শান্তা মারিয়া: একের পর এক ধর্ষণের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। বীভৎস থেকে বীভৎসতর সংবাদ। রাজধানীর ভাটারায় ১১বছর বয়সী একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে গুরুতর আহত অবস্থায়।
এর আগে দিনাজপুরে ঘটছে নৃশংসতম ঘটনা। মাত্র পাঁচ বছরের একটি শিশু। তারও সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। ছিঁড়ে ফেলা হযেছে তার জরায়ু। হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে ছোট্ট শিশুটি। তার উপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাইফুল নামের নরপিশাচটি তখন কত কষ্টে সে মা বাবাকে ডেকেছে, তার ছোট্ট শরীরে ও মনে কত আতংক, কত ভয়, কত যন্ত্রণাই না হয়েছে। সে যদি বেঁচেও থাকে তাহলে সারাজীবন এক ভয়াবহ স্মৃতি বুকে নিয়ে তাকে বাঁচতে হবে। সে কি আর স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবে? আর কোনো পুরুষকে ভালোবাসতে পারবে কখনও?
এই সপ্তাহেই রাজধানীতে গারো নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
কিছুদিন আগে বাগেরহাটের মোল্লার হাটেও ঘটেছে ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনা। ধারালো অস্ত্র দিয়ে সংখ্যালঘু পরিবারের এক গৃহবধূর পায়ের গোড়ালি কেটে ফেলেছে সোবহান মোল্লা নামে আরেক নরপিশাচ। গৃহবধুর পরিবারের সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সে পনের দিন ধরে আহত নারীটিকে ঘরে আটকিয়ে রেখে ধর্ষণ করেছে।
রাজধানীতে কাজের খোঁজে আসা এক কিশোরীকে তার আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে ভাড়া বাসার দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করে ধর্ষণ করেছে এলাকার সন্ত্রাসী।
প্রতিদিনই খবরের কাগজে দেশের কোথাও না কোথাও সংঘটিত ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ধর্ষণ হলো নারীর উপর সংঘটিত জঘন্যতম যৌন অপরাধ যা একটি দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং অরাজক পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। এই অর্ধেক জনগোষ্ঠী যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, যদি প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসী, বখাটেদের হামলার শিকার হয় তাহলে সমাজের ও দেশের সার্বিক অবস্থা যে কত হতাশাজনক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এইসব ধর্ষকদের শাস্তি কী হওয়া উচিত? ধর্ষণের শিকার একজন নারীকে যে প্রবল শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয় তার ক্ষতিপূরণ কোনো কিছু দিয়েই হয় না। ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ যে অপরাধের পক্ষে একটি যুক্তিও দাঁড় করানো সম্ভব নয়। বিচারহীনতাই এমন অপরাধকে আরও উৎসাহিত করে। আইনের হাত এড়িয়ে যখন একজন ধর্ষক রেহাই পায় তখন আরও দশজন সম্ভাব্য অপরাধীর জন্ম হয়।
আর যদি ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের কঠোর শাস্তি বিধান করা যায় তাহলে অন্য সম্ভাব্য অপরাধীরা ভয়ে নিজেকে সংযত করে। বিশ্বের অনেক দেশেই ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে রাসায়নিকভাবে নপুংশক করার বিধান রয়েছে।
সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় ১৪ বছরের এক শিশুকে গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর শিশু ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাশ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে রাসায়নিকভাবে অপরাধীকে নপুংশক করে দেওয়ার আইনও পাশ হয়েছে। এর আগে দেশটিতে শিশু বা বয়ষ্ক যে কাউকে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তিছিল ১৪ বছরের কারাদণ্ড।
দেশটির প্রেসিডেন্ট উইদোদো আশা প্রকাশ করেছেন যে এ ধরনের কঠোর আইনের ফলে ধর্ষণের মতো যৌন অপরাধ দমন হবে। তিনি বলেছেন, ‘যৌননিপীড়কদের যেন সর্বোচ্চ সাজা হয় সে বিষয়টি আমরা দেখবো। যদিরাসায়নিকভাবে একজন অত্যাচারীকে নপুংসক করে দেয়া হয় তাহলে সময়েরসাথে সাথে যৌন অপরাধ কমে যাবে এবং একসময় সেটি পুরোপুরি দমন হয়েযাবে।’

বাংলাদেশেও ধর্ষকের শাস্তির বিধান এমনই হওয়া দরকার। আজ যদি দশজন ধর্ষককে নপুংশক করে দেওয়া হয়। তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় এগারো নম্বর ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটবে না। ধর্ষককে নপুংশক করার বিধান রেখে নতুন আইন পাশ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন এই আইনের পক্ষে জনমত গঠন করার।
সেই সঙ্গে পর্নোগ্রাফির উপরেও নিষেধাজ্ঞা থাকা প্রয়োজন। পর্নোগ্রাফি আইনকে আরও কঠোর করতে হবে। কোনো নারী ও শিশুর আপত্তিকর ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রচারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশে প্রায়ই এমন ঘটছে যে, ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে অথবা সেটি প্রচারের ভয় দেখিয়ে ভিকটিম এবং তার পরিবারকে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে। ভিকটিমকে দিনের পর দিন ধর্ষণের শিকারে পরিণত করা হচ্ছে বা তাকে সামাজিকভাবে হেয় করার জন্য তার ভিডিও বাজারে প্রকাশ করা হচ্ছে। এ সবের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
চীনের মতো প্রযুক্তিতে উন্নত দেশেও পর্নোগ্রাফি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। সেখানে পর্নোগ্রাফির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বা সন্দেহজনক কোনো যৌনগন্ধী শব্দ দিয়ে সার্চ করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেইজটি ব্লক হয়ে যায়। আমাদের দেশে গ্রামেগঞ্জে হাটেবাজারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোবাইলে মোবাইলে পর্নোগ্রাফি চলছে লাগামহীনভাবে যা সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। পর্নোগ্রাফি নারী ও শিশুর উপর যৌনআক্রমণ ও ধর্ষণকে উৎসাহিত করে। নারী ও শিশুকে মানুষ নয়, যৌনবস্তুরূপে উপস্থাপন করে। তাই এগুলো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।
আর সবার উপরে যে কথা সত্য তা হলো নারী ও শিশুর উপর সংঘটিত যে কোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।ধর্ষণ কোনো সেকেন্ডারি ইস্যু নয়। এটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সে দৃষ্টিকোণ থেকেই একে মোকাবেলা করতে হবে।সবগুলো রাজনৈতিক দল এবং সমাজের সবগুলো অংশ একত্রিত হয়ে যদি ধর্ষণের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলা যায় একমাত্র তখনই সম্ভব এই জঘন্য অপরাধকে সমাজ থেকে দূর করা। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সজাগ করা দরকার। ধর্ষণের অভিযোগে মামলা নিতে যেন গড়িমসি না করা হয, বিলম্ব না করা হয়। আর ধর্ষক যত প্রভাবশালীই হোক না কেন কোনো রাজনৈতিক দলের আশ্রয় প্রশ্রয় যেন সে না পায়। এই ধরনের অপরাধকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনাও প্রয়োজন।কারণ মামলার দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগ নিয়ে ভিকটিমের পরিবারের উপরেই আবার চড়াও হয় অপরাধীরা।ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করে তাদের। ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষার ভীতিকর পদ্ধতিও ধর্ষণ মামলা থেকে ভিকটিম ও তার পরিবারের পিছিয়ে আসার অন্যতম কারণ। এই পদ্ধতিও নারীবান্ধব হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশকে ধর্ষকের অভয়ারণ্য করা চলবে না কিছুতেই। দলমত নির্বিশেষে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে, তবেই যদি এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আমাদের এই দেশে ধর্ষণের উৎসব চালাতে দেয়া হবে না কিছুতেই।
আরেকটি কথা না বললেই নয়। ধর্ষণের খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে মিডিয়াকেও সংযত এবং সচেতন হতে হবে। পার্বতীপুরের ঘটনায় শিশুটির নাম, পরিচয় প্রকাশ করা খুব কি জরুরি ছিল? খুব কি জরুরি ছিল তার ছবি এবং আক্রান্ত স্থানের ছবি প্রচার করা? ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর ছবি, নাম, পরিচয় নয় বরং ধর্ষকের নাম ঠিকানা পরিচয় বিস্তারিত প্রচার করুন। সেটাই হবে সচেতন সাংবাদিকের কাজ।