নারীর নিরাপত্তায় আরও একটি যুদ্ধ দরকার এখন

আসমা আক্তার সাথী: লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে রে পূজা। তোর সামনে এই মুখ নিয়ে কেমন করে আসি। যে দেশে আমার পাঁচ বছরের মেয়ে নিরাপদ নয়, সে দেশে কেমন করে বাঁচি! নিজের পাঁচ বছরের মেয়ের কথা ভেবে ভেবে আমি এখন শঙ্কায় মরি। ৩০ লাখ শহীদ আর অগণিত মা বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে এ কোন দেশ আমরা পেলাম যেখানে পিতার কাছে সন্তান নিরাপদ নয়। বড় আব্বা বলে ডাকতো পূজা। আহা পূজা! প্রবাদ আছে না, কুকুরের পেটে কি ঘি হজম হয়! ওই নরপিশাচ তো তোর এই ডাকের উপযুক্তই ছিল না।

stop-rape-2পরিবারকে এখন থেকে সম্পর্ক এবং সম্বোধন ঠিক করার আগে হাজার বার ভাবতে হবে। যাকে তাকে বাবা বানিয়ে ডাকানোর কোন প্রয়োজন নেই। কারণ এতে ভরসা বেড়ে যায়। আপন বাবাই যেখানে মা মরলে তাওই হয়ে যায়, রক্তের সম্পর্কের উপরেই যেখানে এখন আর ভরসা করা যায় না। সেখানে এরূপ পাতানো সম্পর্ক বড়ই ঠুনকো। সমাজের প্রতিটি স্তরে এই বিষয়গুলোকে বোঝাতে হবে। স্কুল-কলেজে কেবল উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য উপবৃত্তি দিয়ে কোন লাভ নেই। এখন আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে কন্যা সন্তানকে এক সেকেন্ডের জন্যও চোখের আড়াল করা যাবে না।

কাকে আর নসিহত করব রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্র প্রধানকে, রাষ্ট্রযন্ত্র চালনাকারীদেরকে, সমাজকে, অপরাধীকে, দেশের আইন ব্যবস্থাকে, আইন প্রয়োগকারীকে না আইন প্রণেতাকে না পরিবারকে। বুঝি না, আমার দিশেহারা লাগে। নসিহত করেই বা কি হবে, আর নসিহত করার অধিকারই বা আমার কতটুকু?

এবার মনে হয় নিজ দেশের পরাধীনতা থেকে মুক্ত হবার জন্য আর একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে হবে নারীদেরকে। যেখানে ভদ্রবেশী নরপিশাচদের কোন প্রয়োজন নেই। আসুন মা বোন মেয়েরা আমরা আর একটি যুদ্ধ শুরু করি ধর্ষণমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য। সত্যিকারের যুদ্ধ। কারণ ভালবাসা এবং যুদ্ধে নাকী সবই সঠিক। সভা, সেমিনার, মিছিল, মিটিং, লেখালেখি এসবে কিছুই হবে না আর। নীতি নির্ধারকেরা এসব কিছুকেই তামাশা মনেকরে আর আড়ালে হাসে। কখনও কখনও সে আইনকে হাতে তুলে নিতে হয়, যে আইনের কারণে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। দেখেন, ওবায়েদুল, বদরুল, এবার সাইফুল সবাই ওই কারাগারে বন্দী হয়েই শেষ, বেশ আছে। আদালত পাড়ায় তারিখ ঘুরে আসতে আসতে আসামী কারাগারে বিনা পরিশ্রমে খেয়ে-দেয়ে বেশ তরতাজাই থাকে।

stop-rapeজলে চুন তাজা, তেলে চুল তাজা। প্রচলিত এই বাণীর বদলে এখন দেখছি কারাগারে আসামী তাজা, বাইরে বাদী রোদে ভাজা। তাই এমন হলে কেমন হয় যে আসামীকে আর কারাগার পর্যন্ত যেতেই দেয়া না হোক। তার আগে আমরা যারা জনগণ আছি তারা গণধোলাই দিয়ে ওর অণ্ডকোষ পিষে হাত-পা ভেঙ্গে গুড়ো করে তারপর মেরে দেই। একজনে মারলে দোষ হবে, কিন্তু একশ জনে মারলে দোষ হবে না।

আমি জানি আমার এই প্রস্তাব অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না, বিশেষ করে যারা সম্পাদীয়কেতে লিখে যে, ঘরে বসে যা লেখা যায় বাস্তবে তা করা যায় না। যেমন খাদিজাকে, রিশাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি, কারণ তাদেরও প্রাণের ভয় ছিল।

আমি হলফ করে বলতে পারি আমরা কেউ কেউ আছি যারা শুধু লেখি না, বাস্তবেও মানুষের বিপদে এগিয়ে আসি। যখন যেমন ঘটনা ঘটে, তখন তেমনভাবে। আমার আশেপাশে যারা আছে তারা জানে। সুতরাং লেখকরা একে অপরকে দোষারোপ না করে আসুন নিজেরা সংগঠিত হই। স্কুলে, কলেজে, পাড়ায়, মহল্লায়, চায়ের দোকানে, কাবে, স্কুলে অপেক্ষারত অভিভাববকদের কাছে বা যেখানে সবাই একত্রিত হয় সেখানে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাই। শুধু লিখে কোন কাজ হবে না। কারণ সবাই পড়তে জানে না।

তবে টেলিভিশন একটা বড় মাধ্যম এক্ষেত্রে হতে পারে। কারণ ৯৯.৯৯ ভাগই শুনতে পারে এবং বস্তি থেকে শুরু করে চর অঞ্চল সব মানুষই টিভি খবর দেখে। কিন্তু আমাদের টিভিওয়ালারা ইস্যুতে নন ইস্যুতে টকশো করতে যতটা আগ্রহী, খবরের শুরুরদিকে পূজাদের জায়গা দিতে ততটাই অনাগ্রহী। সে জায়গার অনেক দাম। বিজ্ঞাপন কী এমনি এমনি আসে!

পূজাকে নিয়ে কয়টা লিড স্টোরি হয়েছে বলুন তো? মরে গেলে হয়তো হবে, হয়তো হবে না। একটি দুধের শিশু যে দেশে ৪৫ বছরের জানোয়ারদের দ্বারা ১৮ ঘন্টা ধরে ধর্ষিত হয়, সে দেশে টিভিওয়ালারা পারলো না মূল খবরে যাবার আগে ধর্ষকের বিচার না হওয়া পর্যন্ত প্রথমেই বিশেষ খবর হিসেবে পূজাকে নিয়ে স্টোরি করতে!

sathi-3
আসমা আক্তার সাথী

এ দেশে গণমাধ্যম বলেন আর আইন বলেন সব ওই একই কাতারে। এ দেশে খবর পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। নীতি নির্ধারণী পর্যায়েও আছেন দু’ এক জন। সবাই স্ট্রাইক করুন, পূজার ধর্ষণকারীর বিচার না হওয়া পর্যন্ত পূজার স্টোরি ফার্স্ট লিড হতে হবে। নইলে আমরা খবর পাঠ করবো না, বা কাজ করবো না। খবরের মানবিক গুরুত্ব বুঝতে হবে।

আমার এমন দাবি শুনে আমাকে অনেকে উপহাস করবে জানি, কিছু আসে যায় না। আমরা ঘন্টায় ঘন্টায় কেবল আওয়ামী লীগ আর বিএনপির নেতা-নেত্রীদের চেহারা দেখার জন্য আর একে অপরকে দেষারোপ করে বক্তৃতা শোনার জন্য টিভি দেখি না।

বিভিন্ন টিভি পরিবার যেমন আমাদেরকে ঈদ মোবারক জানান, তেমন করে টিভি পরিবারের পক্ষ থেকে পূজার ধর্ষকের বিচারের জন্য ৩০ সেকেন্ডের একটি প্রচারণা চালান তো দেখি। বাংলাদেশ জিতলে অমুক টিভি পরিবারের পক্ষ থেকে অভিনন্দন, তমুক টিভি পরিবারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। কিন্তু পূজার জন্য কোন টিভি পরিবারের পক্ষ থেকে সমবেদনাটুকু পর্যন্ত জানাতে দেখলাম না।

মাথা খারাপ কেমন করে জানাই। সব কুল ঠিক রাখতে হবে যে। উহু রাষ্ট্রপ্রধানকে তো রাগানো যাবে না। আগে তার গতিবিধি দেখি, বুঝি তারপরে নাচি।

পূজা মা তোকে আমরা অনেকে দেখতে যেতে চাই, অনেকে তোর বাবা-মায়ের সাক্ষাতকার নিতে যায় ১০ নম্বর স্টোরি করার জন্য। তুই লোক দেখে ভয় পাচ্ছিস, তুই ভয় না পেয়ে আমাদের মুখে থু থু দে। কেন আমরা সাইফুলদের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামি না?

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক।

শেয়ার করুন: