শারমিন জান্নাত ভুট্টো: পশুসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হক একেবারে যথার্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। তাকে তো আর মানুষের পর্যায়ে রাখা যাচ্ছে না। যে ব্যক্তি অন্যের বিপদে-দু:সময়ে গালি দেন, অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেন, সে আর যাই হোক, মানুষ হতে পারে না।
তবে এ লোকটি গালিগালাজ করেও সাংবিধানিক পদে কীভাবে এখনো টিকে থাকেন, ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সবার সামনে হেয় করা এবং মৌলবাদী ও নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে তড়িৎ অ্যাকশন না নেয়ার কারণে ‘ছায়েদুল’ সাহেবকে অবিলম্বে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া উচিত ছিল সরকারের। কারণ দেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসকে উস্কে দেয়ার জন্য ‘ছায়েদুলে’র মতো একজনই যথেষ্ট। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মুখে অসাম্প্রদায়িকতার বুলি ফোটালেও ভেতরে ভেতরে অধিকাংশই সাম্প্রদায়িক। আর একারণেই কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না ‘ছায়েদুল সাবে’র বিরুদ্ধে।
এদিকে আরেকটি পক্ষ আবার তার হয়ে সাফাই গাইতে শুরু করেছে, যেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মতো অবস্থা বরণ করতে না হয়। বেশি দিন আগের কথা না যখন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী হজ নিয়ে একটি মন্তব্য করে বেমালুম ফেঁসে গিয়েছিলেন। তখন তার মন্তব্যের পর আমাদের দেশের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলের আঁতে ঘা লেগেছিল। তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল লতিফ সিদ্দিকীর ওপর। তখন কীভাবে যেন সবগুলো দল নিজেদের মধ্যকার মতপার্থক্য, মতাদর্শ ভুলে ধর্মপ্রাণ মুসলমান হয়ে গিয়েছিলো।
শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কে কাকে খাঁটি আর সাচ্চা মুসলমান হিসেবে জাহির করবে তার প্রতিযোগিতা চলেছিল রীতিমতো। এখন লতিফ সিদ্দিকী যদি তার মন্তব্যের কারণে এদেশের দণ্ডবিধিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় অভিযুক্ত হতে পারেন, আর তার মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেয়া হয়, তাহলে সেই একই আইনের প্রয়োগ কেন হবে না ‘ছায়েদুল’ সাহেবের ক্ষেত্রে? নাকি সংখ্যালঘুদের গালি দিলে তা কোনো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না? সংখ্যালঘুরা আসলে মানুষের কাতারে পড়ে কী না, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে! এখন অনেকেই বলবেন লতিফ সিদ্দিকী যেভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আঘাত দিয়েছেন তার জন্য ওই শাস্তিই উপযুক্ত ছিলো। সেই বিতর্কে না গিয়ে আমার মতো অধম একটিই প্রশ্ন করবে আপনাদের, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরই কি শুধু অনুভূতি আছে, ধর্মপ্রাণ অমুসলিমদের সেই অনুভূতি নেই?
মজার বিষয় হচ্ছে, লতিফ সাহেবের মন্তব্যের পর তেলে-বেগুনে ফুঁসে উঠেছিল বিএনপি নামক উচ্চমার্গীয় দলটিও। তারা তো আরো একধাপ এগিয়ে এসে বলা শুরু করেছিল যে, লতিফ সাহেব দেড়’শ কোটি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছেন। কথাটা শোনার পর মনে হচ্ছিল টর্নেডো নামক কোনো তুফানের কথা বলা হচ্ছে। যাই হোক, এ বিএনপিই কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই সংখ্যালঘুদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। এরাই ‘৭১ এর রাজাকারদেরকে মন্ত্রী বানিয়েছে, গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছে। আর জামাতের আসল চেহারাও স্পষ্ট হয়েছিলো একাত্তর সালে।
আসলে দিনশেষে সব রাজনৈতিক দল আর নেতাদের একই চেহারা। মুখোশ পরে সবাই অসাম্প্রদায়িক হওয়ার ভান করে। আওয়ামী লীগের মতো দল যদি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতার চেতনায় গড়ে ওঠা দল হয়, তাহলে এখনই সাম্প্রদায়িক কীট ‘ছায়েদুল’ হককে অপসারণ করে প্রমাণ করুক তাদের মাঝ থেকে চেতনা ও মনুষ্যত্ব এখনও কর্পূরের মতো উড়ে যায়নি। লতিফ সিদ্দিকী তার মন্তব্যের মাধ্যমে অন্যায় করে থাকলে একই ধরনের অন্যায় ‘ছায়েদুল’ হকও করেছেন। আইন সবার জন্যই সমান হওয়া উচিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার পর যখন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতা নিয়ে সবাই প্রশ্ন তুলছে তখন নাসিরনগর থানার ওসিকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। অভিযোগ –সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার পর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেয়া। অথচ সেই ওসির হয়েই প্রত্যাহার আদেশ বাতিল করে পুনরায় তাকে বহাল রেখেছেন মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী। বাহ, তালিয়া, আপনার জন্য একরাশ ধুতুরা ফুল, যদিও কাঁঠাল পাতা দিলেই বেশি মানানসই হতো।

আরেকটি কথা মনে না করিয়ে দিলেই নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সুন্নতে আহলে জামাত ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে একটি সমাবেশ করে, যেখানে ওসি কাদের ও ইউএনও চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমেদও বক্তব্য রাখেন। আর তাদের সমাবেশের পরই সংখ্যালঘুদের ওপর তাণ্ডবলীলা চালানো হয়।
ওসি এবং ইউএনও কোন এখতিয়ারে এ ধরনের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন আর ঘটনার পর স্ব স্ব পদে বহাল তবিয়তে থাকেন, তা জানতে মন চায়। তাহলে তো এখন বলা যেতেই পারে নাসিরনগরে আসলে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদেই হামলা চালানো হয়েছিল!
প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আর মন্ত্রী মহোদয়ের আশকারাতেই মৌলবাদীরা সাহস পাচ্ছে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করার। মন্ত্রী ‘ছায়েদুল’ ক্ষমতায় থেকেও যেহেতু কোন অ্যাকশন নিতে পারেননি, উল্টো সংখ্যালঘুদের গালি দিচ্ছেন, তাই এখন আপনারাই বলেন, “ছ” তে ছাগল বলবো নাকি…………..।