জাহাঙ্গীরনগরে র‍্যাগিং এবং ব্যক্তিগত অভিমত

ফাহমি ইলা: বেশ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে লিখতে বসেছি। সপ্তাহখানেক আগে থেকে শুরু হয়েছে একটি আলোচনা- বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিংআমি ছয়বছর কাটিয়েছি যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নাম- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক র‍্যাগিং নিয়েই তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

বেশ কয়েকজন শিক্ষক, অগ্রজ, সতীর্থ, অনুজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের অনেকেও অনুরোধ করেছেন এ বিষয়টি নিয়ে আমার মতামত জানাতে। আমি চুপ ছিলাম। কারণ, যখন একটি ইস্যু সামনে আসে তখন দর্শক বা পাঠক যাই বলি না কেনো এই ‘আমরা’ বা ‘আমাদের সত্ত্বা’টি স্পষ্ট বাইনারী অপজিশানের মাধ্যমে দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়- পক্ষ-বিপক্ষ, হ্যাঁ-না ধরনের। অথচ একটা ইস্যু যখন তৈরি হয় তখন তার উত্তর শুধুই কি এ ধরনের বাইনারী পদ্ধতিতে দেয়া সম্ভব? এর পেছনে প্রেক্ষাপট যাচাই করবার ব্যাপার আছে, স্থানিক বা আঞ্চলিক কিছু বিষয় বোঝার ব্যাপার আছে।

ila-fahmi
ফাহমি ইলা

আমি একটু বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করছি বিভিন্ন বাস্তব ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার মধ্য দিয়ে যেখানে আবেগ থাকবে, যুক্তিও থাকবেতবে আমাকে যদি বলা হয়- আপনি কি র‍্যাগের পক্ষে না বিপক্ষে? তাহলে আমি একবাক্যে উত্তর (এবং একইসাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেব) দেবো- আমি অবশ্যই র‍্যাগিয়ের বিপক্ষে। কিন্তু একইসাথে আমাকে ক্লিয়ার করতে হবে র‍্যাগ বলতে আপনি ঠিক কি বোঝাবেন এবং এর সঙ্গায়নটা কি?

আমি ৩৭তম আবর্তনের শিক্ষার্থী ছিলাম। আমাদের ক্লাস শুরু হয় ২০০৮ সালের ১৬ মার্চ। মনে আছে- তখনও শীতের আমেজ কিছুটা ছিলো। জাবি (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্ষিপ্ত রূপ) গিয়েছিলাম ভোর সকালে। প্রথম ক্লাসের অভিজ্ঞতা এখনো চোখে ভাসে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাস, এটা ভেবেই সারাদিন একধরণের শিহরণের মাঝে কেটে গিয়েছিলো।

তখন ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচের পরীক্ষা চলছিলো। ফলে তারা আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন সপ্তাহখানেক বা তার কিছু পরে। আসার আগে আমাদের জানানো হয় যে আমরা যেনো সবাই আজ নির্দিষ্ট সময়টুকু ক্লাসে থাকি, সিনিয়ররা পরিচিত হতে আসবেন। তারা আসার পর সবার নাম, জন্মস্থান, কে কোথা থেকে এসেছি এসব জানার পর নিজেদের পরিচয় দিয়ে ক্যাম্পাস সম্পর্কে ডিপার্টমেন্ট সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করলেন।

আমি মাঝামাঝি বেঞ্চিতে বসে পাশের জনকে কি যেনো ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলাম, সাথে সাথে এক আপু ধমক দিয়ে বললেন-‘এই, আমরা কথা বলছি দেখতে পাচ্ছো না? এত কষ্ট করে সব বাদ দিয়ে তোমাদের সাথে পরিচিত হতে এসেছি কি তোমাদের ফিসফিসানি দেখার জন্য?’ আমি ‘সরি’ বলে চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার এটাকে একবারের জন্যও র‍্যাগিং মনে হয়নি। তারা কিঞ্চিত দেরী করে আসার কারনেই ততদিনে র‍্যাগ সম্পর্কে কিছুটা জানা হয়ে গিয়েছিলো।

ju-7আমার মনে আছে- তারা যখন ক্লাসে ঢুকে তখন প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। তারা কোনরকম অগ্নিমূর্তি ধারন করে এসেছিলেন ব্যাপারটা সেরকম ছিলো না বরং আমার আগে থেকে র‍্যাগিং সম্পর্কে জন্ম নেয়া ধারণা ভীতির জন্য দায়ী ছিলো। কিন্তু বের হবার সময় তারা আমাদের সবার মুখে হাসি উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর কোন আপুর রুমে গিয়ে দেখা করবো, পড়াশোনার ব্যাপারে কার কাছ থেকে হেল্প নিব, কাকে বেশি ভালো লেগেছে এসবের লিস্টি করতে বসি আমরা। পরিচিত হবার পর ডিপার্টমেন্টে করিডোরে দেখা হলে চিনতে পারতাম কারা কোন ব্যাচ, কথা হত মিষ্টি হেসে। একেই বোধহয় ব্যাচকল বলে। শুধু ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচই যে পরিচিত হতে এসেছিলেন তাই নয়, অন্তত ৮/১০ টি রাজনৈতিক সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনও পরিচিত হতে এবং একিসাথে আমাদের কাছে নিজেদের পরিচয় করিয়ে দিতে এসেছিলেন।

অথচ আমার মনে সেদিন প্রশ্ন জেগেছিলো- আপু-ভাইয়ারা সিনিয়র হয়ে এত কষ্ট করে আমাদের সাথে দেখা করতে আসলেন কেনো? আমাদেরইতো দলবেধে তাদের কাছে যাওয়া উচিত ছিলো। কারণ, আগামী ছয়টা বছর এদের সাথে কাটাবো। এদের সাথে পরিচিত যদি না হই তাহলে আমার বিপদে আপদে পাশে থাকবে কারা? যাই হোক, আমার বিপদে আপদে সিনিয়র বা জুনিয়র কম মানুষকে পাশে পাইনি ছ’টি বছর! এখন আমাকে যদি প্রশ্ন করেন- আপনি এই ব্যাচকলের পক্ষে কি না। তাহলে আমি বলব- পরিচিত হবার জন্য ব্যাচকল যদি একটা কালচার হিসেবে দাঁড়ায় তাহলে আমি এর পক্ষে অবশ্যই। কারণ সেদিন আমি শুধু আপু ভাইয়াদের সাথেই পরিচিত হয়নি আমার সহপাঠিদের সাথেও পরিচিত হয়েছিলাম। কার বাড়ি কোথায়, কে কোন জেলা থেকে এসেছে, কে কোন স্কুল কলেজে পড়েছে, কার রেজাল্ট কি, কে কোন বিভাগ থেকে এসেছে, কে প্রথমবার কে দ্বিতীয়বারে ভর্তি হয়েছে সবকিছু জেনেছিলাম।

আমি হলে উঠি খুব সম্ভবত বিশ পঁচিশদিনের মাথায়। আমার জন্য বরাদ্দকৃত হলে সিট সংকট থাকায় আমি উঠি জাহানারা ইমাম হলের টিভিরুমে। সেখানে প্রায় মাসখানেক থাকার পর আমি আমার হলে সিট পাই, সিট বলতে কমনরুমে সিট পাই। হলে ওঠার আগেই আপনারা যাকে হলসিটিং বলবেন সেটা হয়ে গিয়েছিলো।

ju-6 আমার এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা নেই তবে এই লেখার প্রয়োজনে সে সময়ে যারা ছিলেন তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে তারা যা জানিয়েছেন- ‘রাতে সবাইকে আপুরা থাকতে বলেছিলো খাওয়াদাওয়া সকলকিছুর পাট চুকিয়ে। দশ পনেরজন এসে সবার সাথে পরিচিত হয়ে হলের নিয়ম শৃংখলা, অলিখিত কিছু নিয়ম যেমন সবচেয়ে সিনিয়ররা যে ব্লকে থাকেন সেখানে যেনো আমরা না ঢুকি, সিনিয়রদের পরীক্ষা চলছিলো তাই যেনো জোরে চেঁচামেচি না করি, টিভি যেনো একটু আস্তে দেখি সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। সেইসাথে কোনধরনের ঝামেলা হলে যেনো আপুদের সাথে যোগাযোগ করি, কাকে হলে বেশি পাওয়া যাবে, কোন রুমে পাওয়া যাবে, হঠাৎ জরুরী মোবাইলের কার্ড লাগলে কার রুমে পাওয়া যেতে পারে এসবকিছু জানিয়ে দিয়ে গেলেন। এগুলো কোন লিখিত নিয়ম ছিলো না কিন্তু জরুরী প্রয়োজনে আমাদেরই আবশ্যিক সাহায্যের প্রয়োজন ছিলো বটে।

সবকিছু লিখিত নিয়মাবলে চলে না। যদি চলতোই তাহলে পারিবারিকভাবে একজন মা-বাবা, ভাইবোন কিভাবে আচরণ করবে, কিভাবে কতটুকু পরিমানে ভালোবাসবে, কতটুকু অভিমান করবে, কতটুকু রাগ দেখাতে পারবে তাও লিখিত আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হত। পরিবারের ধারণাকে আরেকটু বিস্তৃত পরিসরে ফেলে আমি জাবিকে একটা পরিবার হিসেবেই দেখেছি কিংবা বলা যায় একটি স্বতন্ত্র ‘গৃহস্থালি’ হিসেবেই দেখেছি। কেননা যখন একটা সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যাব সেখানে আমার একধরণের আবাস (যেহেতু সেটা আবাসিক) গড়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। সেখানে আমার একধরণের গৃহস্থালি তৈরী হবে, আমি সেখানে খাবো ঘুমাবো বছর পার করব আর সেটাকে একধরণের পারিবারিক আবহ বলতে আপনারা নারাজ হবেন তা কিভাবে হয়? শুধু আমি না, আমার মত এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা আমার সাথে এ ব্যাপারে একমত হবেন। যাই হোক, এখন আমাকে যদি প্রশ্ন করেন আমি এই টাইপের হলসিটিংয়ের পক্ষে না বিপক্ষে? তাহলে আমি নিঃসংকোচে বলব- আমি সেই হলসিটিং মিস করেছিলাম বলে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।

এরপরে আবার আপুরা এসেছিলেন। একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে সত্যিকার র‍্যাগ দিতে। কারণ ছিলাম- আমি এবং কিছু সহপাঠী। আমাদের অপরাধ ছিলো- আমরা সিনিয়রদের ব্লকে ক্লাসজনিত জরুরী প্রয়োজনে গোসল করতে গিয়েছিলাম এবং এক আপুর বালতি সরিয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে গিয়েছিলাম।

আমি কি অপরাধ করেছিলাম? হ্যা, করেছিলাম। আপুর পরীক্ষা চলছিলো ফাইনাল। আর আমার জন্য সেদিন তার পাঁচমিনিট দেরী হয়েছিলো। আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেছিলাম- ‘আমার ক্লাস ছিলো, আমি বুঝতে পারিনি।‘ এক আপু চিৎকার করে বলেছিলেন-‘এই তোর ক্লাস বড় নাকি আপুর পরীক্ষা?’ আমি মাথা নিচু করেছিলাম। লজ্জা পেয়েছিলাম, অপরাধবোধ কাজ করেছিলো ঠিকই, আত্মসম্মান খোয়াইনি।

হলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে আপুরা কিছুক্ষণের মাথায় হাসিখুশি হয়ে আড্ডার ছলে আমাদের সবাইকে নিয়ে বসলেন কার কি গুণ আছে বের করার জন্যআমাকে জিজ্ঞেস করা হলে আমি বললাম- আমি গান জানি। তারা বললেন- গাওতো একটা গান। র‍্যাগ হচ্ছে কি হচ্ছে না ভাবার টাইম পাইনি সত্যি ওই মুহুর্তে। একটু ভয়ে ভয়েই গান গাইলাম। আমার মনে আছে, গান শেষ হবার পর সেকেন্ড পাঁচেক তারা চুপ করে থেকে বললেন- ‘তুইতো ভালো গান জানিস, এখানে অনেক সংগঠন আছে, জয়েন কর। শুধু পড়াশোনা করে প্রতিভা নষ্ট করিস না।‘

সেখান থেকে এবং ক্লাসে সংগঠনগুলোর পরিচিত হবার পরে উৎসাহিত হয়ে আমি থিয়েটারে যোগ দেই মাসখানেকের মাথায়। যদিও আগে থেকেই চিন্তা ছিলো খেলাধুলা কিংবা থিয়েটার কিংবা দুটোই চালিয়ে যাব সমানভাবে। সেদিনের ঘটনা পরে যতবার মনে করেছি ততবার আমার কাছে একবারের জন্যও র‍্যাগ মনে হয়নি, যদিও ভীতি কাজ করেছিলো ‘বড় আপু’ সম্পর্কে এবং আগে থেকে র‍্যাগিং সম্পর্কে ধারণা জন্ম নেবার জন্য। কিন্তু তারা আমাকে কিছু করতে বাধ্য করেন নি এবং তাদের আচরণও ভীতিজনক ছিলো না, এমনকি কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাকে জোর করেননি। বরং আমি আগে থেকেই র‍্যাগিংয়ের যে ধারণা নিয়ে বসেছিলাম ভীতিটা সেখান থেকেই এসেছে বলে আমার যুক্তিযুক্ত মন বলেছে।

আমার ক্যাম্পাস জীবনের প্রথম সময়টুকুর প্রভাব পুরো ছয়বছর জুড়ে ছিলোসিনিয়রদের সাথে সম্পর্ক এমন পর্যায়ে গিয়েছিলো যে শীলা আপু(ছদ্মনাম) আমার থেকে ছয় ব্যাচ বড়, ঢাকা থেকে ফিরবার পথে প্রায়ই ফোন দিয়ে বলতেন- ‘আমার জন্য ভাত রাখিস, এসে পাবো না।‘ আমি আপুর জন্য ক্যান্টিন থেকে ভাত এনে রাখতাম, সাথে আমারটাও, আপু এলে একসাথে খাবো বলে। বেশ কিছুদিন পর আপুর খেয়াল হলো- খাবার রাখছি ঠিকই, কিন্তু টাকার কথা তুলি না কেনো।

সেদিন তিনি লজ্জিত হয়েছিলেন খুব, পুরো টাকাটা হিসেব করে হাতে দিয়েছিলেন, সেইসাথে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন-‘অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয় না, ছোট বোনটাকে দেখি না, আজ তোকে নিজ হাতে খাইয়ে দেই?’ এই সেই আপু যিনি আমার জন্য পাঁচমিনিট দেরীতে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন এবং র‍্যাগ দিতে দলবেঁধে এসেছিলেন। যা হোক, সেদিন সে ঘটনা আমার কাছে র‍্যাগ ছিলো না, বরং হাসিঠাট্টা গল্পে কেটেছিলো আমাদের সময়টা।

এমন ঘটনা বললে শ’খানেক ঘটনা বলা যাবে। এখন এটুকু শুনে আপনারা আমাকে বলবেন আমি র‍্যাগের পক্ষে? না, আমি র‍্যাগের পক্ষে নই। কিন্তু আপুর বালতি সরিয়ে গোসল করেছিলাম আর আমার জন্য আপুর পরীক্ষা হলে যে পাঁচমিনিট দেরী হয়েছিলো তার জন্য ধমক বলেন বকা বলেন ফাঁপর বলেন আমাকে যা শুনতে হয়েছিলো সেটাকে আপনি র‍্যাগ বলবেন? তাহলে আমাকে আগে আপনারা র‍্যাগের সংজ্ঞা দেন, তারপর আপনাদের সাথে আমি আলোচনায় বসবো। আমি যদি কাউকে সিনিয়র হিসেবে সম্মান করি, তাহলে তার যুক্তিযুক্ত ধমক আমি অগ্রজের শাসন হিসেবে মেনে নেব। আর অযৌক্তিক হলে অবশ্যই প্রতিবাদ করবো।

আরেকদিন বটতলায় খেতে গিয়ে সিনিয়র ভাইয়ের পায়ে পাড়া দিয়ে বসেছিলাম। তিনি ব্যথায় চিৎকার করে বলেছিলেন- ‘এই মেয়ে, ক্যাম্পাসে নতুন নাকি? চোখে দেখো না?’ আমি সরি বলে সরে আসতে চাইলাম, তিনি দাড় করিয়ে বললেন- ‘মাটিতে পা পড়ছে নাকি মানুষের পায়ের ওপর পড়ছে এটাতো সেন্স থাকলে বোঝার কথা। সরি’টা কি আগেই বলা উচিত ছিলো না?’ আমার মনে আছে- ভাইয়ার বলার ধরণে আমি হেসে দিয়ে আবার বলি-‘ভাইয়া আমি আসলেই সরি, একটু পানি এনে দেই? পায়ে ঢেলে দেব?’ ভাইয়া রীতিমত থতমত খেয়ে বলেছিলেন-‘আরে না না, লাগবে না। পরবর্তীতে দেখেশুনে চলবা।‘ এটাও আমার কাছে র‍্যাগ ছিলো না।

জাবি সম্পর্কে আমি আমার অভিমতটা একটু ব্যক্ত করি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আর দশটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মত না। কারণ, অন্য দশটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু বা বড় অংশ স্থানিক শিক্ষার্থী যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকার শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী কিংবা সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেটের শিক্ষার্থী থাকে এবং একিসাথে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্রছাত্রীরা এখানে পড়তে আসে। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জাহাঙ্গীরনগরের আশপাশের শিক্ষার্থী খুব কম। দেশের আনাচ কানাচ থেকে ছাত্রছাত্রীরা এখানে ভর্তি হয় এবং এর স্থানিক অবস্থানের জন্য এটি একটি সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখন নিজ পরিবার, নিজ স্থান ছেড়ে এমনকি শহর থেকে দূরে পারিবারিক আবহ ছেড়ে সম্পূর্ন নতুন পরিবেশে একাকী এসে ছাত্রছাত্রীরা বেশকিছু ঝামেলায় পড়ে, সবাই ঝামেলায় পড়ে তা বলা যাবে না কিন্তু বেশিরভাগই পড়ে। এখানে সিনিয়রদের কাঁধে বেশকিছু অলিখিত দায়িত্ব পড়ে যায়, একিসাথে জুনিয়র যারা হুট করে একটা নতুন পরিবেশে আসে তাদের সাহায্যের, ভালোবাসার, দিকনির্দেশনার প্রয়োজন পড়ে। এখন আপনারা আমাকে যদি বলেন- এটা কি র‍্যাগিংয়ের মাধ্যমে হবে? আমার উত্তর- ‘না, র‍্যাগিংয়ের মাধ্যমে কখনোই হবে না। আমি র‍্যাগিংয়ের পক্ষে নই। কিন্তু সম্পর্ক তৈরি হবার পর সিনিয়রসুলভ শাসন কিংবা বকাকে আমি র‍্যাগ হিসেবে দেখতে নারাজ।‘

প্রশ্ন হচ্ছে- জাবিতে র‍্যাগিং আছে কি না। এখন ২০০৮ সাল হলে বলতাম- র‍্যাগিং আছে। কিন্তু ২০১০ সালেইতো প্রশাসনিকভাবে র‍্যাগিং নিষিদ্ধ হয়েছে এবং যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এক সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর উল্লেখ করেন- ‘শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন করা, এমনকি তিরষ্কার বা খারাপ শব্দ দিয়ে গালি দেওয়া, জোর-জবদস্তি করা, কিছু করতে বাধ্য করা- সোজা কথা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনকিছু জোরপূর্বক করতে বাধ্য করাই র‍্যাগ

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- একজন নবীন শিক্ষার্থী এমন কোন ঘটনা ঘটালো যা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়রকে অপমানিত করছে বা আহত করছে সেটাকেও র‍্যাগের পর্যায়ে ফেলবেন না আপনারা? ফেলা উচিত। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, অপমানিত সেই সিনিয়র শিক্ষার্থী কার কাছে যাবেন বিচারের জন্য? আপনাদের নীতিমালায় এটাও যুক্ত করুন যে একজন সিনিয়রও মানসিকভাবে নির্যাতিত হতে পারেন জুনিয়রের ভাষায়, আচরণে!  

ধরেন- একজন শিক্ষার্থী হেঁটে যাচ্ছেন, না দেখে একজনের সাথে ধাক্কা লাগিয়েছেন। কিন্তু ‘সরি’ বলবার প্রয়োজন মনে করলেন না। এখন যার সাথে ধাক্কাটা লেগেছে সে ডেকে বললেন-‘এই, তুমি দেখতে পাও না? আর ধাক্কা দিলে মানুষতো নুন্যতম সরি বলে!’ বিশ্বাস করেন- এটাকেও র‍্যাগের সঙ্গায়নে ফেলতে দেখেছি আমি। যাকে বলা হয়েছিলো সে হলসুপারের কাছে গিয়ে বলেছিলো-‘ওমুক আপু আমাকে র‍্যাগ দিয়েছে’।

সেই সিনিয়র আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিলো-‘আপু, তাহলে কি এদের সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিব? কথা বললেইতো র‍্যাগ হয়ে যাচ্ছে। ভালোভাবে বললেও তারা মনে করছে তাদের মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে! অথচ আমিতো যেকোন জায়গায় পথে ঘাটে ঘটনাটা ঘটলে একি কথা বলতাম!’ এ ঘটনা বলবার কারণ হচ্ছে- র‍্যাগিং আসলে কাকে বলে এটা আরো সুস্পষ্ট করবার দরকার আছে। এবং এটা অনেকবেশি মানুষভেদে আপেক্ষিক।

একটা কথা আমার কাছে সিনিয়রের শাসন মনে হচ্ছে, আরেকজনের কাছে মানসিক অশান্তি, অন্যজনের কাছে সোজাসুজি র‍্যাগ! তবে র‍্যাগ বলা যাবে এমন গুরুতর ঘটনাও ঘটেছে যখন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগ প্রশাসনিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয় এবং বিচারের আওতাধীন আনা হয় তখন র‍্যাগ দেবে কারা? পরিবারের টাকা খরচ করে পড়তে আসা সাধারণ শিক্ষার্থীরা? তাদের বহিষ্কারের ভয় নেই? যদি কেউ র‍্যাগ দেয় তাহলে সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং তদন্তের প্রেক্ষিতে তাকে শাস্তির আওতায় আনার দায়িত্ব অবশ্যই প্রশাসনের। র‍্যাগিং বন্ধ ঘোষণা হবার ছ’বছর পরেও এটা বন্ধ হয় নি কেনো সেই প্রশ্ন প্রশাসনকে করা যেতেই পারে।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ এনে লিখিত অভিযোগ করেছেন প্রশাসন বরাবর। লিখিত অভিযোগটি পড়বার কোন সুযোগ আমার হয়নি যেহেতু তিনি সেটা মিডিয়ার সামনে প্রকাশ করেন নি। কিন্তু মিডিয়ার সামনে যে ভাসাভাসা অস্পষ্ট বর্ননা তিনি দিয়েছেন তাতে আমি অবাক হয়েছি। আমি ক্যাম্পাস থেকে দূরে এই টেবিল-চেয়ারে, ল্যাপটপের সামনে বসেও আশা করেছি বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে প্রতিটি ঘটনা যাকে তিনি র‍্যাগ বলছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাবো, যারা এ কাজ ঘটিয়েছে তাদের নাম ঠিকানা পাবো। কিন্তু তার কিছু ব্যবহৃত শব্দ আমাকে নিজ ভাবনার জগতে নিয়ে গেছে, ব্যাপারটা এমন- ‘নিজের মত করে যা ভাবার ভেবে নেন’ কিন্তু যা ইতিমধ্যে ঘটেছে সেখানে ভুক্তভুগী হয়ে তো ‘নানারকম নির্যাতন’, ‘যন্ত্রণাকর অধ্যায়’, ‘অপমানিত’, ‘নানারকম ভয়ভীতি প্রদর্শন’ এ ধরনের অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার দুঃখজনক

স্পষ্ট ভাষায় সব খুলে বলা উচিত যেহেতু মিডিয়াতে ঘটনাটি প্রকাশিত হয়েছে আর প্রকাশিত লেখা পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বর্তমান শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে আমরা প্রাক্তনেরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে মনে প্রাণে ভালোবাসি এবং যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত না এমন আমজনতা পাঠক সেখানে সত্য ঘটনা পরিপূর্নভাবে তুলে ধরা খুবই জরুরী কেননা যারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো যায় নি কিংবা ভবিষ্যতে পড়বার স্বপ্ন দেখে তাদের কাছে কি ধরনের মেসেজ যাবে?– ‘ওখানে প্রতিটা মিনিটে র‍্যাগিং চলে এবং সিনিয়র মানেই র‍্যাগিংয়ের জ্বলন্ত বিভীষিকা, ও পথ মাড়িও না যদি তোমার আত্মসম্মান থাকে!‘ নাহ, একটা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এভাবে জেনারালাইজ করে বলবার পক্ষপাতী আমি নই

হয়তো খুঁজে দেখা যাবে, এমন শত শত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আছে যারা এই র‍্যাগিংয়ের ভেতর দিয়ে যায়ইনি এবং স্বপ্নের মত সুন্দর সময় কাটাচ্ছে এজন্যই বলছি- অভিযুক্তদের নাম ঠিকানা, ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করা জরুরী আমরা আশা করছি- খুব শিগ্রই তিনি ভাসাভাসা বর্ণনা থেকে বেরিয়ে এসে সবকিছু খোলাসা করবেন সঠিক তথ্য মারফত কারণ- এটি ফিকশন নয়, বাস্তবজীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা

এদিকে আরেকটি প্রশ্ন আসতেই পারে (এবং এসেছেও বটে)- যেহেতু প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে সেহেতু তদন্ত শেষ হওয়া অবধি তিনি অপেক্ষা না করে এবং তার পাশে কেউ দাঁড়াবে কিনা কিংবা সঠিক বিচার পাচ্ছেন কিনা তা না প্রকাশিত হবার আগেই মিডিয়ায় এ ধরণের প্রকাশ কেনো? কোন বিষয় যখন তদন্তনাধীন থাকে তখন সেটা নিয়ে মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হওয়া তাও আবার সুস্পষ্ট বক্তব্যব্যতীত, এটা ঠিক কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আবারো বলছি, আমি র‍্যাগিংয়ের বিপক্ষে কিন্তু যে ধরণের গল্পাকারে প্রতিবাদলিপি তিনি মিডিয়ার সামনে পেশ করেছেন আমি তারও বিপক্ষে এমনভাবে উপস্থাপন করুন যেনো বোঝা যায় কারা ঠিক কি কি ঘটনা ঘটিয়েছে, কয়জন ছিলো, সবাই কি র‍্যাগ দিচ্ছে কিনা সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক মানেই কি একটা অভিশাপ জাবিতে? এতটা সাধারণীকরণ কি করা যায়?

অনেককিছু লিখে ফেলেছি; আবেগ আর যৌক্তিকতার মিশেলে র‍্যাগিং নিষিদ্ধ হোক আমরাও চাই, চাই বলেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটা চাপ ছিলো প্রশাসনের প্রতি এটা নিষিদ্ধ করবার জন্য কিন্তু র‍্যাগিং আমি কাকে বলছি, কোন ঘটনাকে র‍্যাগ বলছি, আমি একা সেটাকে সঙ্গায়নের যাঁতাকলে ফেললেই কি তা র‍্যাগ হবে কিনা তাও স্পষ্ট হওয়া জরুরী আগেই বলেছি- মানসিক নির্যাতন মানুষভেদে আপেক্ষিক একটি বিষয় ধমক দেয়া একজনের কাছে স্বভাবসুলভ শাসন, কারো কাছে সাময়িক মানসিক কষ্ট, কারো কাছে সরাসরি র‍্যাগিং এখন আমাদের উচিত এ নিয়ে লিস্টি করতে বসা

ওপরে নিজের ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ করবার মধ্য দিয়ে আমি স্পষ্ট করেছি যে বিশ্ববিদ্যালয় নামক একটি বড় পরিসরে অসম বয়সী মানুষের সম্পর্ক তৈরী হবার যে প্রক্রিয়া তা ব্যাচকল বা হলসিটিং যে নামই দেন না কেনো আমি সেগুলোর পক্ষে। কিন্তু সেখানে যদি র‍্যাগিং নামক অপসংস্কৃতি ঢুকে পড়ে তাহলে সেই র‍্যাগিংয়ের বিপক্ষে। একিসাথে প্রশ্ন- আপনি কাকে র‍্যাগিং বলছেন এবং একিসাথে আপনার সাথের সতীর্থরাই যদি তাকে র‍্যাগিং না মনে করেন তাহলে র‍্যাগিংকে কিভাবে আরো সুস্পষ্টভাবে সঙ্গায়িত করা যাবে তাও আমার জানবার ইচ্ছে রইলো।

যারা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেছেন কি করেন নি, তাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ভালোমন্দ মিলিয়ে নষ্টালজিক এক জায়গা। এইতো সেই ক্যাম্পাস যেখানে ছয়টা বছর কাটিয়ে এলাম, ভালোবাসাতাড়িত হয়ে ‘জন্মের দ্বিতীয় আঁতুড়ঘর’ বলি, ‘জানবিবি’ বলি। ক্লাস, থিয়েটার, আড্ডা, হল, বটতলা, টারজান, শহীদমিনার, ট্রান্সপোর্ট, ক্যাফেটেরিয়া, ডেইরি, প্রান্তিক, বিশমাইল, মুক্তমঞ্চ ঘুরে ঘুরে সারাটা দিন উদ্দাম সময় কাটিয়েছি। আন্দোলন করেছি গোটা পাঁচেক, প্রতিবাদ করেছি বহু অন্যায়ের। কই, নিজের আত্মসম্মান খোয়ানোর কথাতো কোনদিন মাথায় আসেনি। ভালোবেসে আঁকড়ে ধরেছিলাম ক্যাম্পাসকে, ক্যাম্পাসের মানুষগুলোকে।

আজ এতোদূরে বসে ক্যাম্পাসের যে কোন হৃদয়বিদারক ঘটনাই আমাকে ভাবিয়ে তুলে, নাড়া দেয়। আমি চাই না আমার প্রিয় ক্যাম্পাসের চিত্র এমনভাবে মানুষের কাছে ফুটে উঠুক যেখানে পুরো ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাসের মানুষজন, কৃষ্টিকালচার রঙ বদলে মুহুর্তে সাদাকালো হয়ে যায়। আমি চাই যে কোন অন্যায়ের বিচার হোক সুষ্ঠভাবে এবং অন্যায় ঠিক যতটুকু ততটুকু সুস্পষ্ট তথ্যনির্ভর ভাবে সবার চোখের সামনে আসুক। পুরো ক্যাম্পাসকে বিষময়, অভিশাপস্বরূপ উপস্থাপন না করে ফেলা না হোক।

শেয়ার করুন: