‘তুই আর জন্মাইস না, পূজা’

চৈতী আহমেদ: একটি ঘা শুকোতে না শুকোতেই আরেকটি ক্ষত তৈরি হয় আমার শরীরে, নারীর শরীরে, নারীবাদের শরীরে। এই সমাজ-রাষ্ট্র ধর্ষক-বান্ধব সমাজ-রাষ্ট্র। এই সমাজ-রাষ্ট্র ভাবমূর্তি-বান্ধব সমাজ-রাষ্ট্র। এই সমাজে-রাষ্ট্রে একটি ধর্ষণ কাণ্ড স্মৃতি হবার আগেই আরেকটি ধর্ষণ এসে ফিকে করে দেয় আগের ধর্ষণটিকে। এই সমাজ রাষ্ট্রে ব্যর্থ প্রেমিকের একটি ছুরিকাঘাতের যন্ত্রণার উপশম হবার অবসর মেলে না, উপুর্যপরি সংবাদ আসতে থাকে একের পর এক নারীর শরীরে ছুরিকাঘাতের। তবু এই সমাজ রাষ্ট্রের টনক নড়ে না।

পার্বতীপুরের পাঁচ বছরের পূজাকে ধর্ষণের প্রতিবাদে পোস্ট লিখতে লিখতেই ফেসবুক ওয়ালে ভেসে উঠলো নিউ স্টোরির নোটিফিকেশন, আরেক পূজার আক্রান্ত হবার সংবাদ- “ঝিনাইদহে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় জমিলা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী পূজাকে ছুরিকাঘাতে আহত করেছে এক বখাটে”।

chaity-2
চৈতী আহমেদ

এইসব সংবাদে আমরা আগে আগে তেড়ে ফুঁসে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতাম। প্রতিবাদ জানাতাম। ধর্ষক/হত্যাকারীর শাস্তির দাবিতে মরিয়া হয়ে উঠতাম।

তনু হত্যার দাবিতেও আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম। সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিলো তনুর সহপাঠিরা, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা এক্টিভিস্টরাও, কলম কী-বোর্ড ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, যতক্ষণ তনু হত্যাকারীদের সনাক্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া না হবে ততক্ষণ ঘরে ফিরবো না। কিন্তু আন্দোলনকারীদের খালি হাতেই ফিরতে হলো।

কারণ হত্যাকারী হিসেবে সনাক্তকরণের আঙ্গুল যার দিকে নির্দেশিত হয়েছে তনুর জীবনের চেয়ে, তনুর পরিবারের সম্মানের চেয়ে তনুর ধর্ষণকারী/হত্যাকারীর ভাবমূর্তি রক্ষা করা রাষ্ট্রের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীয়মান হওয়ায়, জলকামান টিয়ারশেলের কাছে ম্রিয়মাণ হয়ে গেলো তনু হত্যার প্রতিবাদ। তনুর বাবা-মা চোখের জল মুছে বুকের ভেতর ধারণ করলো ধিকি ধিকি তুষের অনল। বিচারের বাণী পুড়তে থাকলো সেই অনলে।

ক’দিন যেতে না যেতেই ওবায়দুল খান নামের দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে আহত রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তার রিশা (১৪) মারা গেলে আবারও উত্তাল হলো রাজপথ, প্রতিবাদে ফেটে পড়লো শিক্ষার্থী/এক্টিভিস্টরা।

ওবায়দুলকে ধরা পড়তেই হলো, কারণ টেইলার্স এর কর্মী ওবায়দুলের কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক ভাবমূর্তিই ছিলো না। অবশ্য ঐ ধরা পড়া পর্যন্তই। ধরা পড়লে কী হবে, ওবায়দুল তো এই পুরুষতন্ত্র-বান্ধব সমাজেরই একজন। তাই হয়তো ওবায়দুল ধরা পড়ার সাথে সাথে ততোধিক পুরুষ-বান্ধব মিডিয়ার কাছে রিশা হত্যাকাণ্ডের সাসপেন্স খতম। আমাদের মিডিয়া আবার ব্রেকিং ছাড়া খবর উল্টে দেখে না। রিশা হত্যার আর কোনো আপডেট নাই। জানা যায় নাই ওবায়দুল তলে তলে কোনো ভাবমূর্তির সার্টিফিকেট দাখিল করে পগার পার হতে পেরেছে কিনা!

ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী আফসানার ধর্ষণকারী/হত্যাকারী সোনার ছেলের সোনার ভাবমূর্তির কারণে আফসানার ধর্ষণ/হত্যার তদন্ত হিমঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।

রিশার বাবা মায়ের বুকের অনলের খবর নেবো নেবো ভাবছিলাম। তার মধ্যেই ব্রেকিং হিসেবে চলে আসলো খাদিজাকে কোপানোর লাইভ ভিডিও।

পর্ন ভিডিওর মতোই খাদিজার ক্ষত-বিক্ষত মাথার ভিডিও ভাইরাল হতে থাকলো। একটি মর্ষকামী মহল এই ভিডিও নির্মমভাবে শেয়ার দিয়ে হিট কামাতে লাগলো। তারা ভাবলোও না, এই ভিডিওরও কোনো খারাপ ইম্পেক্টও পড়তে পারে সমাজে। তারা যুক্তি হিসেবে ‘আঘাত করে মানুষকে জাগানোর তরিকাকে এডপ্ট করলো। তারা ভাবলো না, এই ভিডিও খাদিজার পরিবারের জন্যও মরা উপর খাড়ার ঘা হিসেবে পড়তে পারে।

এই মহলটিকেই আমি বলি মর্ষকামী, কোনো মানবিক আবেদনই এই মহলটিকে তাদের প্রবণতা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এই মর্ষকামীরা অপ্রতিরোধ্য ভাবে শেয়ার দিতে থাকে খাদিজার ক্ষত-বিক্ষত মাথামুখের ছবি। এদেরকে আমি বদরুলের চেয়ে কম নৃশংস ভাবতে পারি না।

আইসিইউ থেকে বেআইনীভাবে ধারণ করা ছবি হাতে পাওয়ার সাথে সাথে মর্ষকামী লাইক বুভুক্ষু মহল তা ফেসবুকে ব্লগে পোস্ট দিয়ে তাদের অবদমিত হত্যা প্রবণতার দরুন মানুষের সংবেদনশীল অনুভূতিকে নির্বিবেচক কোপাতে থাকে অনবরত।

প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে খাদিজাকে কুপিয়ে আহত করেছে বদরুল নামক সোনার ছেলে। এই সোনার ছেলের ভাবমূর্তি তেমন খাঁটি সোনার ছিলো না, ছিলো হয়তো গোল্ড প্লেটেড, এখন পর্যন্ত। যার কারণে তাকেও ধরা হলো এবং এটিও যথারীতি হিমঘরে হিমজাত প্রক্রিয়াধীন।

মনে হলো -আমার সর্র্ব অঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দেবো কোথা?

এই সমাজ রাষ্ট্র কি আমাকে এক দণ্ডের তরেও ক্ষমিছে? নারীকে ক্ষমিছে?

উত্তর হলো -না। বিচারহীনতার এক অভব্য সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে এই সমাজ ধর্ম রাষ্ট্র প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে ধর্ষককে, হত্যাকারীকে, নারীর প্রতি অসহনশীলতাকে, শিশুর প্রতি নির্মমতাকে। এই বিচারহীনতাই পুরুষকে করে তুলেছে আগ্রাসী ডেসপারেট। পুরুষলিঙ্গকে করে তুলেছে বেপোরোয়া বেত্তমিজ।

আজ এই সমাজ রাষ্ট্রের প্রশ্রয়েই প্রতিটি পুরুষই একেকজন সাসপেক্টেড ধর্ষকযতক্ষণ সে কাউকে ধর্ষণ না করছে ততক্ষণ তো তাকে ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত করার উপায় নেই। কোনো পুরুষ কি বলতে পারবে কখন কোন নারী/শিশুকে দেখে তার পুরুষতান্ত্রিক মন্ত্র দীক্ষিত লিঙ্গ উত্থিত হবে? এই উত্থিত লিঙ্গের সামনে সে যাকে পাবে তাকেই ধর্ষণ করবে। উত্থিত লিঙ্গের আওতায় যে নারী বা শিশু উপস্থিত থাকবে তাকেই ধর্ষণের জন্য দায়ী করা হবে।

ধর্ষণের চলমান বিচার প্রক্রিয়াও ধর্ষক বান্ধব। একজন নারী বা শিশু যে ধর্ষিত হয়েছে তা প্রমাণের জন্য নারী বা শিশুটিকে যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তা সেই নারী এবং শিশুটিকে শতবার ধর্ষিত হওয়ার অভিজ্ঞতা সরবরাহ করে। অগত্যা নারী বা শিশুটি বাধ্য হয় -ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা সামলা” অনুভূতি নিয়ে বিচারালয় থেকে বেরিয়ে আসতে?

আড়ালে হাসে আইন প্রণেতা, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র- “অ মনু ধর্ষণের বিচার চাওয়ার মজা বোজ্জো”?

এই সমাজ ধর্ষকের উত্থিত লিঙ্গকে জাস্টিফাই করার জন্য ধর্ম বানানো হয়েছে, রাষ্ট্রের সাহস নেই ধর্মকে চ্যালেঞ্জ করার। ধর্মই যে রাষ্ট্রের কপালে রাজটীকার স্থান দখল করে আছে।

তাহলে পরিত্রাণ কীসে, এইসব পুরুষদের ভাদ্র মাসের কুত্তারোগ থেকে? নারী এবং শিশুগণ পুরুষের লিঙ্গের দিকে সতর্ক নজর রাখা চর্চা করা ছাড়া আর উপায় নেই। নারী/শিশুর মুহূর্তের অসতর্কতায় পুরুষের উত্থিত লিঙ্গের সামনে পড়ে গেলে, পুরুষ তার কোনো দায় বহনে বাধ্য নয়। ধর্ম দিয়েছে তাকে এই দায়মু্ক্তি, রাষ্ট্রের অদ্ভুতুড়ে বিচার ব্যবস্থা এবং আইনও পুরুষকে এই বাধ্যতা থেকে মুক্তি দিয়েছে, দিয়ে যাচ্ছে।

আজ পর্যন্ত শুনেছেন কোনো ধর্ষক এর যথাযথ শাস্তি হয়েছে? এই ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রতো পুরুষের ধর্ষকামিতাকে জায়েজ করার জন্যই তার বেহায়া আইন বলবৎ রেখেছে। ধর্ষিত/ধর্ষিতাকেই প্রমাণ করতে হয় যে সে ধর্ষিত হয়েছে। বলদ আইন এটা ভাবে না যে যে ধর্ষণ করে সে ধর্ষিতা ছাড়া আর কাউকে সাক্ষি রাখে না। সব ক্ষেত্রে আবার ধর্ষিতাকেও সাক্ষি হিসেবে বেঁচে থাকতে দেয় না। তনুকে তার ধর্ষক বাঁচতে দেয়নি।

পূজা! আমার পাঁচ বছরের দুগ্ধপোষ্য অবোধ শিশুটি, তাকে ১৮ ঘন্টাব্যাপী ধর্ষণ করেছে, মধ্য বয়স্ক কাঠ ব্যবসায়ী সাইফুল্লাহ, তার প্রতিবেশী কবিরাজকে সঙ্গে নিয়ে। পূজার গোপনাঙ্গে ঠেসে দিয়েছে জলন্ত সিগারেট!

উফ যত ভাবছি ততই অসহায় ক্রোধে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।

আমি মনে করি না, শুধুমাত্র জৈবিক তাড়না বা উথিত লিঙ্গকে প্রশমনের তাড়নায় সে পূজাকে এভাবে ক্ষত-বিক্ষত করেছে, আমি মনে করি তার ভেতরে সমাজ ধর্মের প্রশ্রয়ে পুষেছে সে নারীর প্রতি পুরুষতন্ত্রলভ্য ঘৃণা, ক্রোধ, দলিতাভিলাষ। না হলে সে শুধু ধর্ষণেই ক্ষান্ত থাকতো, পূজার গোপনাঙ্গে জলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিতো না।

সাইফুল্লাহ ধর্ষণ করেছে, সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছে, পরিশেষে মৃত ভেবে সরিষা ক্ষেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে দুধের শিশু পূজার শরীর। তারপরও কি তোর রেহাই আছেরে পূজা? তুই হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর সাথে যুজছিস, আর এদিকে সক্রিয় হয়ে উঠেছে সেই একই মর্ষকামী মহল- তোর ক্ষত-বিক্ষত শরীরের ছবি যে পড়েছে তাদের হাতে। তাদের লাইক চাই, তোর সেই শরীর শেয়ার দিয়ে।

পিশাচ সাইফুল্লাহ আর তার জলন্ত সিগারেট তোকে মারতে পারেনি, এই সব তথাকথিত এক্টিভিস্টরা তোকে বাঁচতে দেবে নারে। ওয়ান্টেড সাইফুল্লাহ’র ছবি সেভাবে ভাইরাল হয়নি, যত হয়েছে আহত তোর শরীরের। মর্ষকামীরা তোর শরীরে হয়তো খুঁজে ফিরছে পিশাচ সাইফুল্লাহ’র নখের আচড়, সিগারেটের ছ্যাঁকা, তৃষিত হয়ে আছে তাদের গোপন প্রবৃত্তি।

আহত তোর ছবিতে তারা খুঁজে ফিরছে, কোথায় তোর সেই উত্তেজক পোষাক? কোথায় তোর পাঁচ বছর বয়সী শরীরের বাঁক? যা দেখে নিষ্পাপ পুরুষের অনিবার্য ধার্মিক লিঙ্গ দাঁড়িয়ে যায়?

পূজা! সাহসী বাচ্চা আমার, এতো কিছুর পরও তুই বেঁচে আছিস, আমি জানি না, তুই কতটুকু বেঁচে আছিস!

তুই মরে যা পূজা! বাচ্চাটা আমার! কী করবি বেঁচে? এই সমাজ তোকে বাঁচতে দেবে ভেবেছিস? ধর্ষক তোকে প্রাণ ভিক্ষা দিলেও এই সমাজ তোকে বাঁচতে দেবে না। তারা তোর ধর্ষিত শরীর হরেক মিডিয়াতে প্রকাশ করবে এবং ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে তোর পাঁচ বছরের শরীরে কোথায় কোথায় ধর্ষককে উত্তেজিত করার এলিমেন্ট লুকিয়ে আছে তা খুঁজে বের করবে। কারণ ধর্ষককে নিরাপদে ধর্ষণের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেবার জন্যই যে আইন এর সুক্ষ্ণ সব ফাঁকফোকর। ধর্ষককে বাঁচিয়ে দেবার জন্যই যে ধর্মের যত অলিগলি মারপ্যাঁচ, তুই কি এই প্যাঁচ খুলতে পারবি?

তাই বলি, পূজা তুই মরে যা। সবচেয়ে ভালো হয় এই পুরুষের সমাজে তুই আর জন্মাইস না পূজা! কাল যারা তোকে ধর্ষণের প্রতিবাদে রাস্তায় নামবে, বা নেমেছে, তাদের মধ্যেই ভবিষ্যতের ধর্ষক ঘাপটি মেরে নেই, কে বলতে পারে?

বি. দ্র. লেখাটি যখন সম্পাদক বরাবর পাঠিয়ে দিয়েছি, তখন সংবাদ এসে ধাক্কা দিলো -প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরে মুন্নি আক্তার নামের এক স্কুলছাত্রীকে হত্যা করেছে আরেক পুরুষ।

শেয়ার করুন: