পুরুষ ‘বন্ধু’দের বলছি, আপনাদের লজ্জা করে না?

সুমন্দভাষিণী : আমার ‘বন্ধু’ তালিকায় থাকা পুরুষদের বলছি, এই যে দেশজুড়ে ধর্ষণের মহোৎসব চলছে, হত্যার মহোৎসব চলছে, বিচার তো হচ্ছেই না, বরং বিচারের নামে প্রহসন চলছে, নিজেকে তখন পুরুষ হিসেবে পরিচয় দিতে আপনাদের গায়ে লাগছে না?

rapist
শিশুধর্ষক সাইফুল

এই যে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আপনারা জন্মগতভাবে লৈঙ্গিক একটা পরিচয় নিয়ে দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন, মস্তিষ্কে বিদ্যা-বুদ্ধি থাকুক বা নাই থাকুক, শুধুমাত্র গায়ের জোরে তিন মাসের শিশু থেকে শুরু করে তিনকাল পেরিয়ে এককালে গিয়ে ঠেকা বৃদ্ধা নারীদেরও রেহাই দিচ্ছেন না, আপনাদের বিবেকের কোথাও গিয়ে তা স্পর্শ করছে না? যে নারীর জঠরে আপনার জন্ম, যে নারীর স্তন পান করে আপনি আজ বলিষ্ঠ পুরুষ হয়েছেন, সেই শক্তিই কী করে খাটান অন্য নারীর ওপর? বলুন!

একের পর এক শিশু, মেয়ে, নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, কাউকে মেরে ফেলা হচ্ছে, কেউ দৈবাৎ প্রাণে বেঁচে যাচ্ছে। আমরা তারস্বরে চিৎকার করছি, হেন করো-তেন করো বলার কারণে আপনাদের গালমন্দ শুনছি। আপনারা নিরাপদ দূরত্বে বসে আমাদের লম্ফঝম্প দেখছেন, আর মনে মনে হাসছেন, নিজেদের পৌরুষে তা দিচ্ছেন। আমাদেরকে পাগল ভাবছেন, ‘নারীবাদী’ বলে গাল পাড়ছেন, চায়ের কাপে সমালোচনার ঝড় তুলছেন আমাদের একেকজনের নামের পিছনে একেক তকমা লাগিয়ে।

কিন্তু জানেন তো, আপনাদের ওইসব আস্ফালনে আমাদের আর কিছুই যায় আসে না। প্রতিটি ঘটনাতেই আমরা আপনাদের পাশে চাই, ভাবি যে, না, এইবার আপনাদের বোধোদয় হবে, নিজের ঘরের মেয়েটির কথা ভেবে হলেও আমাদের সাথে গলা মেলাবেন। কিন্তু হা হতোস্মি! আপনারা যে পুরুষ হয়ে জন্ম নেন, যে পুরুষ হয়ে সংসারে বেড়ে উঠেন, সেই পুরুষই রয়ে যান। আমাদের ‘সুযোগ্য বন্ধু’ হতে পারেন না। নেমে আসতে পারেন না আপনার আরামের জায়গাটি ছেড়ে। পাছে আপনার এতোদিনের একচ্ছত্র ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যায়! একবারও নেমে এসে আমাদের হাতটি ধরে বলতে পারেন না, এই যে বোন, আমি ভাই হয়ে তোমার পাশে আছি, চলো একসাথে লড়ি।

বলেছেন কখনও? কেন বলতে পারেন না? কোথায় বাধে আপনার? কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের সাথে এসব ধর্ষণ-হত্যার সুবিচার চাইলে? ধর্ষণ বন্ধের দাবি জানালে? আপনাদের ধর্ষণ ক্ষমতা কমে যাবে তাহলে? নপুংসক হয়ে যাবেন?

প্লিজ, আমাকে বলতে দিন আজ। কী ভেবেছেন আপনারা? নিজেকে ওই পার্বতীপুরের সাইফুলের মতোন দেখতে লাগছে না? যান না, বাথরুমে ঢুকে আয়নায় নিজের মুখটা ভালো করে দেখুন। সাদৃশ্য পেলে আমাকে জানিয়ে যাবেন। আপনাদের জায়গায় আমি হলে আমার ভীষণ লজ্জা লাগতো। যেমন লাগে গৃহকর্মীদের ওপর যখন কোনো নারী অমানুষিক নির্যাতন চালায়। আমি পুরুষ হলে দৃঢ়চিত্তে আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেতাম অন্য সবাইকে সাথে নিয়ে, চ্যালেঞ্জ করতাম এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে, এই ধর্ষণের সংস্কৃতিকে, এই পুরুষতন্ত্রকে।

girl-childআমি পূজার সুন্দর, গোলগাল মুখটা দেখছিলাম বার বার করে। কী সুন্দর লাল ফ্রক জামা পরেছে সে, নতুন জামা-জুতা পরে মহা খুশি সে। আবার টিপও পরেছে কপালে। ভ্যানচালক বাবা সুবল দাসের দারিদ্র্যের লেশমাত্র নেই ছোট্ট পূজার আনন্দময়ী রূপে। এমন একটি মেয়ে পেয়ে বাবা সুবল দাস না জানি কতোই খুশি, সারাক্ষণ বাড়িময় ছুটে বেড়ানো মেয়ে পূজা তার। কত শখ করেই না এমন একটি নাম তিনি রেখেছেন মেয়ের। ভ্যান চালিয়ে দিনশেষে বাড়িতে এসে এই মায়াময় মুখটা না দেখলে তো চলে না সুবলের। কিন্তু কোথায় আজ তার পূজা? পার্বতীপুর থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সেখান থেকে ঢাকার পথে এখন তারা। অর্ধমৃত মেয়েটি শুয়ে আছে।

সেই সদাহাস্য, কল কল করা মেয়েটি আজ দুদিন ধরে নিস্তেজ। চোখ আধবোজা। চোখের পাশে কালশিটে দাগ। একটা ছোট্ট কাপড়ের টুকরো দিয়ে পেটের নিচটুকু ঢাকা। কেউ একজন, ডাক্তার হবেন হয়তো, সেই কাপড় সরিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন, নিচের ভয়াবহতা কতখানি।

হ্যাঁ, শিশু পূজাকে প্রায় ১৮ ঘন্টা ধরে দুজনে মিলে শুধু ধর্ষণই করেনি সাইফুল আর তার সহযোগী, সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দিয়েছে তার যোনিপথে, নিম্নাঙ্গে। আরও কী কী করেছে, আমার আর শুনতে ইচ্ছা করছে না। আমি ধর্ষক সাইফুলের ছবিটাও দেখেছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। লাল চোখ, আমাদের ছোটবেলায় দেখা অতি পরিচিত মফস্বল শহরের ধর্ষক পুরুষদের মতোনই। তাকে দেখছি আর ভাবছি, বয়সী এই মানুষটার নিজেরও নাকি চারটা সন্তান আছে। মেয়েও কি আছে তার? যখন সে নির্যাতন করছিল পূজাকে, একবারও কি তার নিজের মেয়ের কথা মনে হয়েছিল?

এসব ধর্ষণ-টর্ষণ নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছে, ইনিয়ে-বিনিয়ে, নিজেদের শ্রদ্ধা সমুন্নত রেখে, যতোটুকু পারা যায় ভদ্রভাষাতেই প্রতিবাদ করেছি, করেই যাচ্ছি আমরা। তাতে কোনো হিতে-বিপরীত হচ্ছে যে না, তাতো প্রমাণই পাচ্ছি। তাহলে আমাদের এখন কী করা উচিত? আমরা তো বড়জোর লিখতে পারি, যা সবসময়ই করি। আর কী করতে পারি? আর কী করলে ওই ধর্ষক শাস্তি পাবে? আর কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হবে না! আছে কোনো সমাধান আপনাদের কাছে? 

আর রাষ্ট্র? রাষ্ট্রের কাছেই বা কী জবাব আছে এর? যে রাষ্ট্র শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের নারী, এমনকি জনমানুষের নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেই রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার আওতায় আনবে কে? সবাই তো দুধ-কলা খেয়ে বসে আছি।

শেয়ার করুন: