তৃষ্ণা হোমরায়: ৩০ অক্টোবর দিনটা শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্ট জয়ের আনন্দ নিয়ে। ঢাকায় বসে আমরা যখন আনন্দ উদযাপন করছি, উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে আমাদের ফেসবুক ওয়াল, ঠিক তখনই কিছু বাড়তি অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ(!) ঝাঁপিয়ে পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর।
ওই এলাকার একটি হিন্দু ছেলে ফেসবুকে মুসলমানদের পবিত্র কাবা ঘর নিয়ে ছবি পোস্ট করার পরই শুরু হয় তান্ডব। যদিও ছেলেটি ফেসবুকে বলেছে কেউ তার আইডি হ্যাক করে অথবা ফেসবুক খোলা পেয়ে এমনটি করেছে। সেই সাথে এ ঘটনার জন্য সে ক্ষমাও চেয়েছে। কিন্তু তা কেন শুনবে এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠরা? তাদের যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে! তাই হামলা চালিয়েছে মন্দিরে, ভাঙ্গচুর করেছে প্রতিমা। এখানেই শেষ নয়, আক্রোশ মেটাতে তছনছ করেছে হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, লুটপাট করেছে তাদের অর্থ-সম্পদ। পিটিয়ে আহত করেছে অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষকে।
এলাকাবাসী বলছে, শনিবার রাতেই ফেসবুকের ঘটনাটি প্রচারের উদ্দেশ্যে পুরো উপজেলায় মাইকিং করে সভা ডাকা হয়। এটা কি উস্কানির আওতায় পড়ে না? তাহলে প্রশাসন কেন কোন প্রতিকার বা প্রতিরোধ করেনি। শুধু তাই নয়, পরদিন প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বিক্ষোভ সমাবেশ ডেকেছিলো। আর ওই বিক্ষোভে যোগ দেয়া লোকজনই হামলায় অংশ নেয়। প্রায় দেড়-দুই ঘন্টা ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর তান্ডব চললেও প্রশাসন বলেছে তারা নাকি এমন খবর জানে না ।
প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে সমাবেশটি ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাতের অভিযোগকে কেন্দ্র করে ডাকা হয়েছিল এবং এজন্য প্রশাসনের কাছ থেকে আগাম অনুমতিও নেয়া হয়েছিল, তাহলে কেন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? প্রশাসন কি জানে না এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কী ঘটেছিল?
সংবাদকর্মীদের এলাকাবাসী জানিয়েছে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতকে প্রতিবাদ সভার অনুমতি দিয়ে উপজেলা প্রশাসন মাঠে ছিল না। আর এটি দুষ্কৃতকারীদের নির্বিঘ্নে দিনভর মন্দিরে হামলাসহ লুটপাটের সুযোগ করে দেয়। এর মানে কি দাঁড়ায়? তাহলে কি ধরে নিতে হবে আমাদের প্রশাসনে দূরদর্শী-অভিজ্ঞ লোকের অভাব রয়েছে? নাকি কোন বিশেষ পক্ষকে সুযোগ করে দিতেই এমনটি করা হয়েছে?
অবশ্য সোমবার উপজেলা প্রশাসন একটি শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ করেছে। উনাদের হয়তো মনে হয়েছে এমন একটি সমাবেশ করলেই সম্প্রীতি জোড়া লেগে যাবে। একবারও ভেবে দেখেননি এই ফাটলের গভীরতা কতখানি। এ ঘটনা কতটা ক্ষতের সৃষ্টি করেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর মনে। অবশ্য এত ভাবাভাবিরই বা কী আছে?
বাংলাদেশে এটা তো আর নতুন কোন ঘটনা নয়। সাঁথিয়া, অভয়নগর, রামু থেকে নাসিরনগর…যারা এই ঘটনার শিকার শুধু তারাই জানে এর ব্যথা। অন্যদের কাছে যা শুধুই মাটির তৈরি মূর্তি, হিন্দু ধর্মাবলমম্বীদের কাছে সেটা প্রতিমা, মায়ের প্রতিচ্ছবি ।নিরাকার আর সাকার ব্রহ্মের ব্যাখ্যায় আর নাই বা গেলাম। এখনও চোখে ভাসছে দেহ থেকে খসে পড়া লক্ষী-নারায়ণ বিগ্রহের মুখ। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে আমার মায়ের মুখ। আর ভাবতে পারছি না। ধরবিহীন মূর্তিগুলো যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের অবস্থান।
যে আতঙ্ক, ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে ওই এলাকার মানুষের মনে তা কোন মলমে সারবে জানি না। ঘটনার পর এলাকার কোনো সাংসদ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। পিঠে হাত রেখে দুটো ভরসার কথাও শোনায়নি কেউ। অবশ্য ক্ষতিপূরণের ঘোষণা এসেছে। যদিও মঙ্গলবার পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো কোন ক্ষতিপূরণ পাননি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ধর্মের নামে উন্মত্ত কিছু মানুষ হিন্দুদের দেহ-মন-অর্থ সম্পদের যে ক্ষতি করেছে, সরকার কি এর সবটা পূরণ করতে পারবে?
এদেশে হিন্দুরা আক্রান্ত হয়েছে বার বার। এ যেন নিয়তি। নির্বাচন হলে, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের শাস্তি হলে, ফেসবুকে একজন কিছু লিখলে…এরকম যে কোন কারণেই এদের ওপর হামলা করা যায়। কারণ এ ধরণের ঘটনায় শাস্তি পাওয়ার ভয় নেই।