শান্তা মারিয়া: ‘এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে রাখিবন্ধনের আয়োজন করা। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, গারো, চাকমা, সাঁওতাল, মুন্ডাসহ যত সম্প্রদায় রয়েছে সকলের মধ্যে সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে রাখিবন্ধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে দেশের সর্বত্র। এবং পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার বাংলাভাষী জনগণের মধ্যেও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন বাড়াতে হবে। আমরা একই মহান সংস্কৃতির ধারক, এটা আবার সবাইকে মনে করিয়ে দিতে হবে। একমাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলনই পারে সাম্প্রদায়িকতাকে রুখতে।’
কথাগুলো বলছিলেন কমরেড তকীয়ূল্লাহ তাঁর নব্বইতম জন্মদিনে। ৪ নভেম্বর এই প্রবীণ কমিউনিস্টের জন্মদিনে তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এবং নাসিরনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা প্রসঙ্গে।
কমরেড তকীয়ূল্লাহ গুরুতর অসুস্থ এবং দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন কয়েক বছর হলো। কিন্তু নিজের শারীরিক কষ্ট বিষয়ে তাঁর কোনো অভিযোগ নেই। বললেন, ‘বয়স হয়েছে, শরীর তো ভেঙে পড়বেই। আমার জন্মদিন বা শারীরিক কষ্ট কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পড়ছে এটা খুবই গুরুতর বিষয়। এটা অবশ্যই পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে। স্বাধীনতার এত বছর পর যদি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলা হয় তাহলে সে লজ্জা আমাদের দেশের প্রত্যেকের। এটা পাকিস্তান আমলের গালি। এর আগে এই শব্দটা তেমন প্রচলিতও ছিল না। পাকিস্তানিরা ইচ্ছাকৃতভাবে বাঙালিদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ করার জন্য এই শব্দটা ব্যবহার করতো। এই ধরনের আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। প্রশাসনের উচিত ছিল সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এটা তারা করতে পারেনি। এই ব্যর্থতার জন্য তাদের কড়া শাস্তি দেওয়া দরকার। ’
এই তকীয়ূল্লাহ আমার বাবা। আমার নব্বই বছরের দৃষ্টিহীন বৃদ্ধ বাবা যে সত্যটি বুঝতে পারছেন, সেটা কি সরকার বা দেশের কর্তা ব্যক্তিরা বুঝতে পারছেন না?
আমার এখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, বাংলাদেশটা কার? এই দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মতো মহান দার্শনিককে। এদেশের জন্য শহীদ হয়েছেন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রণদা প্রসাদ সাহা, নূতন চন্দ্র সিংহ এর মতো অনেক মহান ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতার এতো বছর পর এখন কি চিন্তা করতে হবে তাঁরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন কিনা! এদেশের অসংখ্য বধ্যভূমিতে হিন্দু-মুসলমানের রক্ত কি একই সঙ্গে প্রবাহিত হয়নি? একই জন্মভূমির মাটিতে কি তাঁদের শবদেহ পড়ে থাকেনি? হিন্দু ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা কি একই সঙ্গে একই ঘাতকের হাতে প্রাণ দেননি? পাকিস্তানি পিশাচরা যখন ঘরে ঘরে ঢুকে আমাদের হত্যা করেছে, তখন তো তারা মুসলিমকে রেহাই দিয়ে হিন্দুদের হত্যা করেনি; তারা বাঙালি মাত্রকেই হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে, নির্যাতন করেছে। তারা তো হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাইকে ‘মালাউন’ বলে গালি দিয়েছে। তাহলে এতো বছর পর আমাদের মধ্যে এই বিভেদের বিষাক্ত কাঁটাগাছ কোথা থেকে গজাচ্ছে?
আমার মনে পড়ছে এই শব্দটি আমি কবে প্রথম শুনলাম। বাড়িতে তো শোনার প্রশ্নই ওঠে না, স্কুলেও কখনও শুনিনি। আমার বাবার বন্ধু কমরেডরা প্রায়ই বাড়িতে আসতেন। সন্তোষ গুপ্ত, অনিল মুখার্জি, ননীবাবু, মোহাম্মদ সুলতান- কখনও তো মনে হয়নি তারা হিন্দু না মুসলমান। বিশ্ববিদ্যালয়রপড়ুয়া আমার বড় ভাইয়ের বন্ধুরা বাড়িতে আসতেন। সুশান্তদা, শংকরদা, কাজলদা, খুশিদা, সন্তোষদা। ভাইয়ার সেরা বন্ধুরা তো সব হিন্দু সম্প্রদায়েরই ছিলেন। কিন্তু কখনও তো তাদের আলাদা করে দেখিনি, চিন্তাও করিনি। তাহলে এখন কেন এমনটা ভাবতে হচ্ছে? হঠাৎ করে কেন আমরা নিজেদের মধ্যে একটা আলাদা কিছু দেখতে পাচ্ছি?
স্বাধীন বাংলাদেশে এই বিষবৃক্ষ বপন করেছিল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং স্বৈরশাসক এরশাদ। সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং পরে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম জারি করে আঘাত করা হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে।
আমার মনে পড়ে, বাবরি মসজিদ ভাঙার সেই সময়ই প্রথম আমি ‘মালাউন’ শব্দটি শুনি। আমার এক বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করে ‘মালাউনদের সাথে তোর এতো খাতির কেন?’ কথাটি বাড়িতে এসে বাবাকে বলাতে তিনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘এই শব্দটি আর কখনও উচ্চারণ করবে না। মালাউন, মোসলা, নমু, নেড়ে ইত্যাদি শব্দ দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিভেদ করার জন্য, অপমান করার জন্য খারাপ মানুষরা বলে। আমরা মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য করবো না, নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য করবো না, ধনী-গরীবেও নয়।’
বাবরি মসজিদের সেই ঘটনার পরে নিজের চোখেই দেখলাম কীভাবে সাম্প্রদায়িক গুজব ডালপালা মেলে এবং কী কৌশলে সেটা ছড়ানো হয়। ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙা এবং সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নজির তুলে ধরে ঢাকার শাঁখারি পট্টি, বনগ্রাম লেনসহ বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো নেকড়েরূপী কিছু মানুষ।
কোথায়, কোন দেশে কী ঘটেছে তা জেনে বা না জেনে কিভাবে নিজের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষ? যে কখনও জীবনে হয়তো বাবরি মসজিদের নামও শোনেনি সেটা ভাঙার মাশুল তাকে দিতে হচ্ছে জীবন দিয়ে।
সেসময় আমাদের আলুবাজারের বাড়িতে পরিচিত কয়েকজন আশ্রয় নিলেন। মহল্লার মানুষ আমাদের বাড়ি ঘেরাও করলো। আমাদের টিনের গেট ভাঙে ভাঙে অবস্থা। বাবা খুব শান্তভাবে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে। তার সঙ্গে দাঙ্গাবাজদের কথোপকথনটা হলো অনেকটা এরকম।
-হিন্দুরা মসজিদ ভেঙেছে, আপনি তাদের আপনার বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন।
-মসজিদ ভেঙেছে? বলেন কী, সাংঘাতিক কথা। কোন মসজিদ ভেঙেছে? আলুবাজারের বড় মসজিদ না ছোট মসজিদ? (এই মহল্লায় দুটিই মসজিদ) কই মসজিদ তো ভাঙা দেখছি না।
– আরে আমাদের মসজিদ না।
-তাহলে? বায়তুল মোকাররমের মসজিদ ভেঙেছে? এটাও তো খুব খারাপ কথা।
-আপনি কি কোনো খবর রাখেন না? বাবরি মসজিদ ভেঙেছে হিন্দুরা।
-বাবরি মসজিদ? সেটা কোথায়? ঢাকায়? আমি তো ঢাকার এরকম কোনো মসজিদের নাম শুনিনি।
-আরে মিয়া, ঢাকায় কেন হবে? বাবরি মসজিদ ইন্ডিয়ায়।
-ও, ইন্ডিয়ায়? তাহলে ইন্ডিয়ায় যান, সেখানকার হিন্দুদের বিরুদ্ধে যা ব্যবস্থা নেয়ার নেন। আমাদের এই হিন্দুরা তো আর ওইখানে গিয়ে মসজিদ ভাঙেনি।
এইসব কথাবার্তার তালে শেষ পর্যন্ত লোকগুলো লজ্জা পেয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল সেদিন।
২০০১ সালে নির্বাচনের পর আবারও দেখা গেল হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটপাটের সেই পুরনো কৌশল।

রামুর ঘটনায় আমরা দেখলাম এবার গুজবের দানব ফেসবুকের উপর ভর করেছে। নাসিরনগরেও একই কৌশল ব্যবহার করে ছড়ানো হয়েছে গুজব। আর গুজবের পাখায় ভর করে মানুষের বসতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হায়নার দল।
কিন্তু একটা বিষয় আমাকে ভাবায়, সেটা হলো আমাদের দেশের অনেক মানুষের মনের ভিতর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের একটা দানব নিশ্চয়ই ঘাপটি মেরে আছে। যে কোনো সুযোগে বোতল খুলে সেই দৈত্য বেরিয়ে আসে। যদি মনের ভিতরে বিদ্বেষের রাক্ষস ঘুমিয়ে না থাকতো, তাহলে তো গুজবের খোঁচায় তার জেগে ওঠার কথা নয়।
তাহলে বলতে হয়, এদেশের প্রচুর সংখ্যক মানুষ ভিতরে ভিতরে সাম্প্রদায়িক। তারা অনেকেই অগোচরে হিন্দুদের ‘মালাউন’ বলে সম্বোধন করে। তারা মুখে যতই উদারতা দেখাক অনেকেই গুজবে কান দিয়ে লাফিয়ে ওঠে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ভাংচুরে এবং তলে তলে তাদের উদ্দেশ্য হলো সংখ্যালঘুর সম্পত্তি দখল করা। এদের মধ্যেই এখন আমাদের মূল কাজ সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনা করা উচিত। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশে এই ঘাপটি মারা সাম্প্রদায়িকদের ভিড়ে এখন আামি এবং আমাদের মতো মানুষরাই হয়ে পড়ছি সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু।
আমরা যারা ঈদের দিনে সেমাই খাই, নতুন কাপড় নেই, রোজা রাখি, নামাজ পড়ি, আবার মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পূজার মণ্ডপে, রথের মেলায় কীর্তনের আসরে, প্রবারণায় ফানুস উড়াতে, ক্রিস্টমাসে গাছ সাজাতে উৎসাহ নিয়ে অংশ নেই, কিংবা যারা হিন্দু হয়ে পূজা করা সত্ত্বেও মুসলমান বন্ধুদের সঙ্গে ইফতার খাই, মহরমের মেলায় যাই অথবা আমরা যারা বৈসাবিতে আনন্দ করি এবং যারা নারী-পুরুষের ও সব মানুষের সমঅধিকারে বিশ্বাস করি সেই আমরাই ক্রমশ সংখ্যালঘু হয়ে গেছি।
আমরা যারা একসময় বাম রাজনীতিতে মনেপ্রাণে বিশ্বাস রেখেছি, আমরা যারা সাম্প্রদায়িকতার তিলমাত্রও অন্তরে পোষণ করি না সেই আমরাই সংখ্যালঘু। আমরা যারা সেবিকা দেবনাথ এবং পারভীন সুলতানাকে একই রকমভাবে নিজের বোন মনে করি সেই আমরাই সংখ্যালঘু।
আমি এবং আমরা সংখ্যালঘু হয়েছি জন্মমুহূর্তে পরিবার থেকে, সংখ্যালঘু হয়েছি নিজস্ব অর্জন লেখাপড়া থেকে, সংখ্যালঘু হয়েছি সেইদিন থেকে, যেদিন থেকে আমরা হিন্দু বা মুসলমানের চেয়ে মানুষ হয়ে উঠেছি।
আমরা আমাদের দেশে আর একটিবারের জন্যও ‘মালাউন’ শব্দটি শুনতে চাই না, তাই আমরা সংখ্যালঘু। যেদিন আমরা এবং আমাদের মতো মানুষরা বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু হয়ে উঠতে পারবো, একমাত্র সেদিনই বাংলাদেশকে আামরা সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক বলতে পারবো। সেদিন কত দূরে? আর কতদিন আমাকে সংখ্যালঘু হয়ে থাকতে হবে?