সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: কাশফুল ফুটলে চরের এবড়ো-থেবড়ো বালু মাটি ঢাকা উপরের আকাশ অমাবশ্যায়ও জ্যোৎস্নার আলোয় ঝকঝক করে। প্রতিবছর শরতের এক বিকেলে আমরা দলবেঁধে নৌকা ভাড়া করে কোনো চরে চলে যাই। সন্ধার অন্ধকারে শাদা শাদা কাশফুলের আভা জ্যোৎস্নার আলোর মতো বিচ্ছুরিত হয়ে আকাশে ঠেকে যায়।

স্বচ্ছ আকাশে রাশি রাশি তারার আলোর সাথে কাশফুলের আলোর মিতালী দেখতে দেখতে আমাদের নৌকা ফেরে। এবার কাশফুল দেখার অপেক্ষায় থেকে থেকে আমার শরৎ কেটে গেছে, টেরই পাইনি। ফুল কিন্তু ঠিকই ফুটে ঝরে গেছে আমার অপেক্ষা না করে। সেদিন যখন নদী পাড়ে দাঁড়িয়ে কলাবাগানগুলোর ফাঁক গলে কাশবনের দিকে চোখ গেলো ঝরতে থাকা, মরতে থাকা কাশবন আমার অনুভুতিতে একটা চিমটি কেটে জাগিয়ে দিলো আমাকে। মনে হতে থাকলো কতটা দীর্ঘ সময় আমার বেঘোরে কেটে গেছে জীবন থেকে!
সত্যিই একটা দীর্ঘ বোবা সময় কেটে গেছে আমার। নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি ভ্রান্ত সময়ের অতলে। কত কিছু অকল্যাণ ঘটে যাচ্ছে চোখের সামনে, আমি প্রতিবাদ করতে চাইছি, কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর বসে গেছে, আমি লিখতে চাইছি, হাত নড়ছে না। কিছুই যেন করতে পারছিলাম না। কিছুই গুছিয়ে উঠতেও পারছিলাম না।
ভাবনাগুলো সারাদিন হেঁটে বেড়ায় যে গলিতে গলিতে, দিনশেষে সে গলিই কানাগলি হয়ে ওঠে। আমি আবার ফিরে আসি একই বৃত্তে। ভুলভুলাইয়া হয়ে পথ খুঁজি বৃত্তের বাইরে বেরুনোর। কিন্তু পারি না বের হতে। শুধু চক্করে চক্কর খাই। শুধু দিন হয়, রাত হয়, সময় চলে যায়। আমি জাগি না। তবে আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার জেগে ওঠা খুব দরকার, আমার কাজ করা খুব দরকার। যে কাজ করতে আমি খুব ভালবাসি!
‘যে নাকি অন্যের দুঃখে দুঃখি হয় তার কখনও সুখি হওয়া হয় না।’ আমি তাই সুখি হতে চাই না কোনদিন। তবে এই দুঃখি হতে গিয়ে যদি বোধহীনতার কোমায় আক্রান্ত হয়ে সময় কাটিয়ে ফেলি তবে আর কষ্ট পাওয়াও হবে না। দুঃখি হওয়াও হবে না।এই দুঃখি হওয়ার বাসনা থেকে আমি জেগে উঠতে চাই। এই দুঃখি হওয়া আমাকে সুখি করে তোলে।
ধার করা দুঃখে দুখি হই বলে সজ্জনরা আমার নিন্দা করে। আমাকে দুঃখ বিলাসী বলে, অন্যের হাত হাত রাখি বলে আমার কোন উদ্দেশ্য খোঁজে তারা, আমার তাতে থেমে যাওয়া তো চলে না। কারো কাঁধের ভার আমাকে ভারী করে, কারো মাথায় পড়া বৃষ্টির জল আমাকেও ভেজায় বলে আমি দুঃখি হয়ে সুখি হই।
হ্যাঁ, তারা হয়তো ঠিকই বলে। আমিও স্বার্থপর।আমি কারো প্রত্যাশিত বিনিময় দিতে পারি না। আমিও লোভী। যন্ত্রণাদগ্ধ কেউ আমার কাছে আশা নিয়ে এসে দাঁড়ালে আমি লোভাতুর হয়ে তার মুখের দিকে তাকাই। গড়িয়ে পড়া অশ্রু মাটিতে পড়তে না দিয়ে আঁচল পেতে দেই তার চোখের নিচে। হাত ধরে টেনে বুকে জড়িয়ে নেই। তাতে তার কষ্ট কতটা কমে জানিনা, তবে আমি শান্তি পাই। আমার এই শান্তি পাওয়ার লোভে আমি লোভাতুর হয়ে তার জন্য ছুটি। তার যন্ত্রণা দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। এই চেষ্টায় কখনও কখনও নিজের খর্বাকৃতি সাধ্যে যখন টান পড়ে তখন পরিচিত, হিতাকাঙ্খী, সামর্থবান, মহানুভুব কাউকে এগিয়ে আসার আকুলতা ব্যক্ত করি।
শেষবার সমস্যাটা তৈরী হলো সেখান থেকে। মানুষের মতো দেখতে হলেও সকলে যে মানুষ নন, মহানুভবের খোলস পরা থাকলেও সকলে যে অতি মানব নন, হিতাকাঙ্খীর পদকপ্রাপ্ত হলেও যে সবার ভিতরে একটা বিহীত ব্যবস্থার সমাধান করার বাসনা থাকে এটা আমার একেবারেই জানা ছিল না। স্বেচ্ছায় খুঁজে খুঁজে বিপদগ্রস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানো মানুষরুপি কোন অতিমানব যখন তার বিনিময় দাবী করে বসে, যা আমার একজনমের প্রাণের দামের চেয়েও ভারী হয়ে উঠে। সেদিন আমার গালে সজোরে একটা চপেটাঘাত পড়ে। পিছাতে পিছাতে আমার পিঠ কখন দেয়ালে ঠেকে যায় টের পাইনি। স্তব্ধতায় কেটে যায় দীর্ঘ সময়।
এই সময়ে শরৎ চলে গেছে তার কাশফুল নিয়ে। হেমন্তও উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। সবুজের লাবন্যে শীতের ছোঁয়া লেগে বিবর্ণ হতে শুরু করেছে। আর আমার অবহেলার কপালে উড়ছে উশকো-খুশকো কয়েকটা শাদা চুল। আমার সকল অনুভুতি সেই ঋণের ভারে ভারী হয়ে গেছে। কিন্তু আমি চলতে চাই। আমি সকল অব্যক্ততাকে খুন করে বেঁচে উঠতে চাই।
লেখক ও সাংবাদিক