আমিও যখন ‘মালাউন’

তানিয়া মোর্শেদ: আমি গালাগালি ভীষণ অপছন্দ করা মানুষ। অনেক গালির বা খারাপ শব্দের অর্থ জানতাম না বা জানি না। বাংলাদেশের মুসলমানরা কথায় কথায় হিন্দুদের “ম” দিয়ে যে শব্দটি বলে তার অর্থ না জানলেও বুঝতাম খুব জঘন্য গালি হিসাবে ব্যবহার হয়। জেনেছি শব্দটির অর্থ হচ্ছে অভিশাপপ্রাপ্ত। এও জানলাম ইসলাম ধর্মে মুসলমান বাদে বাকীদের জন্য এই শব্দ।

সেই অর্থে বাংলাদেশের মুসলমানরা ধর্মের পথেই আছে! এদিকে সন্ত্রাসী মুসলমানদের জন্য পুরো মুসলমান গোষ্ঠি নিজেই এখন অভিশাপপ্রাপ্ত পৃথিবীতে! একথা যদি এখনও কেউ অনুধাবন না করে থাকেন তবে সম্পূর্ণ ডিন্যায়ালে আছেন। বাংলাদেশ বা অন্য কোনো মুসলিম দেশ বাদে অন্য কোথাও যেয়ে তা পরীক্ষা করতে পারেন। কোথাও কম বা বেশী, এই যা।

malaun-tooবাংলাদেশের মৎস্য মন্ত্রী এই গালি দিয়েছে (“ছেন” লিখছি না ইচ্ছে করে)। এখনও পর্যন্ত এই মানুষ মন্ত্রী আছে! যদি সে না বলতো একথা তাহলে তা অস্বীকার করতো। এখনও যেহেতু করেনি তাই ধরে নেওয়া যায় সে বলেছে। বাংলাদেশের হিন্দুরা কথায় কথায় এই শব্দ শোনেন।

কেবল ধর্মান্ধ, অতি ধার্মিক মুসলমানদের কাছ থেকেই নয়। যারা হয়তো সেভাবে ধর্ম পালন করে না তারাও বলে। এসব জেনে আমার কেমন লাগে তা আমিই জানি! এসব মানুষদের অন্য কেউ যদি কোন গালি দেয় তাদের কী প্রতিক্রিয়া হয়, হবে তাও জানি। এধরনের মানুষ অন্য দেশের মানুষকে “বর্ণবাদী” ট্যাগ লাগাতে একটুও সময় নেয় না অথচ নিজেদের বর্ণবাদী চরিত্র ভুলেও দেখে না! বাংলাদেশের মানুষের বর্ণবাদী চরিত্র আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। বর্ণবাদ বলতে শুধু গায়ের রং বোঝায় না। এটা যে কোন ধরনের বৈষম্যকে বোঝায় এখন।

লেখা বেশী বড় করার সময় নেই। দু একটা উদাহরণ দেই। এদেশে অনেকেই বয়স্ক বাবা-মাকে নিয়ে আসেন। আসার সাথে সাথে (গ্রীন কার্ড বা নাগরিক হওয়ার পর) বয়স্ক ভাতা নেন অধিকাংশই। গতকাল একজন বলছিলেন, এধরনের মানুষগুলো এদেশে এসে এদেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা খায়, আর এদেশের সবকিছুর নিন্দা করে! তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছেন।

আরেকজন বলেছেন আরেক কথা। একজন ইন্টারপ্রিটার হিসাবে কাজ করেন। তিনি ইয়ার্কি করে এধরনের কাউকে বলেছিলেন, “ইহুদীদের টাকা খাচ্ছেন।” মুসলমানদের ইহুদী বিদ্বেষের কথা ভেবেই বলা নিশ্চয়। সেই মানুষ নাকি বলেছেন, সৌদীর টাকা, ইহুদীর নয়! হাসতেও পারিনি! এদেশের সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা হলো সৌদীর টাকা! মনে হয় বাংলাদেশে সৌদীর টাকা খেয়ে সব টাকাকেই সৌদীর টাকা ভাবেন!

যাক ফিরে আসি মূল প্রসংগে। আমি যে শব্দ কখনো উচ্চারণ করিনি, লিখিনি তা কেন আমার প্রোফাইলে দিয়েছি? যদিও আমি কাউকে ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য নই, তবুও বলি। ভারতে অনেক দরিদ্র কৃষক সময় সময় নিজের গায়ে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন তা সবার জানা। সেভেন সিস্টারসের মণিপুর প্রদেশে ভারতীয় আর্মির দ্বারা নারী ধর্ষণের প্রতিবাদে সেখানের বেশ কিছু নারী পোশাক খুলে “ইন্ডিয়ান আর্মি রেইপ আস” লিখে প্রতিবাদ করেছিলেন।

tania-morshed
তানিয়া মোর্শেদ

আমি এ’দুটো উদাহরণ দিচ্ছি এ’কারণে যে এ’দুটো প্রতিবাদ প্রতিবাদের চরম প্রকাশ বলে। অনেকেই হয়তো এই প্রতিবাদের যৌক্তিকতা খুঁজবেন। বোকামী বলবেন ইত্যাদি। অনেকেই হয়তো প্রতিবাদকারীর হতাশা, ক্ষোভ, প্রতিবাদের তীব্রতা বুঝতে ব্যর্থ!

সেভাবেই অনেকে বলছেন “ম” দিয়ে এই চূড়ান্ত গালি কেন নিজের নামের সাথে জড়াচ্ছো! কালো কাউকে “ন” দিয়ে শব্দ বলা, আদিবাসী অ্যামেরিকানদের ” … ইন্ডীয়ান” বলা, ইহুদী কাউকে গালি দেওয়া, মুসলমান কাউকে গালি দেওয়া, হিন্দু কাউকে “ম” শব্দ বলা এবং এরকম সব শব্দ অন্যান্যদের বলা চূড়ান্ত অন্যায়।

কিন্তু এটা হয়ত অনেকেই জানেন না একজন কালো মানুষ নিজেকে “ন” শব্দ বলা আর অন্য কারো “ন” শব্দ বলা এক নয়।

যাই হোক, আমি নিজে হিন্দু ঘরে জন্মাইনি। আমি কোনো হিন্দু বা কাউকে “ম” শব্দ দুঃস্বপ্নেও বলিনি, বলবো না। আমি এই শব্দ উচ্চারণই করি না। আমি মনে করেছি যেহেতু আমি মুসলমান ঘরে জন্মেছি, আর মুসলমানরাই এই শব্দ হিন্দুদের বলে, তাই আমার সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ হবে যদি আমি নিজেকেই এই “ম” শব্দ বলি।

কতটা হতাশা, ক্ষোভ, ক্রোধ, অপমান, লজ্জা থেকে বলেছি তা কারো বোঝা না বোঝায় আমার কিছুই যায় আসে না। আমার বাকস্বাধীনতার ১০০% ব্যবহার আমি করি (ততক্ষণই বাকস্বাধীনতা, যতক্ষণ না তা কারো কোন ক্ষতি করে)।

শেয়ার করুন: