প্রসঙ্গ ভাবমূর্তি এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য

দিলশানা পারুল: এক ভদ্রলোক পাড়ায় বিরাট ভাবমূর্তি নিয়ে চলে কিন্তু গোপনে বৌ পিটায়। বৌ যদি চিৎকার করে তাহলে পাড়া প্রতিবেশির কাছে ভদ্রলোকের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার ভয়ে আরো পিটায়! ভদ্রলোক অবশ্যই বিশ্বাস করে বৌ পিটানোতে তার কোনো সমস্যা নাই, কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশী যদি বিষয়টা জেনে যায়, তাহলেই একমাত্র সমস্যা!

সবচেয়ে দু:খজনক হচ্ছে আমরা আসলেই এমন এক সমাজ ব্যবস্থাকে লালন করি, ধারণ করি এবং প্রমোট করি, যেখানে আসলে অন্যায় করলে বা অপরাধ করলে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় না। ভাবমূর্তি নষ্ট হয় অপরাধের কথা জনসমক্ষে আলোচিত হলে। যেকোনো অপরাধ, এমনকি সেটা যদি ব্যক্তির বেডরুমেও সংঘটিত হয়ে থাকে, সেটা অপরাধই এবং তার সঠিক বিচার হওয়াটা জরুরি।

ju-2বিচার হওয়া জরুরি কেন? কারণ অপরাধ হচ্ছে সমাজের দেহে ক্যানসার সেলের মতো। এইটাকে যদি সময় থাকতে চিহ্নিত করতে না পারেন, তাহলে আপনার প্রতিষেধক দেয়ার সুযোগ তৈরি হয় না এবং অবধারিতভাবে ক্যান্সার সমাজের পুরো দেহে ছড়িয়ে পরবে। ঠিক যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা এখন যাচ্ছি।

কোনটা অপরাধ আর কোনটা ঘটে যাওয়া অপরাধের অবধারিত ফলাফল, সেইটাই তো আমার চিহ্নিত করতে পারি না। এই যে অপরাধ চিহ্নিত করতে না পারা বা সংঘটিত অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখতে না পাওয়া, এই সংস্কৃতিতে প্রত্যন্ত গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত মানুষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট করা শিক্ষার্থী সমানভাবে ভিকটিমাইজড। এইটা এখন সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি।

এই সমাজে ধর্ষকের চেয়ে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির অপরাধ বেশী, এ সমাজে দরজা বন্ধ করে বৌ পিটানোতে কোন সমস্যা নাই, ঘুষের পয়সায় এখন আর কোন অপরাধ নাই, ইভটিজিং কোন সমস্যা না, রাস্তায় মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া কোন সমস্যা না,  বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সন্ধ্যার পর প্রেম করা অপরাধ, কিন্তু প্রেমিককে বেঁধে রেখে প্রেমিকার উপর যৌন সন্ত্রাস করা অপরাধ না, দেশে হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে সুইস ব্যাংকে চলে যায় তাতে দেশের ভাবমূর্তির কোন ক্ষতি হয় না, কিন্তু ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিলে ভাবমূর্তি চুর চুর করে ভেংগে যায়!

এই ভেসে যাওয়া সমাজের একমাত্র আশা ভরসার জায়গা ছিলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা পড়াশোনা করে, তারা বেশির ভাগই খেটে খাওয়া বাবা-মায়ের সন্তান। সমাজের প্রতি এরা অন্যরকম দায়বদ্ধতা থাকে তাদের। এরা যে সমাজের প্রতি দায় অনুভব করে তার প্রমাণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে পুলিশ প্রবেশের প্রতিবাদে আন্দোলন, হুমায়ূন আজাদের উপর হামলার প্রতিবাদে আন্দোলন!

প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনে থাকার কারণে দু’দুটো আন্দোলনেই সরাসরি থাকার সুযোগ আমার হয়েছে। কী বিশাল ছাত্রস্রোত, না দেখলে এখনকার ছেলেমেয়েরা বিশ্বাসই করবে না। আমি কিন্তু আজ থেকে ৬০, ৭০ বছর আগের ভাষা আন্দোলনের উদাহরণ দিচ্ছি না। মাত্র ১০, কী ১৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা!

এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই ধর্ষণের বিরুদ্ধে কী শক্তিশালী আন্দোলন হয়েছে! জাহঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন হয়, তখন সবচেয়ে চাওড় করা বক্তব্য ছিলো, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে”।

ju-3যখন ভিকটিমকে খোঁজা হচ্ছিল, তখন সব মেয়ে শ্লোগান তুললো, ‘আমি ধর্ষিতা’। এরকমও ঘটনা ঘটেছে জাহাঙ্গীরনগরের মেয়ে শুনে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে! তখন এক পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘যে ছেলে এইরকম কথা বলতে পারে, আমি তার কাছে মেয়ে বিয়ে দেই না’।

এরকমও সময় গেছে, যখন প্রান্তিকে গেলে মেয়েদের ওড়না ধরে টানাটানির ঘটনা ঘটতো। মেয়েরা যদি মনে করতো এইগুলা বলা যাবে না, ‘আমার মানহানি হবে’, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মানহানি হবে’ তাহলে আজকে পরিস্থিতি কোথায় থাকতো? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হলে দফায় দফায় সান্ধ্য আইন জারি করার চেষ্টা করা হয়েছিলো, পারেনি মেয়েদের প্রতিবাদের মুখে।

যে প্রেমিকটি আজকে নিরাপদে তার প্রেমিকাকে চুমু খেতে পারে, সেটা কিন্তু এ্ই আন্দোলনেরই ফল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে যে নিরাপত্তা বেষ্টনি, সেইটা ছাত্রদের আন্দোলনের ফসল, ডেইরি গেটে যে ওভারব্রিজ সেইটা ছাত্রদের আন্দোলনের ফসল। এই সমস্ত আন্দোলনই রাজনৈতিক আন্দোলন, সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যার গুরুত্ব অপরিসীম। জাবির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, আন্দোলনের সাথে যুক্ত প্রতিটা ব্যক্তির চরিত্র বিনির্মাণ করেছে।

dilshana-parul
দিলশানা পারুল

বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞান আহরণের জায়গা না। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ক্যারিয়ার পারসু করার জায়গা না। বিশ্ববিদ্যালয় চরিত্র নির্মাণেরও জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয় মানে শিরদাঁড়া শক্ত করার কারখানা, শিরদাঁড়া ভাঙার না। সত্য যত কদর্যই হোক, সেটা স্বীকার করে নিয়ে সেটাকে ফাইট দেয়াটাই হচ্ছে প্রকৃত ভাবমূর্তি। লজ্জা অন্যায় করার মধ্য দিয়ে। ভাবমূর্তি নষ্ট হয় অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে, অন্যায়কে রুখে দেয়ার মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তির একটি প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত চরিত্র তৈরি হয়। সমাজে যখন পূজারা ধর্ষণের শিকার হয়, এই ছেলেময়েগুলো তখন আশার আলো দেখাবে।

তনু হত্যার যখন কোনো বিচার হয় না, এই ছেলেময়েগুলা তখন আক্রোশে, বেদনায় চোখের পানি ফেলবে! ফাইট দেবে। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার যখন এই হাল, তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছেলেমেয়েরাই ছিলো একমাত্র ভরসার জায়গা! এদেরই তো প্রতিষ্ঠা করার কথা, দেখানোর কথা, ‘দেখ সারাদেশেই অন্যায় হয়, অপরাধ হয়, কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যায় করে, অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না, সবাই মিলে রুখে দেয়া হয়’!    

শেয়ার করুন: