কাউকে ক্ষমা করিস না পূজা

জেসমিন চৌধুরী: পুরুষের কাম ক্ষুধার বেদীতে বিসর্জিত হলো আরো একজন পূজার শৈশব, সারল্য, শারিরীক সুস্থতা, মানসিক স্বাভাবিকতা। নারী বিষয়ক আমার লেখাগুলোতে যেসব বিদগ্ধ পুরুষ এসে মন্তব্য করেন, ‘শুধু নারীই নির্যাতিত হয় না, পুরুষও নির্যাতিত হয়, আমরা আশা করি আপনার কলম তাদের জন্যও প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠবে’ পূজার উপর এই পাশবিক নির্যাতনে তাদেরকে নীরব থাকতে দেখেছি আমি। সাইবেরিয়ার ঠাণ্ডার মত তিক্ত আপনাদের এই নীরবতা।

আমরা যখন নারী নির্যাতন নিয়ে লিখি, আপনারা তখন পুরুষের অধিকার নিয়ে সরব হয়ে উঠেন, আর পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের উপর ‘অপাশবিক’ (কারণ এর নির্মমতা পাশবিকতাকেও ছাড়িয়ে যায়) নির্যাতনে আপনারা চুপ থাকেন। আমার কাছে আপনাদের আর ঐ ধর্ষকের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ধিক আপনাদেরকে, ধিক আপনাদের শিক্ষা আর জ্ঞানকে, ধিক আপনাদের পংগু পুরুষত্বকেও।

Jesmine Chow 2
জেসমিন চৌধুরী

গত কয়েকদিনের পত্রিকা খুলে দেখুন কতজন নারী বীভৎস নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শুধু কি নারী, যে শিশুর দেহ নারীত্বের পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি, তাকেও কি ছেড়েছেন আপনারা? নারীর পরিপক্ক শরীর দাবি করে না আপনাদের কামক্ষুধা, শুধু একটা ব্যবহারযোগ্য যৌনাঙ্গ পেলেই হলো, আপনারা ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।

আপনি যদি এদের একজন না হয়ে থাকেন, তাহলে নীরব থাকুন, আমি আপনার সাথে কথা বলছি না। আমি কথা বলছি ধর্ষকদের সাথে, কাজে অথবা চিন্তায় নারীকে ধর্ষনের উন্মাদনায় লিপ্ত যারা।

আমার কর্মজীবনে কিছু নির্যাতিত পুরুষ দেখেছি আমি, তাদেরকে নিয়ে লেখার কথাও ভেবেছি, কিন্তু সেই সুযোগ কি আপনারা দিয়েছেন আমাকে? এমন একটা দিন কি গেছে যখন কোন একটা নারীকে, কোন একটা বাচ্চা মেয়েকে ছিন্ন ভিন্ন করার খবর আসেনি পত্রিকায়? আমি আপনাদের কথা লিখতে চাই এবং লিখব, যেদিন আমার কোন বাচ্চা মেয়েকে হাসপাতালের বিছানায় ছিন্ন ভিন্ন যৌনাঙ্গ নিয়ে ডাক্তারের স্পর্শেও কেঁপে কেঁপে উঠতে হবে না। সেদিন আমার হাতে সময় থাকবে আপনার কথা ভাববার, আপনিও যে নির্যাতিত হচ্ছেন তা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলবার ইচ্ছা তার আগে আমার হবে না।

গত কয়েক বছরে আপনারা কয়েকটা ছেলে শিশুকেও মেরে ফেলেছেন পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে, আপনারাই এমনটা পারেন। আপনাদের দ্বারাই সম্ভব। আমরা তখনও সরব ছিলাম, আজো সরব আছি। আমরা সরব থাকব, আপনাদের নীরবতার বরফ গলুক আর না গলুক।

কিছুদিন আগে আবার নারীর অধিকারের দাবীকে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে প্রকাশ করা প্রসংগে অনেক কথাবার্তা, লেখালেখি হয়েছে। চুপ করে দেখেছি, কিছু বলিনি।

rape-victimআমার মতে আজ যেসব নারীরা নারী নির্যাতন নিয়ে লেখালেখি করছেন তারা সবাই অতি মাত্রায় নৈর্ব্যক্তিক। আজ পর্যন্ত তাসলিমা নাসরিন ছাড়া আর কোন নারী লেখককে ঘোমটা ফেলে সাহস করে সরাসরি নিজের কথা বলতে দেখিনি, তোরা আমাকে নির্যাতন করেছিস, আমি তোদের ঘৃণা করি।

এসব লেখকদের লেখায় আমি পর্যবেক্ষণ দেখি, বিশ্লেষণ দেখি, নারীর উপর নির্যাতন নিয়ে তৃতীয় পুরুষে কথা বলতে দেখি, কিন্তু কোন মেয়েকে সাহস করে এগিয়ে এসে বলতে দেখি না, ‘আমার জীবনে এটা ঘটেছে, কাজেই এটা সত্য’।

‘লজ্জাই নারীর ভূষণ’ বলে যে সুপার গ্লু এরা আমাদের ঠোঁটে এঁটে দিয়েছে, তা থেকে মুক্ত হতে পারি না আমরা, সামাজিক কলংকের ভয়ের উর্ধ্বে উঠে নিজের সাথে কী ঘটেছে তা নির্ভয়ে চেঁচিয়ে বলতে পারি না আমরা। এমন ভাবে কথা বলি, প্রতিবাদ করি যেন আরো কারো কথা বলছি, আমার নিজের কথা নয়। নারীর উপর নির্যাতন পত্রিকায় ছাপা হওয়া খবর হয়েই থেকে যায়, আপনার আমার জীবন যুদ্ধের গল্প হয়ে উঠতে পারে না।

ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে এমন অনেক নারীকেই চিনি যারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কিন্তু কখনোই মুখ খুলবেন না, শুধু পূজাদের দুর্দশা দেখে আহা উহু করবেন। আমরা যদি আরো আগে আরো অনৈর্ব্যক্তিক ভাবে রুখে দাঁড়াতাম, অপরাধীদের চিহ্নিত করতাম, তাহলে হয়তো পৃথিবীটা পূজাদের জন্য একটু কম বিপজ্জনক হতো।

আমি দেখেছি অনেক মাকে নিজের মেয়ের উপর যৌন নির্যাতনের কথা লুকিয়ে রাখতে কারণ নির্যাতনকারী একজন আত্মীয় পুরুষ। আমরা যারা নীরব থাকি, আমরা যারা সামাজিক অসম্মানের কথা ভেবে কোন মেয়ের উপর নির্যাতনের কথা গোপন রাখি, আমরা সবাই পূজার পরিণতির জন্য দায়ী। আমরা সবাই অপরাধী। পূজাদের আর্তনাদ আমাদের স্বর্গের স্বপ্নকে ভেংগে দিক। আমাদের ইহকাল, পরকাল নরকময় হোক। নির্বাক পূজার পক্ষ থেকে আজ এই আমার অভিশাপ।

অনেকে দেখেছি অনেক প্রেসক্রিপশন লিখেছেন- এই করুন, সেই করুন। লোকটাকে আগুনে পুড়িয়ে মারুন। যত্তোসব পাগলের প্রলাপ। ধর্ষকের কারখানায় বসে বলছেন একজন মাত্র ধর্ষককে পুড়িয়ে মারার কথা?

নিজের সমস্ত বুদ্ধিমত্তা নিয়েও আমি নিজেও ভেবে পাই না কীভাবে এসব থামানো যেতে পারে। হয়তো সম্পূর্ণভাবে কখনোই নয়, কারণ ধর্ষন মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি যা সে তার সভ্যতা ও সামাজিক বুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, কিন্তু এটাকে কমিয়ে আনা অবশ্যই সম্ভব। কিভাবে কমিয়ে আনা যায় তাও বোধ করি বিশেষায়িত জ্ঞানের ব্যাপার, কিন্তু আমার অল্প বুদ্ধি নিয়ে আমি যা বুঝি তা হলো একটা সমস্যা সমাধান করতে হলে আগে তার অস্তিত্বকে স্বীকার করতে হবে। শুধু মিডিয়াতে হাইলাইটেড হওয়া ঘটনাগুলো নয়, মেনে নিতে হবে ঘরে ঘরে বাবা চাচা ভাই চাকর মাস্টারের হাতে প্রতিনয়ত ঘটতে থাকা যৌন নির্যাতনের কথা।

শিশুদেরকে যৌন নির্যাতনের সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। কে কীভাবে যৌন নির্যাতন করতে পারে তা বুঝিয়ে দিতে হবে। শুধু অপরিচিত নয়, পরিচিত জগতের মানুষদের কাছ থেকেও কীভাবে সাবধান থাকতে হবে তা শেখাতে হবে। আমি একবার একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার এক চাচাতো বোনকে বলেছিলাম তার মেয়েদেরকে এসব বিষয় বুঝিয়ে বলতে। তিনি বললেন, ‘আমার মেয়েদের ইনোসেন্স নষ্ট করতে চাই না’। আমি আমার নিজের মেয়েকে এই বিষয়ে এ্মন প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম যে তার বয়স যখন সাত তখন আমার এক পুরুষ বন্ধু তাকে কোলে নিতে চাইলে সে বলেছিল, ‘আমি আমার মা ছাড়া আর কারো কোলে উঠি না’। আমি জানিনা কোন মেয়ের ইনোসেন্স বেশি নষ্ট হয়, যে এসব বিষয় জানে বলে নিজেকে রক্ষা করতে পারে, নাকি যে নির্যাতনের শিকার হয়।

যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়াকে এখনো একটা লজ্জার কথা ভাবা হয় আমাদের সমাজে, আর মূল সমস্যাটা এখানেই। লজ্জায় আমরা প্রতিবাদও করি রয়ে সয়ে, হিসাব করে। আর তাই আড়ালে আবডালে থেকে থেকে দিনে দিনে আরো হৃষ্ট পুষ্ট হয়ে উঠছে ঘৃণ্যতম এই সামাজিক সমস্যা।

আমি আমার শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছি, তা লুকাইনি কখনো, কারণ এ লজ্জা আমার নয়, যে সমাজ আমাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে এ লজ্জা সেই সমাজের। আর এখন সময় এসেছে এসব কথা আরো স্পষ্ট করে বলবার, যারা এসব করে তাদেরকে চিহ্নিত করবার।

আমি আমার লেখক বন্ধুদের বলতে চাই, অনেক নৈর্ব্যক্তিক থেকেছেন, আর নয়। এবার নিজের গল্পগুলোও সামনে নিয়ে আসুন, সবাইকে জানিয়ে দিন কারা কখন কীভাবে আপনাকে নির্যাতন করেছে। মুখোশ উন্মোচন করুন।

আমার কথাগুলো হয়তো খুব একটা যৌক্তিক শোনাচ্ছে না। যুক্তির নিকুচি করি আমি আজ, যুক্তি কচলায়ে কাসুন্তি বানায়ে খান আপনারা। আমি আজ কন্যা শোকে কাতর, আমাকে অযৌক্তিক ভাবে চেঁচাতে দিন। আমি চিরদিনই বলে এসেছি, আর আজ পূজার কাছে আমার প্রতিশ্রুতি আমি আরো সরব হব, আরো অনেক চেঁচাব।

তুই ভাল হয়ে ওঠ পূজা, তুই বেঁচে থাক, কিন্তু আমাদের কাউকে ক্ষমা করিস না। তুই যেন একদিন উঠে দাঁড়াতে পারিস, আমাদের বিচার করতে পারিস, তোর অগ্নিদৃষ্টি যেন আমাদেরকে পুড়িয়ে একটুখানি মানুষ বানিয়ে তুলতে পারে।

শেয়ার করুন: