনুষ্ঠানে উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখেন? অনেক প্রশ্ন আমার, কিন্তু জবাব চাই।

বিনা অপরাধে লোকটার সব গেলো, তারপরও সে কেন জেলে? কেন তার হাতে-পায়ে শিকল আর হিন্দুধর্মকে কটাক্ষ করা পাবনার সেই সংখ্যাগুরু স্কুল শিক্ষক মুক্ত? রসরাজের তো সবই গেছে। এখন তার পিতৃপ্রদত্ত জানটা বাঁচানোর জন্যে, তার পরিবারের এবং তার নিরাপত্তার কী দায়িত্ব আপনি নিয়েছেন!

দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার থেকেই যায়, তদুপরি এটি ঘটিয়েছে আপনার দলের লোকজন।

রসরাজকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে, অথচ একই অপরাধে পাবনার স্কুল শিক্ষক জহিরুলকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আইন কেনো একই দেশের নাগরিকের জন্য দুই রকম হবে ?

agunজাতীয় সংসদে আপনি যে শপথ নিয়েছিলেন,তা নিশ্চয় ভুলে যাননি প্রধানমন্ত্রী!  কানামাছি খেলা আর কতোদিন? আর কতোদিন হিন্দুদের ভোট ব্যাংক বানানোর খেলা? তবে কী বুঝবো যে, এখন যেহেতু হিন্দু এবং সংখ্যালঘুরা আর ভোট ব্যাংক না, তাই এই উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা চলছে? এবং আপনার নীরবতা একে কেবলই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আরও আরও হামলার?

এই ভয়ঙ্কর অন্যায় পক্ষপাতিত্ব আর কতকাল চলবে প্রধানমন্ত্রী? বলবেন একটু? প্রধানমন্ত্রী, প্রশাসন — সবার কাছে জবাব চাই আমি।

আচ্ছা এখন নাসিরনগর ঘটনার মূলহোতাদের কী হবে? জনপদের মানুষগুলোর ক্ষত, ক্ষয়ক্ষতি কোন ‘মলম’ দিয়ে সারানো হবে? আমি টাকা বা ঢেউটিন সহায়তার কথা বলছি না। দুইদিন পর পর এই যে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে তথাকথিত ধর্মের ফটোশপের অভিযোগ তুলে মারধর, হয়রানি, লুটপাট, জমি-জিরেত উচ্ছেদ পর্ব পরিবেশিত হয়, সেই নাটকের পরিসমাপ্তি কী হওয়া দরকার না? এভাবে কতদিন চলবে?

শেয়ার করুন: