আসাদুজ্জামান আসাদ: অনলাইন পোর্টাল womenchapter- এ জান্নাতুন নাঈম প্রীতির একটা লেখা পড়লাম। র্যাগিং এর শিকার হয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেই লিখেছেন তিনি। পাশাপাশি যথাযথ কর্তৃপক্ষের বরাবর বিচারও দিয়েছেন র্যাগদাতাদের বিরুদ্ধে। আমি তার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি।
আমি জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। প্রসঙ্গক্রমে র্যাগ বিষয়ে আমারও মনে পড়ে গেল কিছু কথা। তাই লিখছি…

প্রথম বর্ষে থাকাকালীন র্যাগের কারণে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মনস্তাত্ত্বিক চাপ যে কতখানি ভয়ঙ্কর হতে পারে, যে কখনো এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যায় নাই, তাকে বলে বোঝানো যাবে না। সঙ্গতকারণে প্রথম বর্ষের সবাই মনে করে এটা অমানবিক, এখনই বন্ধ হওয়া দরকার।
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরাই যখন দ্বিতীয় বর্ষে ওঠে তখন রাতারাতি সবাই ভোল পালটে ফেলে! এই নব্য সিনিয়রদের তখন বেশ দাপট ক্যাম্পাস জুড়ে। বর্ষার শুরুতে পুঁটিমাছের যেমন অবস্থা হয় অনেকটা সেরকম! গোটা ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়ায়। অলিখিতভাবে ইমিডিয়েট সিনিয়র হিসেবে তাদের উপর দায়িত্ব বর্তায় নতুন আসা ‘মুরগিদের’ দেখে-শুনে রাখার, ‘ম্যানার’ শেখানোর!
আমার মনে আছে, তখন আমি আমার ২/৩/৪ ব্যাচ সিনিয়রদের যতোটা না ভয় করতাম, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভয় করতাম ইমিডিয়েট সিনিয়র সেকেন্ড ইয়ারের ভাইদের; নির্দিষ্ট করে বললে পলিটিক্স করে- এমন ভাইদের!
জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারির সেই হিমশীতল রাতগুলো কেটেছে ‘বড়ভাইদের’ আনন্দের অনুষঙ্গ হয়ে। ভোররাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ‘নিয়মকানুন’, ‘ভদ্রতা’, ‘আদব’ বিষয়ে বড়ভাইদের বয়ান শুনতাম। মাঝে-মধ্যে ৩/৪ ব্যাচ সিনিয়ররা বেড়াতে আসতেন আমাদের ১২০ জনের গণরুমে। তারা আমাদের প্রাপ্ত ট্রেনিং এর ত্রুটি খুঁজে বের করে অলিখিত দায়িত্বপ্রাপ্ত ইমিডিয়েট জুনিয়রদের পাল্টা রাগ দেখাতেন।
উচ্চস্বরে তাদের বলতেন, “এই ফাউলদের কী শিখিয়েছিস এতোদিন যে এখনও বড়ভাইদের চেনে না, ঠিকমতো পরিচয়ও দিতে পারে না?” উল্লেখ্য, এখানে নাম, ডিপার্টমেন্ট, হল, বর্ষ বলে নিজের পরিচয় দেয়ার একটা ফরম্যাট আছে, যেটা নির্ভুলভাবে অনুসরণ করতে হয়! পাশাপাশি হল এবং নিজ ডিপার্টমেন্টেরর সিনিয়রদের নাম, ব্যাচ, রুম নম্বর, দেশের বাড়িসহ বিবিধ তথ্যাদি ঠোঁটস্থ রাখতে হয়। জিজ্ঞেস করামাত্রই সঠিক ডেলিভারি দিতে হবে।
কেউ ব্যর্থ হলে আবার শিখতে হবে। যে যত দ্রুত এসব আত্মস্থ করতে পারবে সে তত দ্রুতই সবার নজরে পড়বে। জনপ্রিয় হবে। বেশি সিনিয়ররা চলে যাওয়ার পর ইমিডিয়েটরা সেই ফাপরের ঝাল মিটাতো আমাদের আরও বেশি বেশি নিয়ম শিখিয়ে! তাদের “ফাপর” উপভোগ করে যখন ঘুমাতে যেতাম তখন রাত্রি প্রায় শেষ! প্রায়ই পরদিন সকাল ৮:২৫’র ক্লাসের অর্ধেকটা মিস করতাম। কোনো কোনোদিন পুরোটাই!
দিনের পর দিন বড় ভাইদের এমন আনন্দের উপলক্ষ হওয়ায় প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় পেলাম ৩.০৬ (৪ পয়েন্ট স্কেল)! সেই আমিই দ্বিতীয় বর্ষে পেলাম ৩.৪৬! চতুর্থ বর্ষে পেলাম ৩.৬৬! ঢাকায় বা কাছাকাছি কোথাও আমার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। আপনজন সবাই থাকতো উত্তরবঙ্গের রংপুরে, কুড়িগ্রামের চিলমারীতে। প্রায়শই ভয়ে, আতঙ্কে প্রায় ৪০০ কি. মি. পাড়ি দিয়ে সেখানে চলে যেতাম!
হলে থাকলেও সিনিয়রদের চোখ এড়িয়ে, গা বাঁচিয়ে চলতাম! ফিজিক্সের চন্দন আমার বেডমেট ছিল। ওর তখন জন্ডিস। শুয়ে থাকতো। প্রায়ই রাতে অসুস্থতার ভান করে ওর পাশে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তাম! ফাপর থেকে বাঁচার জন্য অনেক মিথ্যা বলতাম! নিজেকে সবসময় দাগী অপরাধী মনে হতো! আব্বু আম্মুকেও বলতে পারিনি আমার স্বপ্নময় নতুন জীবনের এহেন দুরবস্থার কথা! কারণ সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছাতেই ভর্তি হয়েছিলাম সবুজে ঘেরা প্রিয় জাহাঙ্গীরনগরে!
আমার কিছু ফ্রেন্ড তো রীতিমতো হল ছেড়ে পার্শ্ববর্তী গেরুয়া, ইসলামনগর, রেডিও কলোনিতে বিভিন্ন মেসে উঠলো! তাদের মেসে ওঠার খবর যদি জানাজানি হয় তাহলে তারা নতুন বিড়ম্বনার শিকার হবে ভেবে কতশত অনুরোধ করতো এ খবর পাঁচকান না করার জন্য! বিনিময়ে মাঝেমধ্যে ডাইনিংয়ের অখাদ্য ছেড়ে একবেলা তাদের মেসে খাওয়ার জিয়াফত পেতাম!
সেই আমরাই যখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম, তখন একজনকেও পেলাম না যে চায় র্যাগ বন্ধ হোক! আমি নিজেও চাইনি! অতি নম্র, ভদ্র বলে যাদের জানতাম, তারাও হয়ে উঠলো তুখোড় র্যাগদাতা! ডিপার্টমেন্ট, ক্যাম্পাস, হল- সর্বত্রই চলতে থাকলো আমাদের “মুরগি” ধরার অভিযান। শিক্ষা বছরের শুরুতে ফার্স্ট ইয়ারের জন্য পরিবহন অফিস আলাদা একটা বাস স্ট্যান্ড চালু করে। আমরা সেটার নাম দিয়েছিলাম “মুরগি চত্বর” বলে।
মার্কার কলমে অতি উৎসাহী কেউ কেউ পোস্টারও লিখে ওই চত্বরের গাছে গাছে সেটে দেয়! নতুন ব্যাচ মানেই মুরগি- এটা ক্যাম্পাসগুলোর প্রেক্ষিতে খুবই সত্যি কথা!
বিশ্বাস করুন, সেই সময়গুলোতে একটিবারের জন্যও মনে হয়নি আমরা “অন্যায়” করছি! এমনকি আজও মনে হয় না এটা করা অন্যায়। ওই যে শুরুতেই বললাম, ফার্স্ট ইয়ার পার করে আসার পর সবাই এর মজাটা বুঝে যায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এটা সীমা ছাড়িয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কেউ কেউ সীমালঙ্ঘনও করে ফেলে। আমি এই সীমালঙ্ঘনের বিরুদ্ধে।
আমি নিজেও বহু জুনিয়রকে র্যাগ দিয়েছি। সেগুলো স্রেফ আনন্দ বলেই সবার কাছে বিবেচিত হতো, যাকে দেয়া হতো তার কাছে ছাড়া। আমি যখন র্যাগ খেয়েছি তখন আমার কাছেও তা-ই মনে হতো। র্যাগিংয়ের মধ্য দিয়ে আমি অনেক সিনিয়রের খুব কাছের ছোটভাইয়ে পরিণত হয়েছিলাম। বটতলা, টারজান পয়েণ্ট, ডেইরি, প্রান্তিকে কত দোকানে কতবার বন্ধুবান্ধবসহ খেয়ে বিল দেয়ার সময় র্যাগ দেয়া বড়ভাইদের দেখিয়ে দিয়েছি তার হিসেব নাই! পরে আমাকে দেখিয়েও জুনিয়রেরা একই কাজ বহুদিন করেছে। আজও করে!
আমাদের বাসের টিকেটের সৌজন্য মূল্য এক টাকা! ক্যাম্পাস থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পাঁচদিনও ভাড়া দিতে হয়নি আমাকে! ৮/১০ জন বন্ধুর ভাড়া সামনের কোনো বড়ভাই দিয়ে দিতেন। আজও দেন। চিল্লায়ে জিজ্ঞেস করতেন, “এই আসাদ, তোরা কয়জন?” আমরাও চিল্লায়ে উত্তর দিতাম, “ভাই, দশজন!” একইভাবে আমি সিনিয়র হওয়ার পর জুনিয়রদের ৮/১০ জনের হিসাব আনন্দচিত্তে বহুবার মিটিয়েছি। এই সম্পর্কগুলো এমনি এমনি তৈরি হয় না।
র্যাগের নিজস্ব কিছু ভাষা আছে, আছে শৈল্পিক একটা ঢং! এই ভাষা আয়ত্ব করতেই কেটে যায় একটি বছর। এই শিল্প রপ্ত করার পর জাহাঙ্গীরনগরের প্রায় প্রত্যেক (মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাদে) শিক্ষার্থী চায় র্যাগ চলতে থাকুক!
বাইরে থেকে সুশান্ত পালেরা ভার্সিটির র্যাগিং নিয়ে অনেক কথা বলেন। বলতেই পারেন। তবে বলতে বলতে মিথ্যাচার করেন। প্রায়শই তারাও সীমালঙ্ঘন করে ফেলেন, অথচ টেরই পান না! জাহাঙ্গীরনগরের সিনিয়র শিক্ষার্থীদের কথা বাদই দিলাম, ন্যূনতম দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে এমন একশো জনকে জিজ্ঞেস করেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই র্যাগের পক্ষে কথা বলবে।
তবে অতিউৎসাহী কেউ কেউ আছেন যারা র্যাগের নামে সীমা ছাড়িয়ে যান। এটা খুবই অন্যায়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এর বিরুদ্ধে। স্রেফ আনন্দদায়ী একটা উপলক্ষকে যারা নিজেদের কায়েমি স্বার্থে ব্যবহার করছে- তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।
মাথাব্যথা করে বলে আপনি নিশ্চয়ই নিজের মাথাটাই কেটে ফেলেন না। প্যারাসিটামল অথবা ডিসপ্রিন জাতীয় ঔষধ সেবন করেন। র্যাগিংকে যারা কলুষিত করছে, তাদেরকে দমনের জন্যও ভালো ঔষধ প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি!