একজন ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবেই চ্যালেঞ্জটা নিচ্ছি

সুপ্রীতি ধর: উইমেন চ্যাপ্টার খুবই মামুলী একটা অনলাইন পোর্টাল। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত তাড়না থেকে কয়েকজন অখ্যাত লেখক এখানে লেখেন, নিজের ক্ষোভ জানান, নিজের কথা লেখেন। মনে শান্তি পান। মূলত এরকমই একটা প্লাটফর্ম হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে উইমেন চ্যাপ্টার। প্লাটফর্মটা গড়ার পিছনে সম্পাদক হিসেবে এটাই আমার সার্থকতা।

কিন্তু এই মামুলী পোর্টালও যে অসামান্য, আলোচিত হয়ে উঠতে পারে, তা গত কয়েক মাসের ঘটনাতে বেশ কয়েকবার প্রমাণিত হয়েছে। সেসব কথায় না যাই। নিজেদের গীত গাইতে এই লেখা না। দু:খের কথা শেয়ার করতেই আজ লিখছি। গতকাল এই পোর্টালে প্রকাশিত একটা লেখার জন্য একজন লেখকের পরিবারে তোলপাড় ঘটে গেছে।

attack-2লেখকের মা ঘুমাননি সারারাত, আত্মীয়স্বজনদের একের পর এক ফোন, বাবার প্রমোশন আটকে যাওয়ার আশংকা, ওপর মহল থেকে ক্রমাগত চাপ, অভিজিত রায়সহ ব্লগার-লেখকদের ওপর নেমে আসা খড়্গের কথা চিন্তা করে ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে পরিবারটি। তাদের একটাই কথা, তাদের মেয়ে খুবই শক্ত কথা লিখেছে, সত্য কথা লিখেছে, এই ‘সাম্প্রদায়িক’ সমাজে বেড়ে উঠতে গিয়ে বার বার বিপর্যস্ত হওয়ার কথা লিখেছে, কথা সত্য, কিন্তু সময়টা ভালো না, এসব কথা এইদেশে লেখা ঠিক না।

কাল রাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত উপুর্যপরি ফোন, শেষপর্যন্ত লেখাটা আমাকে তুলে নিতেই হলো……………..কারণ, লেখাটা একজন ‘সংখ্যালঘু’ লিখেছিল তার জীবনের ‘চরমতম সত্যকথন’ হিসেবে। পরিবারটি ভয় পেয়ে গেছে। আমি চাইনি পরিবারটির কোনো ক্ষতি হোক, তাই তুলে নিলাম লেখাটি। কিন্তু মনটা খচখচ করছে। জীবনভর যে আমি আপোসহীন আছি, কাউকে ভয় না করে, সেই আমি তুলে নিলাম একটা লেখা? শুধুমাত্র ‘সাম্প্রদায়িক’ সমাজের হামলার ভয়ে?

হায়রে পরাজয়, একেই বলি জীবনের পরাজয়। আমি পিছু হটতে চাই না, পারিও না। কিন্তু অনেকেই তো ভয় পায়। তারা মুখ বন্ধ করে থাকে। মাথা নিচু করে চাকরি করে সারাদিন, প্রমোশন আটকে যায় নামের পিছনে টাইটেল এর কারণে, তারপরও তারা প্রতিবাদ করে না, অফিস ফিরতি পথে বাজার করে ঘরে ফেরেন, নিজ নিজ সন্তানের পড়ালেখার তদারকি করেন, স্বামী-বৌ-বাচ্চাসহ রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এভাবেই চক্রাকারে চলছে এদেশে সংখ্যালঘুদের জীবন। মার খায়, কিন্তু ঘাড় তুলে প্রতিবাদ জানায় না।

কিন্তু আমি? বা আরও কয়েকজন? যারা শত মার খেয়েও ঘাড় বাঁকা করে ফোঁস ফোঁস করি! এইদেশে কুমিরের সঙ্গেই জলে বসবাস করি!

আমাদের ভাবায়, চরমভাবে ভাবায় সবকিছু। ব্যক্তি আমি ধর্মীয় আচারে বিশ্বাসী নই, তাই বলে ঠুনকো অনুভূতির দোহাই দিয়ে একের পর এক আঘাত দিয়ে যাবে কেউ, আর আমরা তা সহ্য করবো, তাতো হবার নয়। আমাদেরও কিন্তু অনুভূতি আছে, যখন সেই অনুভূতি আঘাত পাবে, বা আমরা জানাবো আঘাতের কথা, তখন বড্ড বেশি দেরি হয়ে যাবে তোমাদের সংখ্যাগুরুদের।

একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন আঘাতের ধরণটা। মেয়েশিশু, আড়াই বছর, কী পাঁচ বছর, বা ২৫ বছর, কী ৩০ বছর, কোনো নারী, মেয়ে কেউ নিরাপদ নয় এদেশে। ওরা আমাদের যোনিকে আঘাতের বস্তু বানিয়ে নিয়েছে। তার মানে ওদের টার্গেট নারী, আর ধর্ম। রক্ত মাংসের নারী এবং মাটির প্রতিমাকেও ওদের বড় ভয়। কাটা শিশ্নওয়ালাদের এতো জোর কোথা থেকে আসে? যদি রাষ্ট্র তাদের পিছনে না থাকে!

supriti-1
সুপ্রীতি ধর

তাই ওরা কথায় কথায় গুঁড়িয়ে দেয়, ধর্ষণ চালায়, আর প্রশাসন সেখানে ‘সম্প্রীতি বজায় রাখার প্রচেষ্টা’ হিসেবে ডুগডুগি বাজায়।

কিন্তু কতদিন? আমরাও যে জাগতে জানি, ওরা বোঝে না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার পর এক বন্ধু আমাকে ফোন করে বলে, ‘তুই চলে যাস না কেন এই মুসলমানের দেশ থেকে’? আমি বলি, ‘কেন যাবো? এইদেশের জন্য আমার বাবা প্রাণ দিয়েছে, আমি যা করি, নিজের জন্য করি না, দেশের জন্য করি, দেশের মানুষের জন্য করি, ধর্ম দেখি না, তোর সাথে একপাতে ভাত খাই, এক কাপে চা ভাগাভাগি করে খাই, এক খাটে ঘুমাই, তোর মাকে আমিও আবেগী হয়ে মা’ ডাকি, তাহলে কেন যাবো, বল’!

যদিও জানি এসবই আমার ইমোশনের কথা।

যে লেখাটা তুলে নিতে হলো, সেখান থেকে একটা প্যারা উদ্ধৃত করছি, “সবাই আমরা হা রে রে রে করে বলি ‘আমরা অসাম্প্রদায়িক’।
অসাম্প্রদায়িক! কাজের সময়, পূজার ফাঁকে ঘুরে বেড়ানোর সময় অসাম্প্রদায়িকতা, প্রতিমার ঢলো ঢলো মুখের সাথে সেলফি তোলার সময় আমরা ভুলে যাই কে হিন্দু, কে মুসলিম। ফেসবুকে ছবি দিলেই শতে-হাজারে লাইক, কিন্তু যখন অকারণে কারণ না যাচাই করে এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে হেনস্তা করে, তাদের ধর্মকে অবমাননা করে, তখন আমরা চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেই আমরা ‘সাম্প্রদায়িক’”।

আরও একটু যোগ করি, “ আমাদের আবেগ আজ ক্রিকেট, আমাদের আবেগ আজকে সাম্প্রদায়িকতায় গিয়ে ঠেকেছে। ক্রিকেটের বেলায় আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশপ্রেম উদযাপন করছি, একের পর এক হাসিমাখা বাঘের ছবি, একের পর এক হ্যাশট্যাগ দেয়া আমরা বাংলাদেশি, আমরা দেশের জন্য সব পারি, সব করি। আবার এই প্রেমই প্রশ্নবিদ্ধ হয় সাকিব যখন সৌম্যদের নিয়ে ইফতার করেন। আহারে দেশপ্রেমিক জাতি আমার!
কিন্তু দেশপ্রেম কি শুধু ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ? দেশপ্রেম আজকে জাগে শুধু ব্যাটে-বলে, দেশপ্রেম জাগে রামপালে, দেশপ্রেম জাগে তনু-খাদিজাতে, পাঁচ বছরের হিন্দু পূজার চিৎকার-আতংকে দেশপ্রেম জাগে না, চোখে জল আসে না, অন্য ধর্মের অসম্মানে দেশপ্রেম জাগে না, জাগে শুধু বীরত্ব! কাপুরুষোচিত বীরত্ব! অন্যকে ছোট করে নোংরাভাবে নিজে বড় হবার বীরত্ব। কী কাপুরুষ আমরা!

ধিক বাংগালী! ধিক তোমাদের!
আর শত ধিক এই কোনঠাসা অমুসলিম বাঙালীদেরও। স্বদেশে জন্মেও আজ তোমরা পরদেশী”।

মেয়েটার ওই লেখা তুলে নেয়াটা আমার জন্য একটা আঘাতবিশেষ। দিনশেষে আমিও যে একজন সংখ্যালঘু (সবদিক থেকেই), সেটাও যেন কেউ মনে করিয়ে দিল আমাকে।

কিন্তু আমি তো আসলে তা নই, মানিও না। মানি না বলেই জীবনের শত ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়েও আমি অবিচল আজো। আমি একদিকে নারী হিসেবে যেমন সংখ্যালঘু, তেমনি আদর্শগত দিক দিয়েও সংখ্যালঘু। তাই আজ এই আমি চ্যালেঞ্জ করলাম সব ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের, শিশ্ন-অন্ত সংখ্যাগুরুদের, যে শক্তির বলে তোমরা আজ হামলা চালাচ্ছো, দাপট দেখাচ্ছো, বাড়িঘর-দেশ থেকে উচ্ছেদ করছো, আমি আমার লেখা দিয়েই তোমাদের মোকাবিলা করবো। বলে রাখলাম।

শেয়ার করুন: