আমি নিজেও যখন সংখ্যালঘু

তামান্না ইসলাম: বছর ১০-১২ আগে অফিসের কাজে ক্যালিফোর্নিয়া গিয়েছি কানাডা থেকে। আমার এক বন্ধু আমাকে লস এঞ্জেলেস ঘুরে দেখাচ্ছে। মালিবু বীচের পাশ দিয়ে গাড়ি চলছে ঝড়ের গতিতে। গাড়ি চালাচ্ছে এক অপরিচিত ছেলে, আমার বন্ধুর বন্ধু। কম বয়সী ছেলে, রক্ত গরম। গাড়ির স্পিড নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো পাশের এক গাড়ির সাথে, সেই গাড়িতে কিছু এদেশীয় ছেলে। এক পর্যায়ে পাশের গাড়ির এক ছেলে জানালা দিয়ে বন্দুক বের করে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করলো, ‘পাকিস্তানি ফকির, নিজের দেশে ফেরত যা, আমাদের এখানে কী  চাস?’

prison-newsআমার পরনে ছিল সালওয়ার-কামিজ, তাই আমরা তিনজনই ‘পাকিস্তানি ফকির’। আমি আজও চোখ বুজলে সেদিনের সেই রক্ত হিম করা হুমকি শুনতে পাই, চোখে  ভাসে সেই উদ্যত বন্দুক।

গত বছর মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ছি, খুব সুন্দর একটা শান্তির পরিবেশ, মনটা অন্য রকম হয়ে যায়। হঠাৎ মেয়েদের মধ্যে ফিস ফিস আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো, মসজিদের সামনে কিছু ছেলেকে বন্দুক হাতে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। মেয়েদের রুমের বড় জানালাগুলোকে কোনরকমে ঢাকা হলো।

কীসের নামাজ, কীসের কী? কোনরকমে বাড়ি যেতে পারলেই বাঁচি। আসার পথে বরকে ভয়ে ভয়ে বলছিলাম, ‘সামনের কয়েক সপ্তাহ জুম্মার নামাজ অন্য কোথাও পড়া যায় না?’   

কয়েক মাস আগে ফ্রান্সে যাবো বেড়াতে পরিবার নিয়ে। ফ্রান্সে বেশ কিছুদিন ধরেই ঝামেলা চলছে, মুসলিম এবং নন-মুসলিমদের ভিতরে। হিজাব পরা মেয়েদেরকে অনেক আপত্তিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বাইরে গেলে সাধারণত আমি একটা ছোটখাটো ঘোমটা দেই, বিশেষ করে ঠাণ্ডায় ভালো কাজ দেয়। হিজাব না হলেও সেটাকে যদি কেউ হিজাবের দলে ফেলে দেয়, যদি অপমান করে, যদি আক্রমণ করে! দরকার নেই বাবা এতো ঝামেলায় যেয়ে। আগে তো প্রাণ বাঁচাও, ঘোমটার আপাতত ছুটি।

আর মাত্র কয়েকদিন পরে আমেরিকায় ইলেকশন। এই বারের ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, তারপরও ইমিগ্রান্ট বিশেষ করে যাদের চৌদ্দগোষ্ঠির মধ্যে মুসলিম এর ‘ম’ ও আছে, সবাই কায়মনো বাক্যে চাচ্ছে যেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প না আসে, কারণ আতঙ্ক, ‘সে আসলে আমাদের সংখ্যালঘুদের কী হবে, সব মুসলিমদের নাকি তাড়িয়ে দেবে?’  

ছোট বাচ্চাগুলো পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে, আমাদেরকে কী আমেরিকা থেকে চলে যেতে হবে, যদিও জন্মসূত্রে তারা অনেকেই আমেরিকার নাগরিক।

বাংলাদেশে অবস্থানকারী মুসলিম ভাইদের বলছি, সংখ্যাগুরুর আত্মগরিমায় মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিয়ে আপনারা কেউ কেউ সংখ্যালঘুদের সাথে যা করছেন, ভুলে যাবেন না আপনার সন্তান , ভাই, বোন দেশের বাইরে সেই সংখ্যালঘু হয়ে সংখ্যাগুরুর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। একবার ভাবুন, ‘আমি যখন সংখ্যালঘু, আরও ভাবুন, যদি নিজের দেশে, নিজের মাটিতে আমি হই সংখ্যালঘু, ………। ‘

শেয়ার করুন: