মোহছেনা ঝর্ণা: মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে দু:স্বপ্ন দেখে আমার মেয়েটা কেঁদে কেঁদে অভিযোগের সুরে বললো, “মা, তুমি কেন আমাকে বাঁচাওনি? ব্ল্যাক গাড়িটা আমাকে এক্সিডেন্ট করে দিয়েছে, তুমি আমাকে বাঁচাওনি মা” বলে ঘুমের মধ্যেই মেয়ে আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এমন করে কাঁদছিল যে, আমরা ওকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলাম না। পরে অবশ্য ওর বাবা ওকে কাঁধে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করলে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে মেয়ে।
সকালবেলা ওর বাবা অফিস যাওয়ার সময় ওকে জিজ্ঞেস করেছে, মা, তুমি রাতে ঘুমের মধ্যে কেন কান্না করেছো? মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে অভিমানী গলায় বললো, একটা ব্ল্যাক গাড়ি আমাকে এক্সিডেন্ট করে দিয়েছে, মা আমাকে বাঁচায়নি। আমি হাতে ব্যথা পেয়েছি।

মেয়ের বাবা মেয়েকে খুব আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলেছে, তোমার মা কি কখনো এমন করবে? মা তোমাকে অবশ্যই বাঁচাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার মা বেঁচে থাকবে তোমাকে বাঁচাবে, মা। আর বাবা আছি না, বাবা বাঁচাবো তোমাকে।
মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে মা কাল বাঁচায়নি কেন? ওর বাবা জবাব দিল, ওটা তো স্বপ্ন ছিল।
সারাদিন অফিস শেষে মেয়েকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফেরার সময় সাঁই সাঁই করে পাশ দিয়ে যখন গাড়ি চলে যাচ্ছিল, তখন আমি মেয়েকে কোলে তুলে নিতেই ও খুব মায়া মায়া কন্ঠে বললো, আচ্ছা মা, কালকে তুমি আমাকে কেন বাঁচাওনি! ঐ ব্ল্যাক গাড়িটা আমাকে এক্সিডেন্ট করে দিয়েছে, আমি হাতে ব্যথা পেয়েছি, এই বলেই মেয়ে আমার আবার ফুঁপিয়ে ওঠে।
মেয়ের কষ্ট দেখে আমারও কষ্ট হয়। আমি ভাবতে থাকি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আমার ট্রমা কোনোভাবে সংক্রামিত হয়ে আমার মেয়েকে আক্রমণ করলো কিনা!
গতকাল যখন খবর পেলাম দিনাজপুরের পার্বতীপুরের সুবল দাশের পাঁচ বছর বয়সী ছোট্ট মেয়েটাকে চল্লিশোর্ধ এক জানোয়ার সাইফুল ইসলাম ১৮ ঘন্টাব্যাপী নির্যাতন করেছে ( ধর্ষণ শব্দটা লিখতেও কষ্ট হচ্ছে) তখন থেকে খুব অসাড় বোধ করতে লাগলাম।
প্রতিদিন যদি এমন দু:সংবাদের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তাহলে কীভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবো আমরা? পূজা নামের ছোট্ট মা’টা না জানি কী ভয়ংকর কষ্ট আর ঘৃণা নিয়ে আমাদের দিকে তাকাবে, ভাবতেই পারছি না।এই বাচ্চাটা সুস্থভাবে বেড়ে উঠবে তো! কী ভয়ংকর দু:স্বপ্ন তাড়া করে ফিরবে তাকে! আমার মেয়ের চেয়ে সামান্য বড় পূজা। পূজার সাথে ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনা কানে আসার পর থেকে মেয়ের জন্য আবার আতংকিত হয়ে যাই।
আমাদের মেয়েগুলোকে কোথায় রাখবো আমরা?
সারাক্ষণ এই যে আতংক নিয়ে থাকি, ভাবি, আমার এই আতংকই না জানি আমার মেয়ের মধ্যে সংক্রামিত হয় কিনা!
কিছুদিন আগে কোরবানির ঈদের সময় পত্রিকায় পড়েছিলাম এবং টিভিতে দেখেছিলাম বাসায় কাজ করা ছোট্ট একটা মেয়ে ঈদে বাড়িতে যেতে চেয়েছিল বলে কী নির্মমভাবে মেয়েটার শরীরটা খুন্তি দিয়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল, ক্ষত-বিক্ষত করেছিল গৃহকর্ত্রী।
সিলেটের ছোট্ট রাজনের ছবিটা টিভিতে কিংবা পত্রিকায় প্রথম প্রথম দু’একবার আমার মেয়ের চোখে পড়ে গিয়েছিল। ছোট্ট মনেও ওর প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল। রাজনের ছবি দেখলেই জিজ্ঞেস করতো, মা, বেবিটা কেন কান্না করছে? বাবা, বেবিটাকে ওরা মারছে কেন?
এরপর থেকে টিভি বা পত্রিকায় অস্বাভাবিক কোনো খবর দেখতে পেলে আমরাই সচেতনভাবে তা সরিয়ে ফেলি যেন মেয়ের চোখে না পড়ে।
আহা! এতো কষ্টের সন্তান, এতো আদরের সন্তান, সে কিনা ক্ষত-বিক্ষত হয় হায়েনার হাতে, জানোয়ারের হাতে, শুয়োরের হাতে…..আমরা মায়েরা পারি না সন্তানদের বাঁচাতে…..। বাস্তবে পারি না, এমনকি স্বপ্নেও পারি না। এমন ব্যর্থ মা হয়ে বেঁচে থাকার কষ্টের সীমাও অসীম…..।
পূজা মা’টার শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাও কামনা করি। সময় লাগবে, কষ্ট হবে, যন্ত্রণা হবে অনেক, তবু তার কাছের মানুষদের ভালোবাসায় যেন এই দু:স্বপ্নের প্রহর কাটিয়ে উঠতে পারে সে, একজন মা হয়ে সেই দোয়াই করি।
ধর্ষক সাইফুল ইসলামের লিঙ্গ কর্তনের মহোৎসব যেন দেখতে পাই টিভিতে , পত্রিকার শিরোনামে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাইরাল নিউজে….।