সুরাইয়া আবেদীন: এই জীবনে দেখা বহু সিনেমার মধ্যে হাতে গোনা কিছু সিনেমা আছে যা দেখার পর ‘আবার দেখি’ এবং ‘কেন দেখলাম ধুর’ এই দুই অনুভূতির মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। একদিকে ‘আবার’ দেখার তীব্র ইচ্ছা এবং দেখে কষ্ট পেয়ে ‘আর না দেখা’র প্রবল আকাঙ্ক্ষা-মনে আর মগজে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করে।
‘The Imitation Game’ এমন এক মুভি। গণিতবিদ অ্যালান টুরিং এর জীবনের উপর নির্মিত শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অসাধারণ এই মুভির যে অংশ নিয়ে কথা বলতে চাই তা হলো ‘কেমিক্যাল ক্যাসট্রেশন’।
যদিও এই মুভিতে কেমিক্যাল ক্যাসট্রেশনের প্রেক্ষাপট ছিল সমকামিতা, কিন্তু এটা যে কত ভয়াবহ, অমানবিক, নিষ্ঠুর একটা শাস্তি তার ধারণা, এই মুভি কিছুটা হলেও দিতে পেরেছে।
এবার মূল আলোচনায় যাই।
‘ধর্ষণ’ শব্দটার সাথে পরিচিত হই ১৯৯৮ সালে। তখন আমার শৈশব চলছে। বাসায় সংবাদ, ইত্তেফাক, ভোরের কাগজ-এই তিন পত্রিকা রাখা হতো। ১৯৯৮ সালে যেদিন শাজনীন ধর্ষণ-হত্যা এসব পত্রিকার শিরোনাম হলো, সেদিন সর্বপ্রথম ‘ধর্ষণ’ নামক জঘন্য, অমানবিক প্রক্রিয়ার সাথে আমার পরিচয় হয়। স্পষ্ট মনে আছে ‘ধর্ষণ’ কি তা একদমই বুঝি নাই, কিন্তু শাজনীনের জন্য আমার খুব বেশি কষ্ট হয়েছিল।
একটা মেয়েকে ‘কেন’ এভাবে মেরে ফেলবে, মেয়েটার ‘কী’ অপরাধ, লোকটা ‘কেন’ এমন করলো- এই ‘কী’ এবং ‘কেন’র উত্তর শৈশবের আমি যেমন খুঁজে পাইনি, আজ এতো বছর পরে পাঁচ বছরের পূজা দাস ধর্ষণের বেলায়ও খুঁজে পাই না।
এই ‘কেন’ এবং ‘কী’ এর উত্তর কে দেবে?
সোশিওলজি, ফিলসফি, সাইকোলজি, বায়োলজি- যাই বলি না কেন যে উত্তর কিংবা ব্যাখা দেবার চেষ্টা করে তার কোনটাই আমার কাছে মানবিক, গ্রহণযোগ্য মনে হয় না।
বাবা মেয়েকে ধর্ষণ করে- এর ব্যাখ্যা সোশিওলজি, ফিলসফি, সাইকোলজি, বায়োলজি- দিতে পারবে? এর কোনো ব্যাখ্যা হয়?
পাঁচ বছরের শিশু পূজা দাস! জড়ায়ু ছিঁড়ে ফেলেছে ধর্ষক। ব্যাখ্যা কী? পোশাক থিওরি, শরীর ঢাকলো না কেন থিওরি- এখানে কী বলে?
বিবিসি ফোর এর ‘ইন্ডিয়াস ডটার’ তথ্যচিত্রে নির্ভয়ার ধর্ষক মুকেশ সিং বলেছিল ”’রাত ৯টার পর যে মেয়েরা বাড়ির বাইরে বেরোয় তাদের উদ্দেশ্যই থাকে পুরুষদের আকৃষ্ট করা। ধর্ষিত হওয়ার সময় বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করাই উচিৎ হয়নি মেয়েটির। চুপ করে থেকে ধর্ষণ হতে দিলে আমরা ওকে মারতাম না। ধর্ষণের পর আমরা মেয়েটিকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছিলাম।”
পাঁচ বছরের শিশু রাত ৯ টায় বের হয় না। অফিস থেকেও ফেরে না। পুরুষদের আকৃষ্ট করা পাঁচ বছরের শিশুর পক্ষে সম্ভব না। এই ক্ষেত্রে মুকেশ কী বলতো জানতে ইচ্ছা করে। অনুমান করি নিশ্চয়ই কিছু একটা ‘কারণ’ সে বের করে ফেলতো!
ধর্ষকদের ‘কারণ’ এর অভাব নাই। পূজা দাস এর ধর্ষককে জিজ্ঞেস করলে দেখা যাবে সে কিছু না কিছু কারণ’ বের করে দেখিয়ে দিবে যে দোষ পাঁচ বছরের এই শিশুটারই। পাঁচ বছরের একটা দুধের শিশু ধর্ষণ হয় যে দেশে, সে দেশে মান্ধাতা আমলের শিথিল আইন সংস্কার করে ধর্ষণে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ‘মৃত্যুদণ্ড’ অত্যন্ত অল্প সময়ের এবং মানবিক বলেই প্রতীয়মান হয়। ধর্ষণের শিকার মেয়েটির মৃত্যু, অপমান কিংবা কষ্ট ‘অত্যন্ত অল্প সময়ের’ কিংবা ‘মানবিক’ কোনটাই না। বরং ভয়াবহ যন্ত্রণার আর অপমানের।
তাই মৃত্যুদণ্ডের বদলে ধর্ষণের শাস্তি ‘কেমিক্যাল ক্যাসট্রেশন’ করা হোক। সরকার ১০ জন ধর্ষকের উপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করুক। যাদের উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে পেপারে, টিভিতে তাদের পরিণতি দেখানো হোক। ধর্ষণ কমে আসবে আশা করা যায়।
‘কেমিক্যাল ক্যাসট্রেশন’ এর প্রধান কাজ যৌন ক্ষমতা হ্রাস করা। তবে চমৎকার ব্যপার হলো এর সাইড ইফেক্ট ভয়াবহ। সাইকোলজিক্যাল, ফিজিক্যাল সব মিলিয়ে ‘কেমিক্যাল ক্যাসট্রেশন’ আরোপিত ব্যক্তি এক সময় আত্মহত্যা করতে চায় বা করে ফেলে,. ধর্ষকের এমন ভয়াবহ শাস্তিই কি প্রাপ্য নয়?
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘কেমিক্যাল ক্যাসট্রেশন’ সেক্স অফেন্ডারদের শাস্তি হিসেবে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের আইনে খুব শীঘ্রই এর অন্তর্ভুক্তি এখন অত্যন্ত প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে অনুরোধ করি এ ব্যাপারে দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেয়া হোক।
চরমভাবে একমত। অন্যান্য দেশ পারলে আমাদের ও করা উচিত। শুধু তাই না, যেকোন উপায়ে আমাদেরকে সিলগালা করে দিতে হবে, যাতে করে দেখলেই চেনা যায় আমরা ধর্ষক। কাপুরুষ হিসাবে লজ্জিত।