দেব প্রসাদ দেবু: খুন-ধর্ষণ-নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলোও এখন আর দশটা নিয়মিত ঘটে চলা আটপৌরে ঘটনার মতো মনে হয় আমাদের কাছে। খুব বেশি আলাদা কোন আবেদন নেই এগুলোর আর। অনেকটা গা-সওয়া হয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে গিয়েছে। খুব সহজে আমরা এসবে আর রা করি না এখন। তবুও এই গা-সওয়া সংস্কৃতির মাঝে কিছু ঘটনা আমাদের নাড়া দিয়ে যায় মাঝে মাঝে।
পাঠক, ভেবে দেখুনতো নিত্য ঘটে চলা ধর্ষণের কয়টা ঘটনা আমাদের নজর কাড়ে, সহানুভূতি জাগায় সর্বস্তরে? যে নৃশংসতা আগে খুব একটা কখনো ঘটেনি বা অতি প্রায়শই ঘটে না সেরকমটা হলেই কেবল আমাদের শহুরে জীবনে খানিকটা আলোড়ন তোলে ক্ষণিকের জন্য। আমরা খানিকটা আবেগের বশবর্তী হয়ে প্রতিবাদে মেতে উঠি।

সম্প্রতি পূজা নামের পাঁচ বছর বয়সী শিশুটির উপর ঘটে যাওয়া নৃশংস নির্যাতনের পরে আমি খানিকটা ভিন্ন ভাবে বিষয়টা ভাবার চেষ্টা করেছি। কারণ আমার মনে হয়েছে একটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে কি একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ের যোনিপথ ব্লেড দিয়ে কেটে বিস্তৃত করে বিকৃত যৌনাচার করা সম্ভব? আমার মনে হয় না। এতোটা বীভৎস নিশ্চয়ই আমরা এখনো হয়ে উঠেনি। হতে পারবোও না বোধহয় কোনোদিন।
প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন লেখা খানিকটা ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে যা পেলাম সেটা হচ্ছে সাইকোলজিক্যাল টার্ম অনুসারে প্যারাফিলিয়া আক্রান্তরাই সাধারণত যৌনতা নিয়ে এরকম পৈশাচিক আচরণ করে। প্যারাফিলিয়া বলতে সাধারণত সেই সব যৌন আচরণকে বুঝানো হয় যেগুলো সমাজ, সংস্কৃতিতে সাধারণ ভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, স্বাভাবিক নয়।
এই প্যারাফিলিয়ার আবার বিভিন্ন ক্লাসিফিকেশন আছে। যার মধ্যে পেডোফিলিয়া, ফেটিশিজম, ফ্রটারিজম, এগুলো অন্যতম। পেডোফিলিয়া ডিজঅর্ডারে আক্রান্তরা শিশুদের উপর যৌন আক্রমণ চালায় বা বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হয়। ফ্রটারিজম ডিজঅর্ডারনেসের কারণে পুরুষরা ভিড়ের মধ্যে বা সহজে চিহ্নিত করা যাবে না এমন স্থানে মেয়েদের শরীর স্পর্শ করে যৌনতার আনন্দ পায়। আর ফেটিশিজম আক্রান্তরা সাধারণত বিপরীত লিঙ্গের, পোশাক, অন্তর্বাস, জুতা-মোজা বা এ জাতীয় বস্তুতেই যৌন আগ্রহী হয়ে উঠে।
সে যাই হোক, পেডোফেলিয়া নামক অস্বাভাবিক যৌন কামনা বা অস্বাভাবিক যৌন আচরণ ঠিক কবে থেকে সমাজে দেখা দিয়েছে সেটা বলা মুশকিল হলেও, উনিশ শতকের শেষ দিকে এটিকে প্রথম অফিসিয়ালি রিকগনাইজ করা হয়। ১৮৯৬ সালে ভিয়েনার সাইক্রিয়াটিস্ট রিচার্ড ভন ক্রাফটিবিং প্রথম পেডোফিলিয়া ইরোটিকা (Paedophilia erotica) টার্মটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে ১৯০৫ সালে অস্ট্রিয়ান নিউরোলজিস্ট সিগমন্ড ফ্রয়েড প্রথম এই বিষয়ে বিশদ লিখেন তাঁর Three Essays on The Theory of Sexuality বইতে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই পেডোফিলিয়া শব্দটি মেডিক্যাল ডিকশোনারিতে স্থান পায় এবং ১৯৫২ সালে Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders এর পঞ্চম সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে এটা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা হলেও এর কারণ সুনির্দিষ্ট ভাবে বের করা যায়নি। তবে নিউরোলজিক্যাল বা মস্তিষ্কের সমস্যা হিসেবে বিভিন্ন গবেষণায় মতামত পাওয়া গিয়েছে এবং সেই গবেষণা এখনো চলমান আছে। শুনতে অস্বাভাবিক শুনালেও সমাজে এই পেডোফেলিয়া ডিজঅর্ডার আক্রান্তের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু, শিক্ষিত বা নৈতিক ভাবে শিক্ষিতরা এটা নিয়ন্ত্রণ করে বা করতে পারে বলে সমাজে হরহামেশাই এসব দেখা যায় না। ফলে নৈতিক শিক্ষার একটা গুরুত্ব আছে এই নির্মমতা বন্ধ করতে।
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সেক্স্যুয়াল হেলথ-এ Jahnke, S., Hoyer, J ২০১৩ সালে Stigma against people with pedophilia: A blind spot in stigma research নামে এক নন-ক্লিনিক্যাল সার্ভেতে উল্লেখ করেছেন পেডোফেলিয়া ডিজঅর্ডারে আক্রান্তদের মধ্যে ৪৬% মানুষ আত্মহত্যার কথা ভাবে, ৩২% এটা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় এবং ১৩% আক্রান্ত ব্যক্তি এটিকে এক্সিকিউশন পর্যায়ে নিয়ে যায়। অর্থাৎ, আমাদের দেশের এই পাষণ্ড সাইফুলের মতো নৃশংস ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিশুদের উপর।
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সেক্স্যুয়াল হেলথ-এ Jahnke, S., Hoyer, J ২০১৩ সালে Stigma against people with pedophilia: A blind spot in stigma research নামে এক নন-ক্লিনিক্যাল সার্ভেতে উল্লেখ করেছেন পেডোফেলিয়া ডিজঅর্ডারে আক্রান্তদের মধ্যে ৪৬% মানুষ আত্মহত্যার কথা ভাবে, ৩২% এটা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় এবং ১৩% আক্রান্ত ব্যক্তি এটিকে এক্সিকিউশন পর্যায়ে নিয়ে যায়। অর্থাৎ, আমাদের দেশের এই পাষণ্ড সাইফুলের মতো নৃশংস ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিশুদের উপর।
এতোটুকু থেকেই আমরা বুঝে নিতে পারি এটা একটা মানসিক বিকারগ্রস্ততা এবং বিভিন্ন সাইকো থেরাপি বা কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, যদি সে নৈতিক শিক্ষা পায় এবং সামাজিক পরিবেশ উন্নত হয়। একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষ তার আচরণের জন্য সবসময়ই দায়বদ্ধ, কিন্তু তার কোন চিন্তা বা কোন এট্রাকশন বা আকর্ষণ আসে মস্তিষ্ক থেকে, এটার উপর মানুষের কোনো হাত নেই।
কিন্তু চিন্তা বা এট্রাকশন বা আকর্ষণ আসলেই সেটি এক্সিকিউশনে যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অন্যকে নির্যাতন করতে দেখে বা সামাজিক অনাচার দেখে একজন নির্যাতনকারীকে খুন করার ইচ্ছে আপনার জাগতেই পারে, এই ইচ্ছের উপর আপনার হাত নেই; কিন্তু আপনি কি সেটা করতে যাবেন? নাকি সেই চিন্তাটাকে বাতিল করে দিবেন? একজন সুস্থ মস্তিষ্কের নৈতিক মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ঠিক তেমনি কোনো পেডোফেলিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো শিশুর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করলেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন বিকৃত চিন্তা প্রয়োগ করার জন্য, এটা শুধুমাত্র ডিজঅর্ডারনেসের দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যাবার কোনো কারণ নেই। নিয়ন্ত্রণ-হীনদের জন্যই সমাজে আইনি ব্যবস্থা চালু আছে এবং শাস্তি প্রদানের জন্য বিচার বিভাগ আছে।
এখানে বিচার বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এইসব ক্ষেত্রে দ্রুত এবং যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সচেতন ভাবে। বিচার বিভাগ বা আইনের শাসন সন্তোষজনক হলে সমাজে অপরাধ কমে, কারণ মানুষ এটা দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে বা চেষ্টা করে। যখন কেউ বিচার বিভাগের বা আইনের প্রায়োগিক ব্যর্থতা দেখে তখন সেলফ কন্ট্রোলের বিষয়টি ততোটা গুরুত্ব পায় না তার কাছে। ফলে এসবের প্রায়োগিক সফলতা সমাজকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এবারে আসা যাক সমাজে বাবা-মা বা অভিভাবকদের ভূমিকা প্রসঙ্গে। শিশুদের নিরাপদ শৈশব তাদের বেড়ে উঠার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিশু বয়সের কোনো দুর্ঘটনা সেই শিশুকে সারাজীবনের জন্য ট্রমায় নিয়ে যেতে পারে। যেহেতু শিশুরা শারীরিক ভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম নয় এবং প্রতিবাদ করতেও পারে না, এমন কি এই বিকৃত যৌনাচার গুলোকেও ডিফাইন করতে পারে না- তাই অনেক ক্ষেত্রে ভয়ে এগুলো চেপে যায় অভিভাবকের কাছে। ফলে নিয়মিত ভাবে নিকট আত্মীয়দের মাধ্যমেই নীরব অনাচারের শিকার হয় অনেকেই। কিংবা অসচেতন অভিভাবক এগুলো আমলে নেন না বা বিশ্বাস করেন না, উল্টো বকাবকি করেন নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুকেই। ফলে শিশুরাও অনেক সময় এগুলো বাবা-মা’কে বলে না ভয়ে। তাই বলবো অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে এই বিষয়ে।
শিশু কিছু বললে সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতে হবে। শিশুকে একা কোনোভাবেই দীর্ঘ সময়ের জন্য অন্য কারো সাথে ছাড়া উচিৎ নয় নির্ভরযোগ্য পরিবারের সদস্য ছাড়া। এছাড়া শিশু বয়সেই সেক্স্যুয়াল অরিয়েন্টেশন দরকার বয়সের তারতম্য অনুসারে। আমাদের মতো রক্ষণশীল সমাজে আমরা এসব বিষয় এড়িয়ে যাই বা বিব্রত বোধ করি শিশুদের সাথে আলোচনা করতে। কিন্তু এসব যদি ওদের শেখানো না হয়, বাবা বা মা যদি এসব ইস্যুতে সচেতন করে না তোলে, তবে নীরব সেইসব দুর্ঘটনা সম্পর্কে অনেক সময় তাঁরা জানতেও পারবেন না।
যৌনতা একটা স্বাভাবিক বিষয় এবং এটি নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বয়স অনুসারে সচেতন করে তুলতে হবে শিশুকে। বাচ্চা যেনো এসব বিষয় বাবা-মা’কে বলতে দ্বিধান্বিত না হয় সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে ছোটবেলা থেকেই। মনে রাখতে হবে বাচ্চাদের নির্ভরতার যায়গাটা তাদের মা-বাবাই। এই নির্ভরতা যেনো কোনো ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
রাষ্ট্রের ভূমিকাও অনেক বিস্তৃত এসব শিশু নির্যাতন বন্ধে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনেক আইন থাকলেও সেগুলোর প্রায়োগিক কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও কলকারখানা ঘুরলে হাজারো শিশু পাওয়া যাবে যারা কাজ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এটার জন্য ঐ সব শিশুর বাবা-মা’কে বা অভিভাবককে দোষ দেয়াও পুরোপুরি সমীচীন হবে না। কারণ অর্থনৈতিক ভাবে সমাজে যে বৈষম্য বিদ্যমান সেটার কারণে এবং দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই শিশুকে কাজে পাঠায়। ফলে রাষ্ট্রের বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে আরো বেশি।
কাগজে কলমে মধ্যম আয়ের দেশ ঘোষণা দিয়ে কোনো লাভ নেই, সেটার প্রতিফলন থাকতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরে। এছাড়া নারীর প্রতি সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটার আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। নারীকে কেবল ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখার বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গৃহস্থালি কাজের জন্য উপযোগী মনে করার যে প্রবণতা আমাদের রয়েছে, সেটি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সমাজ উন্নয়নে এদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সামাজিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক ভাবে যাতে সমাজ প্রগতিমুখী হতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এগুলো করতে গেলে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম।
প্রচলিত ফার্স্ট সেকেন্ড হবার বা ক্যারিয়ার গড়ার যে হাট বাজার শিক্ষাঙ্গনে বিরাজ করছে এটা দিয়ে আর যা-ই হোক না কেন নৈতিক শিক্ষিত জাতি আশা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। শিক্ষার দর্শন হতে হবে মানসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভাবে অগ্রগামী মানুষ তৈরি করা। পণ্যের বাজারের উপযোগী পণ্য বিক্রেতা বা উৎপাদক নয়। এসবে মনোযোগ দিতে না পারলে একজন সাইফুলকে তীব্র ঘৃণা করে, শাস্তি নিশ্চিত করে সুনির্দিষ্ট একটি ঘটনায় তৃপ্তি হয়তো আমরা পেতে পারি, কিন্তু সামাজিক শান্তি বা এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে না কোন ভাবেই।
ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কর্মী