জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যে ‘অপরের’ও

মির্জা তাসলিমা সুলতানা: প্রত্যেকেরই নাকি নিজ নিজ একটি নদী থাকে। এই রূপকের কাব্যিক ব্যঞ্জনা রয়েছে, নদী-মাঠ-ঘাট তথা প্রকৃতির সাথে এবং এমনকি বস্তুর সাথে ব্যক্তির আলাদা সম্পর্কের কথা হয়তো বোঝানো হয়। কিংবা এ ছাড়াও এর আরো অর্থ হতে পারে। প্রিয় মুখ আফসানা বেগম (তাঁকে চিনি লেখক হিসেবে, যদিও তাঁর লেখা পড়া হয়নি। গান তিনি খুবই ভাল গান, নিজে শুনেছি।) “আমার জাহাঙ্গীরনগর এবং কিছু প্রশ্ন” শিরোনামে যে প্রবন্ধ লিখেছেন তা পড়ে আমার মনে পড়ে গেল আমারও একটা জাহাঙ্গীরনগর আছে তো! এইখানে শিক্ষার্থী ছিলাম ৯৩ সাল পর্যন্ত।

ju-7নানান নস্টালজিয়া আছে এইখানে পড়বার সময়টাকে ঘিরে। প্রথম দিনটি থেকে পাশ করা পর্যন্ত স্মৃতিগুলো এইসময় দাঁড়িয়ে মধুরই মনে হয়। যদিও তার মধ্যেও বেদনা ছিল ভুলিনি, কিন্তু বেদনা বোধগুলো আর এখন নেই! তবে যেমনটা আফসানা লিখেছেন, তেমন কোন পূর্ববর্তী সহপাঠির নির্দেশে হলের বারান্দা মোছার, বা নিয়মিত তাদের কাউকে চা এনে দেওয়ার দুঃসহ (আমার তো মনে হয়, আমার তেমনটাই বোধ হতো) স্মৃতি নেই। এরকমটা ঘটলে সম্ভবত ঐ জাহাঙ্গীরনগর শুধু ঐসব অগ্রজেরই হতো, সে বয়সে আমি লেখাপড়ায় নিশ্চিত ইস্তফা দিতাম। অথচ আছে পূর্ববর্তীদের কারো কারো সাথে হৈ হুল্লোড় এবং সহযোগিতার স্মৃতি।

আফসানার লেখার প্রথম অংশটায় আমার মনোযোগ। সেখানকার ঘটনা বর্ণনা থেকে দেখতে পাই, অনুজ প্রথমে অগ্রজের আচরণ মেনে নিলেও ধীরে ধীরে বুদ্ধি দিয়ে অগ্রজকে ভুল স্বীকারে বাধ্য করেছে। তাও ভাল যে এসমস্ত আচরণ যে ‘ভুল’ তা শেষটায় এসেছে। তবে তিনি কোনোভাবেই অন্যায়কে নির্ধারণ করতে পারেননি, বা চাননি! যদিও তিনি র‌্যাগিংকে সমর্থন করছেন না বলছেন!

পরিধেয় দিয়ে বারান্দা মোছানো, কিংবা নিত্য কাউকে চা এনে দিতে বাধ্য করা কী তাহলে? ঘটমান যন্ত্রণাদান বা নির্যাতন নয়? অতীত স্মৃতি রোমন্থন কেবল! আমার খুব খটকা লাগছে, আফসানার সময়ে তাঁর সকল সহপাঠি কি এমন বুদ্ধি করে ধৈর্য ধরতে পেরেছিলেন? কেউ কেউ কি অপমানিত হননি নিজের জামা কাপড় দিয়ে বারান্দা মুছতে? মুষড়ে পড়েননি এই রকম নিত্য চাপে পড়ে? আর এছাড়া আমরা কি নিশ্চিত হতে পারছি যে এই রকম একটা ঐতিহ্য ঐসময়ে বা কালে কালে আরো বেশী সহিংস হয়ে উঠেনি!

ju-4আমার জাহাঙ্গীরনগর, শিক্ষার্থী জীবনের পরও বর্ধিত কারণ এখানে মাস্টারী করি ১৯ বছর যাবৎ। ২০০৯ এর আগে একবার নবীন শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে দলগতভাবে নিপীড়ন করারত অবস্থায় অপর জ্যোষ্ঠতম শিক্ষার্থীরা বিভাগে এসে জানায়, আমরা বিভাগের শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সাথে সাধারণ সভা ডেকে আমাদের অবস্থান র‌্যাগিং এর বিপক্ষে, তা স্পষ্ট করি। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে চলে যাই, ফিরি ২০১৩ তে।

পরের বছরই প্রথম বর্ষে ক্লাস নিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে পারি নিয়মিত নিপীড়ন চলছে। ছেলেরা ভীষণ ত্রস্ত, খুলে বলে না কী তাদের অভিজ্ঞতা! এরপরও যা বলেছিল, শুনে শিউরে উঠেছিলাম, পথ পাইনি প্রতিকারের। মেয়েরা জানায়, দিনের পর দিন হলে প্রথম বর্ষের  সমস্ত শিক্ষার্থীদের একটি টয়লেট ও একটি বাথরুম ব্যবহারে বাধ্য করা হয়। পরের বছর একই শিক্ষার্থীরা নতুনদের নিপীড়ন করছে বলে শুনলাম।

জানলাম, প্রথম দিন সকল শিক্ষক ক্লাসে ওরিয়েন্টেশনের পর পূর্ববর্তী শিক্ষার্থীদের একদল নতুনদের সারাদিন আটকে রেখেছিল। এ চলছিল বেশ ক’দিন। একজন অজ্ঞান হয়ে গেলে শিক্ষার্থীরা তাদের উপদেষ্টা হিসাবে আমার কাছে আসে। একে একে উন্মোচিত হতে থাকে ভয়াবহ সব ঘটনা।

mirza-taslima-sultana
মির্জা তাসলিমা

হলে শিক্ষার্থীদের সারারাত জাগিয়ে রাখা হয়। মেয়েদের হলে ঘুম থেকে তুলে সিটিং দেওয়া হয়। মানে আদব-কায়দা শেখানো হয়, তার নামে চলে গালাগালি, নানান কিছু করতে বাধ্য করা। আজ দ্বিতীয় বর্ষ সিটিং দিলো, তো কাল তৃতীয় বর্ষ, পরশু চতুর্থ। ছেলেদের হলে নিয়ম করে রাত জাগিয়ে নানান কিছু করতে বলা হয়। না করলে বা পারলে অসংখ্যবার কান ধরে উঠবস করানো থেকে কার্নিশে ঝুলে থাকতে বাধ্য করা হয়। হল থেকে পত্রিকায় উঠে আসে শিক্ষার্থীদের অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর। হলের বাইরে এইসব শিক্ষার্থীদের একসাথে নিয়ে যাওয়া হয়, বাধ্য করা হয় মেয়েদর হলের সামনে গিয়ে অশ্লীল গালাগালি করতে।

আমার বিভাগে এই বিষয়ে এক শিক্ষার্থীর করা গবেষণা প্রতিবেদন আছে, কেউ চাইলে দেখতে পারেন সেটা। এবছর প্রথম ক্লাসের পরদিন এক ছাত্র আমার কাছে এসে জানতে চায় কীভাবে সে তার এইচএসসি এসএসসির (ভর্তির সময় এইগুলো জমা রাখা হয়) সার্টিফিকেট ফেরত পেতে পারে। কারণ জানতে চাইলে বললো, ‘আমি এইখানে পড়বো না, এইখানে অত্যাচার হয়’। আগের রাতে সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল অত্যাচারে।

আমার/আমাদের ‘এই জাহাঙ্গীরনগরের’ গল্পের কী হবে আফসানা? এ প্রশ্নও করা দরকার, রেজিমেন্টশন প্রক্রিয়া কতোটা তীব্র? একটি মাত্র মেয়ে অভিযোগ করে  পালিয়ে থাকতে বাধ্য হয় কেন? কেন এই বছরের নিপীড়িত পরের বছরের নিপীড়ক হয়ে উঠে? কীভাবে একটা অপরাধমনস্কতা সাধারণ সম্মতি পেয়ে যাচ্ছে?

আফসানা যেসবের বর্ণনা দিয়েছেন, তাকে ইংরেজী ভাষায় bullying বলে। ক্যামব্রিজ ডিকশেনারী অনুযায়ী bully অর্থ – নিজের তুলনায় আকারে ছোট, বা ক্ষমতাহীন কাউকে কেউ আঘাত করা, আতংকিত করা। কখনও ঐ ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বাধ্যও করা হতে পারে। পাশ্চাত্যে এইগুলো সাধারণত স্কুলে ঘটে। যদিও আমাদের দেশে ঘটছে বিশ্ববিদ্যালয়ে!

লেখক নিজ পরিবার থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারে এসেছিলেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু পরিবারের ধারণা কবে থেকে এত মহান হলো? এখানেই না রীতির কথা বলে পুরুষটি হয় কর্তা, নারীকে হতে হয় গৃহিনি, মানে উদয়াস্ত গৃহকর্মের দায়িত্ব নারীর, পুরুষের কাজ খবরদারীর। পরিবার শিশু পালন ও নিরাপত্তার দায় নেয় বটে, তবে আবারো মায়া মমতার ও যত্নের ভার নারীরই। আবার এইখানেই তো কন্যা ও পুত্রের জন্য দ্বি-নীতি দেখা যায়। পরিবারে চর্চিত অসমতার ইয়ত্তা নেই। আর বিশ্ববিদ্যালয়কে (বা রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে) ক্যামনে আমরা পরিবার ধারণার এক্সটেনশন ভাবি? তাহলে তো nepotism বা চাচা-মামার দৌরাত্মের ধারণা বৈধতা পেয়ে যায়!

বিশ্ববিদ্যালয় তো স্বতস্ফুর্ততার জায়গা, স্বাধীন চিন্তার জায়গা। নতুন প্রশ্ন করবার জায়গা। এমন কি এইখানকার খুদে থেকে বড় চিন্তক কারোরই এস্টাবলিস্ট ধারণাকেও ছাড় দেওয়ার কথা না। পরিবারের ধারণা ব্যবহার করে ‘পারিবারিক’ ক্ষমতা চর্চার নর্ম পুনঃ পুনঃ জারি রাখলে আর যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয় বলে আর কোন প্রতিষ্ঠান থাকে না।

লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন: