উইমেন চ্যাপ্টার: হেলেন, চম্পাসহ বেশ অনেক কজন নারী। অনেক আগেই তাদের অনেকের হাতে মোবাইলে ফোন উঠেছে। কিন্তু তা ছিল কাজ চালানোর মতো। অর্থাৎ শুধুমাত্র একে-অন্যের খোঁজখবর রাখা। এইটুকুতেই ছিল ফোনের সুবিধা। কিন্তু ফেসবুকিং করা, বা ছবি আপ করা, অথবা খবরাখবর পড়ার মতো নেট সুবিধা তাতে ছিল না।
আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফামের একটা প্রজেক্টের কল্যাণে এই নারীদের হাতে উঠলো ট্যাব এর মতো দরকারি একটি জিনিস।
হেলেন বলছিলেন, ট্যাব এর ব্যবহার তাদের শেখাতে হয়নি। যেহেতু মোবাইল ফোন অপারেট করতে পারতেন আগে থেকেই, তাই ট্যাব ব্যবহারে অসুবিধা হয়নি। সুবিধা কী হয়েছে? হেলেন হেসে জানান, এখন তারা ট্যাবের মাধ্যমে তাদের নানা কর্মসূচির ছবি শেয়ার করতে পারছেন, দেশজুড়ে এই প্রজেক্টের অধীনে আরও যেসব ‘বকুল নারী আড্ডা’ আছে, তাদের খবরাখবর জানতে পারছেন, নিজেরাও নিজেদের খবর জানাচ্ছেন অন্যদের। তাছাড়া দেশে কী ঘটছে না ঘটছে, সব খবরই তো পাচ্ছেন এই ট্যাবের সহায়তায়।
উদাহরণ টেনে বললেন, সম্প্রতি দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া খাদিজা, রিশার ঘটনা আশেপাশের সবার সাথে শেয়ার করেছেন, নিজেদের এলাকায় যাতে এসব ঘটনা না ঘটে, তা নিয়ে গ্রুপের পুরুষদের সাথে নিয়ে এলাকার মুরুব্বীদের সাথে কথা বলেছেন। ফলে এলাকায় নারী নির্যাতনের নানা দিক নিয়ে বেশ একটা সচেতনতা এসেছে। আগে মেয়েদের স্কুলকে ঘিরে ইভটিজিং নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল, কিন্তু এখন নাই বললেই চলে। বিশেষ করে স্কুলের একেবারে কাছেই তিনি দোকান নিয়েছেন, ফলে সবই তার নখদর্পণে এখন। বেশ সগর্বেই বললেন তিনি কথাটা।
প্রকল্পটির সমন্বয়ক শাহিদা শারমিন জানালেন, ট্যাব ব্যবহার করে প্রকল্পের নারীরা এখন শুধু আড্ডার কাজের খবরাখবরই শেয়ার করেন না, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন খবর সহজেই পাওয়া যায় বলে সেই নিউজগুলো পড়েন, নিজেদের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা করেন, ছবি শেয়ার করেন, মিটিংয়ের ছবি দেন, মিটিংয়ের আলোচনার বিষয়গুলো গ্রুপে তুলে ধরেন। শারমিন জানান, একেকটা গ্রুপে ২৫ জনের মতো সদস্য, তারা প্রতি ১৫ দিনে একবার বসেন। তবে জরুরি কোনো বিষয় হলে এর মাঝেও তারা বসেন। এই গ্রুপের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে শারমিন জানান, এরা এরই মধ্যে এলাকার বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে কয়েকটা, ইভ টিজিং এর বিরুদ্ধে তাদের অনমনীয় আচরণ অনেককেই উৎসাহিত করে যেমন, তেমনি ইভটিজারদের কিছুটা হলেও আতংকিত করে।
তাদের জীবনে আর কোনো পরিবর্তন? – এই প্রশ্নের উত্তরে শারমিন বলেন, অবশ্যই অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে তারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন, কথা বলতেন, কিন্তু এখন হাতে ট্যাব উঠায় তাদের মধ্যে একধরনের চারিত্রিক দৃঢ়তাও এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা, তারা আগের চেয়ে এখন অনেক স্মার্ট হয়েছেন। পুরুষদের সাথে দিব্যি চলতে শিখেছেন। আর এই যে আড্ডা, এখানে আসার কারণে তাদের নিজেদের মধ্যেও একটা বন্ধন গড়ে উঠেছে, যা খুবই দরকার নারীর ক্ষমতায়নে।
প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া না থাকলেও তাদের এই প্রযুক্তি ব্যবহারে কোনরকম বেগ পেতে হচ্ছে না, বেশ স্বচ্ছন্দেই ট্যাব চালান, সুন্দরভাবে অপারেট করতে পারেন, কোন কোন ছবি দিতে হবে, তাও নির্বাচন করতে পারেন, আগের চেয়ে অনেক অ্যাকটিভ এই সদস্যরা।
মোনাশ ইউনিভার্সিটি এবং অক্সফামের যৌথ উদ্যোগে গৃহীত এই প্রতীক প্রতীক কল্প বিষয়ে কিছু তথ্য এখানে যোগ করা হলো:
- কুমিল্লার বুড়িচং থানার শ্রীমান্তপুরে মোট ‘নারী আড্ডা দল’ ১৫টি। সদস্য সংখ্যা ২০/২৫ জন করে। এদের মধ্যে ৫/৬ জন কিশোরী। সিটি কর্পোরেশনে ৫টি, ১০টি ইউনিয়ন পর্যায়ে।
- আড্ডায় বাচ্চাদেরকে স্কুল পাঠানো, পারিবারিক সহিংসতা, ইভ টিজিং, বাল্য বিবাহ নিয়ে কাজ করা হয়। আইনি সহায়তার জন্য ব্লাস্ট, বা থানার সহায়তা নেয়া হয়।
- এসব ক্ষেত্রে সাকসেস স্টোরি ৭০%।
- সফল কেস স্টাডি হিসেবে বাংলাদেশ থেকে বাছাইকৃত ১০টির মধ্যে কুমিল্লার ৩টি।
- ‘আড্ডা দলে’র সদস্যরা ক্ষুদ্র ব্যবসায় জড়িত। মুদি, পার্লার, ব্যাগ ইত্যাদি।
- হেলথ সেক্টরে সচেতনতামূলক কাজ করা হয়। বিশেষ করে গর্ভবতী মা এবং নবজাতক শিশুদের টিকা দেয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
- বকুল নারী আড্ডা দলে ৮/৯ জনের ফেসবুক আইডি আছে। ফেসবুকের কারণে নারীদের উপর সহিংসতা, প্রতিকার বিষয়ে তারা অনেক কিছু জানতে পেরেছে।
- ইভ টিজিং এবং বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে সফলতা সবচেয়ে বেশী। নারী অধিকার নিয়েও বেশকিছু কাজ সফলভাবে করেছেন। অতীতে শ্রীমন্তপুর এলাকায় মেয়েদের স্কুলের সামনে ইভ টিজিং এর ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ছিলো। বর্তমানে তা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
- শ্রীমন্তপুর গ্রামে একটি ভাঙ্গা রাস্তার কারণে ১০ টাকার রিক্সা ভাড়া ৫০ টাকা দিতে হতো। বকুল নারী দল উদ্যোগ নিয়ে রাস্তাটি মেরামত করে।
- ট্যাবের কারণে বিভিন্ন নারী অধিকার সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে।
- বকুল নারী দলের সভাপতি হেলেনা ‘জয়ীতা বাংলাদেশ’ পুরস্কার পেয়েছেন ।
অক্সফামের তথ্য অনুযায়ী মোট তেরটি জেলায় ৪৯০টি আড্ডা গ্রুপ আছে, সেখানে সদস্য সংখ্যা ১৪ হাজার ৭০০ জন। গড়ে ৩০ জন সদস্য একেকটি আড্ডায়। প্রযুক্তির ব্যবহার এই প্রতিটি আড্ডাকে একে-অপরের সাথে সংযুক্ত করে দিয়েছে।
মূলত; তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ আজ গোটা বাংলাদেশকেই বদলে দিচ্ছে। আর এর একটা বিশাল প্রভাব পড়ছে নারীদের জীবনেও। শুধুমাত্র গ্রামের মেয়েরাই নয়, শহুরে যে শিক্ষিত মেয়েটাও উদ্যোগের অভাবে বা সুযোগের অভাবে কোনকিছু করতে পারছিল না, সেও আজ নতুন উদ্যমে মাঠে নেমেছে।