লুকানো ডায়েরি থেকে-২

চেনা অপরিচিতা: আমার বাবা-মা দুজনেই উচ্চ শিক্ষিত। দুজনেই সরকারি চাকরি করেছেন, দেশে-বিদেশে ঘুরেছেন, আমার মা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জড়িত ছিলেন একসময়। “পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে” গানটি যখন প্রথম সমর দাস গাওয়ান, সেখানে আমার মায়ের কণ্ঠও ছিল। ছবিতে প্লে ব্যাক করেছেন। আমার বাবা দেশের বাইরে থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কাজ করেছেন। আমার মা আমার কাছে অতুলনীয় হবে সেটাই স্বাভাবিক। আমার বাবা পৃথিবীর সেরা বাবা সেটা আমি ভাবতেই পারি। কিন্তু মানুষ হিসেবে, তাঁরা  ভীষণ কুসংস্কারাছন্ন ছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই মাদুলির সমান তাবিজ পরে বড় হয়েছি। টিকাটুলির হুজুর, আজিমপুরের হুজুর, বাঁশতলির হুজুর (জায়গার নাম ভুলও হতে পারে), আজমাইন হুজুর (বাসায় বসে মিডিয়ামের মাধ্যমে সেই অশরীরী হুজুরকে আনা হতো) এগুলো’র মধ্যে বড় হয়েছি। এগুলো বিশ্বাস করেছি, যেমন আমার মা করতো। আমার মা আমার কাছে কোরান শরিফের মত ছিল। আমি তাকে মনে-প্রাণে ধারণ করেছিলাম।

stop-rape-2আমার এখনও মনে আছে, তখন  ৭/৮ বছর হবে হয়তো। বাসায় এক মহিলাকে আনা হ’লো। তার উপর ভর হয়। সে একই সাথে সুরা আর মা কালী’র নাম নিতে নিতে অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে কাঁপতে নানা অঙ্গভঙ্গি করতে লাগলো। ভীষণ ভয় করছিল। তারপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। ওঠার পর আমার বাবা-মা’কে যে তদবির দিলেন, তা দেখে-শুনে কোথায় পালাবো দিশা পেলাম না আমরা দুই ভাই- বোন।

ভয়ে-ঘেন্নায় বাবা-মায়ের জবরদস্তিতে একটি কালো মুরগির রক্ত মেশানো পানিতে গোসল করতে হ’লো আমাদের সবাইকে।

আমার সিস্ট ধরা পড়ার পর আমার মায়ের ঘুম হারাম হয়ে গেল। হেন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমার মা আমাকে নিয়ে ছোটেননি। ডাক্তারের চেম্বার থেকে হুজুর বাড়ি। মাথা নিচু আর মন ছোট করে থাকতাম। জীবনে অনেক পাপ করেছি, আমি অসতী মেয়ে, তাই বারবার মাটির সাথে মিশে যেতে মন চাইতো।

আজিমপুরে এক হুজুর ছিলেন। আমার মা তাকে বাবা ডাকতেন। পেশায় নাকি পূর্বে তিনি ডাক্তার ছিলেন। সেই হুজুর এখন নেই, মারা গেছেন। মৃতদের নিয়ে কথা বলা সামাজিক অভব্যতা। তাই তার নাম উল্লেখ করছি না। এটাই হয়তো আমার এক্ষেত্রে চরম বদান্যতা। আমার মা তার কাছে আমাকে নিয়ে যেতেন। সিস্ট এর কথা শুনে আমার মা’কে বললেন, কিছুদিন ঝাড়তে হবে। আমার মা শুনে রাজি হলেন। আমি জানি না কিভাবে ঝারবেন। কিন্তু একদিন যখন উনার কাছে ঝারতে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন মনে হলো আমি মরে যাই না কেন!

হুজুর আমার পায়জামা খুলে ঢিলা করে শুয়ে পড়তে বললেন। ভয়ে কাঠ হয়ে তাই করলাম। পর্দার আড়ালে আমার মা। আমি না করলে আমার মা হয়তো আমাকে বাসায় গিয়ে আরও কথা শোনাবে। কিন্তু না, এতে হবে না। নিচের হাফ প্যান্ট ও ঢিলা করতে বললেন। আমি মুখে ওড়না ঢেকে তাই করলাম। উনি আমার যোনির দু পাশে উরুসন্ধি চেপে ধরে ঝারতে লাগলেন। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলাম নারী হওয়ার লাঞ্ছনা। বাড়ি ফিরে থাকতাম মরার মতো। এতো অপমান সত্যি আমার প্রাপ্য ছিল? যেতে চাইতাম না। কিন্তু আমার মা বুঝতো না।

তারপর এলো সেইদিনটা। হুজুর আমায় ঝারছে, আর আমি মুখে ওড়না ঢেকে, অপমানের একরাশ জ্বালা, লজ্জা, কুণ্ঠার দলা গলায় নিয়ে পড়ে আছি। হঠাৎ হুজুর চাপা স্বরে বলে উঠলেন, “তোমার সেক্স কেমন হয়?”

আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। বললাম, “জ্বী?” হুজুরের মুখে একই উচ্চারণ। আমি ভয়ে লজ্জায় শিউরে উঠে বললাম, “জ্বী না… জ্বী না…কিছু হয় না”।

সেটাই ওখানে যাওয়ার শেষ দিন ছিল। বাসায় এসে হাউমাউ করে সব বললাম মাকে। ভাবলাম একটু সহানুভূতি, একটু সান্ত্বনা পাবো। না, আমার মা আমাকেই দোষারোপ করলেন যে, তাকে আমি আগে বলিনি কেন? আমি কী বলতাম তাকে! যাকে তিনি ভক্তিভরে ‘বাবা’ ডাকেন, তিনি তো আমাকে রেপ করেননি, তিনি আমার একটি বিশেষ স্থানে হাত রেখে ঝারছেন। এটা মা হয়ে তিনি অবগত না হয়েই আমাকে ঝারতে দিয়েছিলেন, সেটা আমার চিন্তার বাইরে ছিল।

আমার মায়ের সাথে আমার বয়সের দূরত্ব ৩৪ বছর। তিনি তার ১৭/১৮ বছরের মেয়েকে আড়ালে ঝারতে পাঠাচ্ছেন, অথচ কিভাবে ঝারবেন সেটা না জেনে না বুঝে সেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেটা আমার আজও অবোধ্য। আর হুজুরকে বিরোধিতা করা মানে মাকে বিরোধিতা করা। দিনের পর দিন লজ্জায় অপমানে কুঁকড়ে থেকেছি, কেঁদেছি। সেগুলো দেখেও আমার মা বোঝেননি, সেটাও আমি মানতে পারিনা। আমার কষ্ট, আমার যন্ত্রণা আমি একাই ধারণ করতাম। কেউ ছিল না। তবে সেই কান্নার জেরে আমাকে আর ঐ হুজুরের কাছে যেতে হয়নি। কিন্তু আমার মা যাওয়া বন্ধ করেননি। লাঞ্ছনার শেষ এখানে হলে হয়তো ভাল হতো। কিন্তু একটা মেয়ের জীবনে অপমানের শেষ তো হয় না।

আমার ভাইয়ের এক বন্ধুর বড় ভাই হারবাল চিকিৎসা করতেন। তার লাইসেন্স ছিল কী ছিল না, সেটা আমার জানা নেই। তবে এটা তার প্রধান পেশা ছিল না। তার কাছে নিয়ে গেলেন আমার মা।

খুব লজ্জা হতো। খুব! ছোটবেলা থেকেই ভাইয়ার বন্ধুদের সামনে কখনও আসতাম না। কী যে লজ্জা লাগতো! বড় হওয়ার পর তো প্রশ্নই ওঠে না। সেখানে নিতান্ত মেয়েলী একটা সমস্যায় আমি ভাইয়ের বন্ধুর বড় ভাইয়ের কাছে যাচ্ছি। তিনি বললেন, বাচ্চা হওয়া নিয়ে সমস্যা হবে, এছাড়া আর কোন সমস্যা নেই।

যে বয়সটায় প্রেম, বিয়ে এগুলো মাথাতেও থাকতো না, সে বয়সে আমাকে অনাগত সন্তানের অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে হয়, আমার অদেখা শাশুড়ি কী ভাববে সেটা ভাবতে হয়, সবচেয়ে বড় যে গ্লানি বুকে বাজে সেটা হ’লো- আমি বাঁজা?

একদিন ঐ ভাইয়া আমাকে দেখে ওষুধ দিলেন। আম্মা বললেন, তুমি ওকে একটু ভালভাবে দেখে দাও। তখন উনি একটু ভেবে আমাকে নিয়ে ওনাদের চিলেকোঠার ঘরে গেলেন। আমার বুক ধুকপুক করছিল। ওখানে খাটে আমাকে উপুড় হয়ে শুয়ে পরতে বললেন। তারপর আমার নিম্নাঙ্গের পরিধেয় সরাতে বললেন। এক্ষেত্রেও দুটোই। লজ্জা-ভয় গলার কাছে দপ দপ করছিল। উনি ছোট একটা হাতুড়ি দিয়ে আমার উন্মুক্ত পশ্চাতে কয়েকটা বাড়ি দিলেন। তারপর উঠে পরতে বললেন।

সেদিনের মানসিক অবস্থা নতুন করে নাই বা বললাম। তবে, সেদিন বাসায় গিয়েও জোটেনি খুব একটা সহানুভূতি।

ঐ সময়টা পেরিয়ে এসে পরে মনে হয়েছে, হুজুর যেখানে হাত রেখে ঝারতো, সেখানে আমার ওভারির অবস্থান থাকার কথা নয়। আর ঐ ভাইয়া কেন আমার পশ্চাদদেশ দেখলেন? ওভারির টিউমারের সাথে তার কি সংযোগ ছিল?  যাদের চেহারায় ভদ্রতার প্রলেপ দেওয়া, তারা আসলে কতোটুকু ভদ্র?

সন্তানের কাছে বাবা-মা অনেক কিছু আশা করেন। বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য পালনের ব্যাপারে পৃথিবীতে অনেক কিছু লেখা আছে। নীতিবাক্যের অভাব নেই। কিন্তু, একটা সন্তান তার বাবা-মায়ের কাছে কি আশা করতে পারে আর পারে না সে ব্যাপারে কিছু লেখা থাকে না। এ যেন বলাও পাপ।

শেয়ার করুন: