চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: আমরা মেয়েরা মেয়েদের বন্ধু কম, শত্রু বেশি। পুরুষদের তুলনায় আমরাই আমাদের সমালোচনা বেশী করি। নারী-পুরুষ বৈষম্য সমাজের? সেও অনেকটাই মেয়েদের নরম হাতে লালিত।
মাঝে মাঝে হতাশ লাগে। বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে খাতা-কলম বন্ধ করে বসে থাকি। কিন্তু ভাবনাগুলো তো পিছু ছাড়ে না। এই সমাজ তো মেয়েদের জন্য এখনও অনেক বেশি কঠিন… দিনশেষে অবলীলায় যেকোনো দোষে প্রথমে তো মায়েদেরই দোষী হতে হয়। তাও কেন আমাদের নিজেদের ভেতরই এত বিদ্বেষ? আমাদের দু:খ, পারা না পারা তো পুরুষদের চেয়ে আমাদের নিজেদের জানা…সহযাত্রী অন্য নারীর প্রতি তাই সহমর্মিতা তো আমাদেরই দেখাবার কথা ছিল। কিন্তু তা হচ্ছে কই?

দিন-রাত আশপাশে কেবল দেখছি মেয়ে মহলে ঘুরে ফিরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে নারী নিয়ে পরচর্চা – অনুবীক্ষণ যন্ত্র হাতে অন্য মেয়ের দোষ অন্বেষণ। জন্মের শুরু থেকেই তো নারী বৈষম্যের শিকার…সমালোচনার ক্ষুরধার পিছু ছাড়ে না তার কোন অঙ্গনেই।
এখনো ঘরে ঘরে দুপুর কিংবা রাতের খাবার টেবিলে মুরগীর বড় রান কিংবা মাছের বড় টুকরাটা বলেন তো সন্তানদের ভেতর মা কার পাতে তুলে দেন? ছেলে না মেয়ে? ধরেন এক পরিবারে দু’সন্তান। ছেলে এবং মেয়ে। দু’জনই মেধাবী, দু’জনেরই বিদেশ যেয়ে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন। বিপত্তিটা বাধে, যখন বাবা-মায়ের সঞ্চিত অর্থে কেবল একজনের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব। বলেন তো এই ছেলে বা মেয়ের ভেতর কার ভাগ্যে জুটবে সেই সেই স্বপ্ন পূরণের চাবিকাঠি? বৈষম্যের শুরুটা কোথায় খেয়াল করছেন?
ছেলে জন্ম থেকেই জানছে তাকে বড় হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে। এই শিক্ষা দেয়া ভুল না, ভুলটা আমরা করি যখন এই একই শিক্ষা মেয়েকে না দিয়ে তাকে বঞ্চিত করি। আমরা মায়েরা মেয়েদের ত্যাগ, সহনশীলতার শিক্ষা দেই, সংসারকে সব চাওয়ার উর্ধ্বে রাখা শেখাই। মেয়েকে সেই শিক্ষা দেয়াটাও ভুল না। ভুলটা করি যখন এই একই শিক্ষা আমার ছেলেকেও না দিয়ে তাকে একজন কেবল মাত্র “পুরুষ” থেকে মানুষ হবার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করি। সহনশীলতা, সহমর্মিতা, ভালোবাসা, পরিবারের একে অপরকে শ্রদ্ধাবোধের জ্ঞান তো মেয়েছেলে নির্বিশেষে সবারই পাবার কথা!
আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি একজন শিশুর চরিত্র গঠনে মা এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেই মা হয়ে আমি যদি শিশুর চরিত্র ও মনোবিকাশে বৈষম্য টানি, তাহলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জের টানতে হবে আমাদের অনন্তকাল।
কার্টুনের মিনা রাজু তাই কোন কাল্পনিক চরিত্র না। আপনার আমার ঘরের এতোই মামুলি দৃশ্য যে গা সওয়া হয়ে গেছে। এই আমাদের মায়েদের দেয়া শিক্ষার ছায়াতলেই ছেলেরা বড় হচ্ছে কিছুটা স্বার্থপর হয়ে। স্কুল কলেজে খেলা কিংবা অন্য কোন প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে ছেলে কাঁদলে আর সবার সাথে এই আমরা মা বোনেরাই তো তাকে তিরস্কার করেছি, “এই তুই কি মেয়ে নাকি রে?”। ছেলেও আমার তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিয়েছে, পাছে “মেয়ে” হয়ে যায় সেই ভয়ে। মেয়েদেরকে হীন চোখে দেখার শিক্ষা দিয়েছি আমরাই ছেলেদের সজ্ঞানে অথবা “অজ্ঞানে”।
আর ঠিক এই কারণেই আমি অবাক হই না আমার রিসার্চ ইন্টারভিউতে যখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সেই ডিরেক্টর ভদ্রলোক যখন বলেছিলেন, “আমি আমার বউকে চাকরি করতে দেইনি। মেয়ে মানুষ ঘর সামলাক…বলেছি কতদূর যেতে পারবে তুমি যদি চাকরি করতে দেই?”।
আমি অবাক হই না তখনও, যখন সেই এইচআর হেড বলেছিলেন, “কোম্পানি ডিসিশন নেয়া যদি বাসায় রুই মাছের সাথে পটল ভালো না ক্ষেতের টমেটো, তাহলে তো হতোই…যার যে কাজ তার সেটাই করা উচিত।” আজকের এই সব ভদ্রলোকরাই আমার হাতে গড়া সেই পুরোনো রাজু।
যুগে যুগে বাবার চেয়ে বেশি আমরা মায়েরাই মিথ্যে অহমিকা দিয়ে বড় করেছি ছেলেদের, নিজ হাতে, লালন করেছি তাদের আধিপত্য, প্রতিদিন তিল তিল আমরা গেড়ে দিয়েছি না চাইতেই অগ্রাধিকারের অন্যায় দাবী। আত্মঅহমিকা তাই এখন ছেলেদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মেয়েদের ছোট করে দেখা তার জন্মগত অভ্যাস।
একটা মেয়ে সংসার শুরু করে সোনালী রঙের স্বপ্ন ডানা মেলে। নিজস্ব শেকড় ছেড়ে প্রিয় মানুষটার হাত ধরে। বলেন তো, পত্র-পত্রিকায় নারী নির্যাতনের ঘটনার যে চিত্র ফুটে ওঠে, তাতে কি শুধুই স্বামী মহাশয়ের হাত ছিল? নাকি নির্যাতিতা মেয়েটির সমগোত্রীয় আরেকজন নারীই তার স্বামীর হাতে চুলা থেকে নামানো গরম খুন্তি তুলে দিয়েছিল। প্রায়ই রাঁধবার সময় গরম খুন্তির ছ্যাঁকা খেয়ে আমরা দেখেছি না কী তীব্র যন্ত্রণায় পুড়ে যায় অন্তরাত্মা… ছেলের বউকে পোড়াবার সেই পৈশাচিক আনন্দে উল্লাস করা তো তাই আমারই প্রাপ্য।
“সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে”। বাড়ির মুরুব্বীরা মেয়েদের শিখিয়েছেন জন্মের পর থেকেই। কথা সত্য। নারীর “রমণী” হবার প্রতিযোগিতায় আমরা জিতে গেছি বহুবার। নারীর সহনশীলতায়, সহমর্মিতায় আর ক্ষমাশীলতায় সুখী হয়েছে সংসার। কিন্ত এই মেয়েদের সুখ গুনেছি আমরা কে কয়বার? কে হিসাব রেখেছি সমাজের দেয়া এই একপেশে স্বার্থপর সুখী সংসার গড়ার মন্ত্র দিয়ে সংসার সুখী হলেও রাতের পর রাত ভিজেছে মেয়েদের চোখের জলে বালিশের ভাঁজ।
আমি বুঝি না আর কতদিন লাগবে আমাদের বুঝতে, সত্যিকারের সুখী সংসার শুধু নারীর গুনে না বরং সদর্পে আসে দু’জনের গুনে। সেই দিন আর কতদূরে যেদিন মায়েরা মেয়ের সাথে সাথে ছেলেদেরও শিক্ষা দেবেন, সংসারটা দুজনের, দায়িত্বও দু’জনের। যেকোনো সিদ্ধান্তও তাই নিতে হবে দু’জনকে মিলেই। সংসার একটা টিম ওয়ার্ক…কিছু দায়িত্ব আমার কিছু তার…প্রতিটা মানুষ ভিন্ন, তার চাওয়া পাওয়াও ভিন্ন। সংসার শুরুর আগে এই ভিন্নতা নিয়ে আলোচনা টা জরুরী পরবর্তী তিক্ততা এড়াবার জন্য। দু’জন দু’জন কে বোঝা, এক জন আরেকজনকে তার স্বপ্ন বোনায় সাহায্য করাটা কেন আজো শুধুই কল্পনা! কত যুগ লাগবে আমাদের বোধদয় হতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সম্মান আর ভালোবাসাই সুখী সংসারের চাবি কাঠি…শুধু রমনীর গুন নয়।
একজন চাকরীজীবী নারী কে চাকরী জীবন শুরু করতে হয় এই সমাজে অদেখা অলেখা অপরাধবোধ নিয়ে। চাকরী করা না করা টা অনেক ক্ষেত্রেই তার ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের পথ হিসেবে গন্য করা হয়। ক্যারিয়ারিস্ট হওয়া ছেলেদের জন্য বিশাল বড় গুন হিসাবে বিবেচিত, হলেও মেয়েদের জন্য তা এক্কেবারেই উল্টোটা। ধরেই নেয়া হয় চাকরী করা এবং ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্ন দেখা মেয়ে গুলো বিয়েই করে ডিভোর্স নেয়ার জন্য আর বাচ্চার মা হিসাবে সে তো মারাত্মক ভাবে ব্যর্থ এবং সাক্ষাৎ এক ডাইনী বুড়ী। বাচ্চা নানি দাদি যে কোন সেইফ কাস্টডি তেই রেখে চাকরীতে যাওয়া হোক না কেন, আমরা মেয়েরাই সেটাকে আহা উহু বলে প্রতিনিয়ত তাকে ডুবিয়ে দেই অপরাধবোধের চোরা বালিতে। বাচ্চা অসুস্থ হলে তো হলোই, পুরুষদের আগে এই আমরাই বলি “অসুস্থ হবে না? মা তো থাকে বাইরে বাইরে”। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি? হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সব বাচ্চা কি তবে চাকরীজীবী মায়েদেরই? কি পৈশাচিক আনন্দ পাই আমরা এটা ভেবে, যে মা অসুস্থ বাচ্চা রেখে অফিস যায় তার মন পড়ে থাকে না তার সন্তানের কাছে?
স্কুল কলেজে ছেলেমেয়েদের দুষ্টামির মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে স্কুলে তাদের ডিটেনশনে পাঠান। সে নিয়ম তো সারা বিশ্ব জুড়ে। আগে যখন আমাদের মা খালারা ঘরে থাকাই বেছে নিয়ে ছিলেন, সেই সময়ও এই ডিটেনশন এর নিয়ম ছিল। আর কি দিব্যি ভুলে গেলাম আমরা। এখন পুরো ক্লাস ডিটেনশনে গেলেও খুজে বার করি এর ভেতর চাকরী করা মা এর “অভাগা” ছেলে পেলে আছে কিনা…আর তারপর সেই একই “হবে না? মা তো থাকে বাইরে বাইরে”। কি আশ্চর্য! পৃথিবী সব বখে যাওয়া সন্তানের মায়েরাই চাকরী করেন এমন রেকর্ড আছে নাকি? কি যে বাজে ঠেকে কানে এই “বাইরে বাইরে” থাকা শব্দটা!
জানিনা আর কত যুগ আমাদের পার করতে হবে এই সাধারন কথা টুকু বুঝতে, সন্তান লালনে পালনে কতটুকু সময় দিলাম তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো কিভাবে সময়টা দিলাম। ঘরে থেকেও বাচ্চা সারাদিন টিভি কিংবা গ্যাজেট নিয়ে বসে থাকাটা কে কিন্ত মানসম্পন্ন সময়ে দেয়া বলে না।
চাকরিরর পাশাপাশি সংসারের সেই সনাতনী নিয়ম কানুন দাবী দাওয়া পালনে হিম শীম খাচ্ছে মেয়েরা..Work-life দুইয়ের ভেতর ব্যালেন্স কি এতই সহজ? তাও আবার একা হাতে? একটু টাল মাটাল হলেই ব্যাস শুরু…সমালোচনার ঝড় তুফান। কেউ এসব সমালোচনায় মুষড়ে পড়ছি তো কেউ আবার তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চলছি… সবার মানসিক জোর তো এক না। কিন্ত সব মানসিকতার মানুষেরই আবার মিল একটা জায়গাতে, আমরা সবাই সহযোগিতা বা সহমর্মিতায় দ্রুত পথ চলতে পারি। সেই সহানুভূতিগুলো আমাদের কোথায় হারায়?
আমি একবারো বলছি না, সব দোষ মেয়েদের। শুধু বলতে চাই পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষদের পরিবর্তন হওয়া তখনি শুরু হবে যেদিন আমাদের একাত্মতা মজবুত হবে। একজন নারী হয়ে অন্য নারীর সম্মান রক্ষায় যেদিন আমরা নারীরা সচেতন হব, নারীর মর্যাদা এবং অধিকার রক্ষা সেদিন সহজ থেকে সহজতর হবে। একজন নারী যদি অন্য নারীর হাত টা শক্ত করে ধরে অলৌকিক কিছু করে ফেলাও অসম্ভব না। বাধা তখন আর বাধা থাকে না। ঘরে থাকি কিংবা চাকরী তে আমাদের কখনো একা মনে হবে না। আমরা একজন আরেকজনের সমালোচনা না, বরং ভালোবাসায় আর বন্ধুত্বের বার্তা পৌছাতে পারি না? আমরা মায়ের জাতি। আমরা জন্মেছিই তো গড়বার প্রতিজ্ঞা নিয়ে…ভেঙে ফেলা আমাদের মানায় না।
এসোসিয়েট প্রফেসর এন্ড চেয়ারম্যান,
ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়