হেজেমনাইজড জাহাঙ্গীরনগরিয়ান এবং একজন প্রীতি

রাতুল বিদ্যার্থী:

এই মুহূর্তে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে ভেতরে বাইরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি হচ্ছে র‍্যাগিং। ধন্যবাদ জান্নাতুন নাঈম প্রীতিকে জাহাঙ্গীরনগরের সবচেয়ে ওপেন সিক্রেটকে সমস্ত ট্যাবু ভেঙে আবার সবার সামনে তুলে ধরার জন্য, এবং আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া যে কোনো প্রথাই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।  এবং এই ওপেন সিক্রেটকে সবার সামনে তুলে ধরায় প্রীতি এই মুহূর্তে অনলাইনে এবং অফলাইনে আলোচিত এবং সমালোচিত।

একজন জাবিয়ান হওয়ার সুবাদে আমি খুব ভালোভাবে জানি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিং আছে এবং তার মাত্রাও যে কম তা না। বস্তুত আমি নিজেও প্রথম বর্ষে র‍্যাগিং এর শিকার।

rahul-ju
রাতুল বিদ্যার্থী

ক্লাসের প্রথম দিন সিনিয়রদের কাছে ক্লাসরুমে আমাকে পাঁচ রকম ভাবে হেসে তাদের মনোরঞ্জন করতে হয়েছিলো, দ্বিতীয় দিন দুপুর বারোটা থেকে বিকেল পর্যন্ত বদ্ধ রুমে রেখে ‘সিটিং’ দেওয়ার ফলে সেদিনই আমাকে নিয়ে যেতে হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে। আমার এমন সব বন্ধুকে চিনি যাকে চড় মারতে চাওয়া হয়েছিলো, কান ধরতে রাজি না হওয়ায়, কেননা সে হাল ফ্যাশনের দাঁড়ি রাখতো।  

আমার এমন বন্ধুর কথা বলতে পারবো যাকে হলের গণরুমে ১০০ বার কানে ধরে উঠবস করানো হয়েছিলো, এমন বন্ধু আছে যাকে হলে যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছিলো।  আমার জুনিয়র বন্ধুদের কাছে সেদিন শুনলাম কিভাবে তাদের অন্য এক অনুষদের বন্ধুদের গাছে চড়তে এবং লেকের পানিতে নামতে বাধ্য করা হয়েছিলো। এই সেদিনও নিউজ দেখলাম সিনিয়রের মারধোর এর কারণে হল ছাড়ছে জুনিয়র শিক্ষার্থী।   

সুতরাং, জাবিতে র‍্যাগিং হয় না এটি একটি সর্বৈব মিথ্যা। আমার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলে নতুন ব্যাচ আসার পর জাবির মেডিক্যাল সেন্টারে একটু ঢুঁ মারলেই হবে।  র‍্যাগিং এর জন্য বহিষ্কৃত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবং মেয়েদের হলও এর বাইরে নয়।

এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই প্রথম বর্ষের নিপীড়িত শিক্ষার্থীটাই কিভাবে পরবর্তীতে নতুন ব্যাচ আসার পর নিপীড়ক হয়ে ওঠে।  দেখা যায় যে, শুরুতে র‍্যাগিং এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাই প্রায় পরবর্তীতে র‍্যাগিং এর সমর্থক হয়ে ওঠে।  এর কারণ হিসেবে বলা যায়, জাবিতে বর্তমানে ‘ভালো র‍্যাগিং’ এবং ‘খারাপ র‍্যাগিং’ এই দুই ধরনের র‍্যাগিং প্রচলিত আছে।  অর্থাৎ, আপনাকে শুরুতেই মগজের ভেতর গেঁথে দেওয়া হবে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সারভাইভ করতে গেলে অবশ্যই র‍্যাগিং এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে, হোক তা ভালো বা খারাপ।  এবং সাথে সাথে এও শিখিয়ে দেওয়া হবে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি পরিবার।  

এর ভেতরের সমস্ত খারাপ বিষয়কে বাইরের দুনিয়ার কাছে চেপে যেতে হবে বেমালুমভাবে। এবং যারা এই বিষয়গুলো মেনে নেবে না তাদের উপর চলবে ‘খারাপ র‍্যাগিং’ এর স্টিমরোলার ( বিশেষত ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের)।  এই ভয়াবহ মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচারের ফলে নতুন শিক্ষার্থীদের শিরদাঁড়াকে চূড়ান্তভাবে ভেঙে ফেলে করে তোলা হয় হোমোজেনিক; শেখানো হয় প্রশ্ন না করতে, এবং ভয়াবহভাবে ছুঁড়ে ফেলা হয় তাদের সৃজনশীলতাকে।

ফলে এই নতুন পরিবেশে বাঁচার তাগিদেই এই সব ছেলেমেয়েগুলো ক্রমে হেজিমনাইড হয়ে ওঠে; এই প্রথার মধ্যে থেকেই ‘ভালো র‍্যাগিং’ এর মাধ্যমে একজন ভালো জাহাঙ্গীরনগরিয়ান হয়ে উঠতে চায়।  এই হেজেমনাইজড মগজই তাকে উদ্বুদ্ধ করে পরবর্তী র‍্যাগিং এ।

তারপরেও আরো প্রশ্ন আসে, ” সব ভার্সিটিতেই তো র‍্যাগ হয়, অমুক জায়গার র‍্যাগিং তো জাবির চেয়েও বেশি, তাহলে জাবি কেন এত ফোকাস পায়? এতে কি জাবির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না? ”  জাহাঙ্গীরনগর এর অনেক আভ্যন্তরিন সমস্যা থাকলেও একথা স্বীকার করে নিতেই হবে, এই ক্যাম্পাস ভয়াবহরকম ভাবে উদার।  এবং প্রত্যেক বছরই ক্যাম্পাসে নতুন কিছু “অসভ্য বেয়াদব” ছেলেমেয়ে ভর্তি হয় যারা এই সব প্রথাকে প্রশ্ন করে, মানতে চায় না এইসব অন্যায় কে।

priti-ragging
প্রীতিকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার স্ক্রিনশট

তাইতো এই ক্যাম্পাসেই ধর্ষকবিরোধী আন্দোলন হয়, এই ক্যাম্পাসের নারীরা চলতে পারে নির্বিঘ্নে,  এই ক্যাম্পাসকেই সংস্কৃতির রাজধানী বলা হয়।  এই একই কারণে জাহাঙ্গীরনগর এর প্রতিটি অসমতা, অন্যায়ের কথা ভাইরাল হয়, কেননা আমরা মনে করি কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদের শুরু হতে পারে কেবলমাত্র তা নিয়ে ক্রমাগতভাবে আলোচনার মধ্য দিয়ে।  তাই আমরা ভালো মানুষটি না সেজে “বেয়াদব” তকমা গায়ে লাগিয়ে  উচ্চারণ করি এই সব অন্যায়ের কথা, এবং আশা করি তার যথাযথ প্রতিবিধানের।

প্রীতি এই কাজটি করে দেখিয়েছেন।  আমরা তাকে শুধুমাত্র ধন্যবাদ জানিয়েই ক্ষান্ত হতে চাই না।  আমরা তাকে জানাতে চাই, তাকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণাকারীরাই শুধুমাত্র ক্যাম্পাসে অবস্থান করে না, আমরা, যারা তাকে সমর্থন করি এবং তার পাশে আছি, আমরাও এই ক্যাম্পাসেরই অংশ। ক্যাম্পাস যতটুকু আমাদের, ঠিক ততটুকুও প্রীতির। এই লড়াইয়ে আমরা আছি একসাথে।

নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ২য় বর্ষ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

জান্নাতুন নাঈম প্রীতির লেখাটার লিংক: https://womenchapter.com/views/16862

র‌্যাগিংয়ের নামে সীমা লঙ্ঘন কাম্য নয়

শেয়ার করুন: