লীনা দিলরুবা: বর্তমানে মেয়েরা চাকুরী বা ব্যবসায় নিয়োজিত আছে বিপুল সংখ্যায়। সেখানে তারা কেমন অাছে বা কেমন করছে সেদিক থেকে যদি দেখতে যাই তাহলে দেখবো তারা নানা প্রতিকূলতা এড়িয়ে পেশাগত জীবনে দৃঢ় অবস্থান নেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে এখনো। নারীদের জন্য সবকিছুই খুব সরল বা সহজ হয় না। নারীর পেশাগত জীবনে ভেতর বাহিরের নানা কাঁটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
এখানে কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতার এবং ঘটনার সন্নিবেশ ঘটিয়ে পেশাগত জীবনে নারীর সুবিধা-অসুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেইসঙ্গে যে অসুবিধাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে তার স্বরূপ চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণের কিছু উপায় নিয়েও আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

পেশার ধরন বিবেচনা করে নারীর কাজের দুটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা যায়। একটি হলো ব্যবসা। আরেকটি চাকুরী। ব্যবসা স্বাধীন। চাকুরী অন্যের অধীন। তবে বাংলাদেশে ব্যবসার সবকিছু এত বেশি চ্যালেঞ্জিং যে ব্যবসা অনেক ক্ষেত্রেই অন্যের অধীন হয়ে পড়ে। সেটি আবার একজন নারীর ক্ষেত্রে পুরুষের চাইতে বেশি কঠিন।
গত প্রায় পনেরবছর ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে ব্যবসা এবং চাকুরীতে নারীর অংশগ্রহনের যে পরিসংখ্যান প্রত্যক্ষ করেছি সেখানে সাফল্যের বাতি অনেকের জীবনে যেমন জ্বলজ্বল করে জ্বলতে দেখেছি, তেমনি ব্যর্থতার বেদনাও তাদের অনেককেই পুড়তে দেখেছি। চাকুরীরত কোনো নারী একজন পুরুষের চেয়ে বেশি বাঁধা এড়িয়ে তারপর চাকুরী করতে আসেন। নারীকে বাঁধা সইতে হয় ঘরে এবং বাইরে। পুরুষের ক্ষেত্রে এর একটিই যদিও প্রযোজ্য।
নারীকে ঘরের সবকিছু সামলে তারপর কাজের জায়গায় প্রবেশ করতে হয়। সেই কর্মপরিবেশে নারী পুরুষ উভয়ের এগিয়ে যাবার জন্য, নিজের সক্ষমতা প্রমান করার জন্য সমান চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করে আছে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তাকে পুরুষের সমানতালে কাজ করতে হয়।
একজন কর্মজীবী নারী তাই ঘরে-বাইরে সমস্ত কিছু সামলে যদি কাজে সফল হন সেটি যে কোনো কিছু বিবেচনায় কঠিন। আমাদের দেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু একক পরিবারের প্রেক্ষাপটে এটি আরো কঠিন কারণ একজন নারীকে তার পরিবারের এবং সন্তানের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করেই বাইরে আসতে হয়। সন্তান লালন-পালনে আমাদের দেশে এখনো মা’কেই প্রধান এবং অনেকক্ষেত্রে একমাত্র ভূমিকা পালন করতে হয়।
একটি কেস স্টাডির কথা এ-প্রসঙ্গে উঠে আসতে পারে।
বাচ্চা রাখবে কে, তাই চাকুরী ছেড়ে দিলেন সামিয়া
সামিয়া কবীর (বাঞ্চিত কারণে নাম পালটে দেয়া হলো) একটি উন্নয়ন সংস্থায় উচ্চ বেতনে চাকুরী করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে লেখাপড়া করা সামিয়ার স্বামীও কর্মজীবি। তিনি চাকুরী করেন একটি বিদেশী সংস্থার মানব উন্নয়ন বিভাগে। দুজনার চাকুরীতে তাদের বেশ চলে যায়। কিছুদিন পর নিজের গর্ভে সন্তান ধারণ করেন সামিয়া। সন্তানের আগমণের খবরে তাদের যৌথজীবনে একদিকে আনন্দের হাওয়া বয়ে গেলেও অন্যদিকে অজানা আশঙ্কায় কুঁকড়ে যান সামিয়া। এটি তার কাছে বোধগম্য যে, তাদের অনাগত সন্তানের আগমন যেমন তাদের যৌথজীবনে অতি কাঙ্ক্ষার তেমনি তাকে সুরক্ষিতভাবে লালন-পালনও অতি গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়।
দিন-মাস যায়, সামিয়ার সন্তান মায়ের গর্ভে বড় হতে থাকে। সামিয়া ঘরের কাজ, কর্মস্থলের কাজ সামলে দিন অতিবাহিত করে। একদিন আগত হয় সেই কাঙ্ক্ষিত শিশু, এক টুকটুকে রাজকন্যা। সামিয়ার যেন মনে হতে থাকে তার সবকিছু এখন পূর্ণ হলো। কর্মক্ষেত্র থেকে সামিয়া ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পায়। এই ছয় মাসের একটি একটি দিন সামিয়া তার শিশুকন্যাকে যত্ন করে, ভালোবাসা দিয়ে বড় করতে থাকে থাকে। শুনতে ছয় মাস মনে হলেও সামিয়ার কাছে সেটি অত্যল্প মনে হয়, কারণ এর পরেই তো তাকে কঠিন জীবনের মুখোমুখি হতে হবে। সামিয়া চাকুরীতে গেলে তার বাচ্চা রাখবে কে? এই আপাত সরল কিন্তু অতি জটিল প্রশ্নের উত্তর না করতে পেরে সামিয়া দুশ্চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে।
একদিন তার মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ হয়। সামনে চলে আসে সেই নিষ্ঠুর সত্য। মা কাজে গেলে বাচ্চা রাখবে কে? সামিয়ার আর অফিসে যাওয়া হয় না। চরম সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে একদিন সামিয়া চাকুরীতে ইস্তফা পত্র দিয়ে আসে।
আমাদের চারপাশে সামিয়া একা নয়, যাকে সন্তানের লালনপালনের জন্য চাকুরী ছেড়ে দিতে হয়েছে। বর্তমানের দুর্মুল্যের বাজারে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের চাকুরী যেমন সংসারের জন্য জরুরী তেমনিভাবে সন্তানের সুরক্ষা আর নিরাপদ বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করাও জরুরী। কোনোটিকেই পিছিয়ে রাখার কোনো কারণ নেই। এক্ষেত্রে আপোষ করারও যেহেতু উপায় নেই তাই সামিয়াদের মতো নিরুপায় মেয়েদের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে চাকুরীটাই ছেড়ে দিয়ে আসতে হয়।
সমাধানের সম্ভাব্য উপায়
সামিয়ার মতো মেয়েরা নিশ্চয়ই চাকুরী ছেড়ে দেবেন না। এটি কোনো সমাধানও নয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কাছে সামিয়া তার সন্তানের সুরক্ষার বিষয়টি দাবী করতে পারে ; কারণ একজন কর্মজীবী নারী সন্তানকে নিরাপদে কোথাও রেখে কাজের জায়গায় যেতে পারবেন এটি তার অধিকারের মধ্যে পড়ে। মৌলিক অধিকারের সংজ্ঞা এখন প্রলম্বিত হয়েছে, নিরাপদ মাতৃত্ব এখন ব্যক্তির অধিকার। এর সূত্র ধরে নিরাপদে সন্তান পালনও। সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে নারীর যে ক্রাইসিস তার সমাধান করতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সর্বসাধারণকে। প্রয়োজন বেসরকারি উদ্যোগেরও।
আমাদের ‘নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ প্রতি বছর নারী ও শিশুদের জন্য একটি বড় বাজেট নিয়ে কাজ করেন, এক্ষেত্রে এই সংস্থটির মাধ্যমে সরকার শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে ডে-কেয়ার সেন্টার খুলতে পারে। সেই সেন্টারগুলোতে মায়েরা তাদের সন্তানকে রেখে কর্মক্ষেত্রে চলে যেতে পারবেন এবং দিনশেষে সন্তানকে নিয়ে ঘরে ফিরে যেতে পারবেন। বর্তমানে এই শহরে খুবই স্বল্প পরিমাণে এ-সেবাটি পাওয়া গেলেও সেটির জন্য যে পয়সা গুনতে হয়, সেটি স্বল্পআয়ের কর্মজীবী মায়েদের পক্ষে বহনযোগ্য নয়।
তাই সরকার যদি এগিয়ে আসে তবে পাড়ায়-পাড়ায়, ওয়াডে-ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে সববয়সের শিশুদের জন্য একটি করে ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করা খুব কঠিন কোনো কাজ হবে না। আমাদের তৈরী পোষাকশিল্প কারখানাগুলোতে যে বিপুল পরিমাণে নারী শ্রমিক কাজ করেন তাদের অনেকের জন্য এই সুবিধাটি খুবই কার্যকর হবে। প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা গেলে সেখানে অসংখ্য নারীও কাজের সুবিধা পাবে। এটি তাদের জীবনমান উন্নত করবে, পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা দূরীকরণে ডে-কেয়ার সেন্টারগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে।
নারীর ব্যবসা, কীভাবে চলছে, গতিধারা কেমন?
আগেই বলেছি ব্যবসা সহজ কাজ নয়। স্ব-উদ্যোগে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে সেটির মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা কষ্টসাপেক্ষ বিষয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিল্পের কাঁচামালের দামের উঠানামা, সরকারি সংস্থাগুলোতে স্পিডমানির লেনদেন, চাঁদাবাজি, বিদ্যুৎ সহ জ্বালানীর ঘাটতি, পণ্য বাজারজাত করণের নানামুখি সমস্যার কারণে আমাদের দেশে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া, সেটি টিকিয়ে রাখা এবং সেখানে থেকে মুনাফা অর্জন করা যে কোনো বিচারে কঠিন। আমাদের দেশের শহরাঞ্চলে নারীরা শিল্প, ব্যবসা, সেবা এই তিনমাধ্যমের ব্যবসা করে আনুপাতিকহারে কম হলেও পুরুষের পাশাপাশি ব্যবসাক্ষেত্র অবদান রেখে আসছে। গ্রামাঞ্চলের নারীরাও আর বসে নেই। তারা ছোটেখাটো দোকান দিয়ে, হাঁসমুরগীর খামার করে, মাছ চাষ করে, কুটির শিল্প স্থাপন করে সরাসরি জিডিপিতে অবদান রাখছে।
গ্রামাঞ্চলে ছোটপুঁজির ব্যবসায় এনজিওগুলো অর্থায়ন করছে। তারা নারীদের একক এবং দলগত ঋণ প্রদান করে। শহরাঞ্চলেও এনজিওগুলো সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য কাজ করছে। কথা হচ্ছে এনজিওগুলোর ঋণসহায়তা তাদের জীবনমান উন্নত করতে কতটুকু সাহায্য করছে এবং তাদের ঋণজালে জড়িয়ে পড়াই নিয়তি হচ্ছে কি না সেটিও আলোচনার বিষয়। যেহেতু এ লেখায় সেটি প্রাসঙ্গিক নয় তাই আমরা সেদিকে আলোকপাত করছি না। ভিন্ন আলোচনায় এই বিষয়টি উঠে আসতে পারে।
সরকারের সমতাভিত্তিক নীতি প্রণয়নের বিশেষ উদ্যেশ্যকে সামনে রেখে শহরাঞ্চলে বর্তমানে নারীরা বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যবসায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- বাংলাদেশ ব্যাংক নারীদের জন্য গত প্রায় একদশক ধরে বিশেষ ঋণসুবিধায় ১০ শতাংশ সুদহারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে পুন:অর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে ব্যবসায় পুঁজি সরবরাহ করছে।
এই কার্যক্রমে নারী উন্নয়নে কর্মরত অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এসে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তারা নারীদের ব্যবসায় কারিগরী, আইনি, পুঁজির নিরাপত্তা ঝুঁকি কমানোর পরামর্শ সহ নানা ধরণের ট্রেনিংও প্রদান করছে। ব্যবসা করতে গেলে একটি ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন হয়, ব্যাংকে হিসাব খুলতে হয়। ব্যবসা সংক্রান্ত অনুমোদনজনিত নানা ধরণের লাইসেন্স দরকার হয়। এসব জটিল কর্মপদ্ধতির সঙ্গে নারীরা খুব বেশি তাল মেলাতে পারে না বলে তারা আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়ে। বর্তমানে এই পিছিয়ে পড়ার হার এসব সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে কিছুটা কমেছে।
নারীরা যে কোনো কিছু সুন্দরভাবে সামলাতে পারে। নারীর বৈশিষ্ট্যগত একটি গুণাবলী হচ্ছে তারা সিরিয়াসলি এবং সচেতনভাবে সবকিছু গুছিয়ে রাখে। এর কারণ সম্ভবত তারা সংসার গুছিয়ে রাখার চিরায়ত কাজটি সভ্যতার শুরু থেকে করে আসছে বলে তাদের বৈশিষ্ট্যের একটি অনুষঙ্গ হিসেবে এই গুণাবলীটি জড়িয়ে গেছে। তাই ব্যবসা করতে গিয়ে নারীরা অনেকক্ষেত্রে সফল হয়েছে। সেই সাফল্যের অনেকগল্পই আমরা জানি।
তবে সবকিছুর মূলে রয়েছে নারী পুরুষের সহ অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করা। অসহযোগিতা নয় বরং নারীর জন্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে ঘরের পুরুষটি যদি তার পরিবারের নারীদের চাকুরী করতে সবধরণের সহযোগিতা প্রদান করে এবং পুরুষরা যদি নিজেদের ব্যবসায় নারীদের জড়িত করে তাহলে একদিকে যেমন ব্যবসায় উত্তরাধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত হবে তেমনি নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহনে একটি সমতাভিত্তিক সমাজও প্রতিষ্ঠা পাবে।