মেয়েরা ভারতীয় সিরিয়াল কেন দেখে?

দিলশানা পারুল: ভদ্রমহিলার বাসায় প্রতিদিন ঠিক রাত নটায় একদল চরিত্র এসে দরজায় কড়া নাড়ে। এরা ড্রইংরুমে এসে ঠিক ২১ থেকে ৩০ মিনিট বসবে, সুখ- দুঃখের আলাপ করবে, ভদ্রমহিলাকে হাসাবে, কাঁদাবে, তারপর ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে ৯টায় চলেও যাবে। এতো ভদ্র কতগুলো চরিত্র, এক কাপ চাও খাবে না। অথচ প্রতিদিন আসবে এবং ভদ্রমহিলার সাথে খুবই একান্ত কিছু সময় কাটিয়ে চলেও যাবে।

একজন দুজন না, পুরো পরিবার ধরে আসে। প্রতিদিন একই সময়ে একই চরিত্রের সাথে যখন আপনার দেখা হয়, তাদের সুখ-দুঃখ আপনি প্রতিদিন ভাগাভাগি করে নিতে থাকেন, তখন কী একটা সম্পর্ক হয় বুঝতে পারছেন? তার মধ্যে এই ব্যস্ত সময়ে যখন নিজের সন্তান ভদ্রমহিলার খোঁজ-খবর নেয়ার সময় পায় না, অথবা এতো শত কাজের ভিড়ে ঠিক ঠিক এসে তার মনের কথাটা বলে যায়, তখন এই মানুষগুলো আপন না হয়ে কে হবে বলেন?

Star Jolshaশুধু পার্থক্য হলো, চরিত্রগুলো প্রতিদিন ভার্চুয়ালি আসে, কিন্তু ইম্প্যাক্ট প্রায় একই রেখে যাচ্ছে। কথা বলছিলাম ভারতীয় চ্যানেলের সিরিয়ালগুলো নিয়ে।

শুনতে পেলাম বাংলাদেশের শতকরা ৬৪ ভাগ মেয়ে ভারতীয় চ্যানেলে কোনো না কোনো সিরিয়াল দেখে। গত প্রায় সাড়ে তিন মাস হলো আমি ভারতীয় সিরিয়াল দেখছিলাম শুধু এইটা বোঝার জন্য, যে আমাদের দেশের মেয়েরা সিরিয়াল আসলে কেন দেখে?

অনেকে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছেন, মনে করেছেন ড্রাগ কী এইটা বোঝার জন্য ড্রাগ নিয়ে দেখতে হয় না। কিন্তু সিরিয়াল কেন দেখে এইটা বুঝতে হলে সচেতন চিন্তা নিয়েই বসে দেখতে হবে, আসলে কেন দেখে? এবং চট করে জাযমেন্টাল হলে চলবে না। আপনাকে নিরপেক্ষ মন নিয়ে বিষয়টা দেখতে হবে। সামনাসামনি অনেক মেয়েই হয়তো স্বীকার করবে না যে সে সিরিয়াল দেখে, কিন্তু বাসায় সে দেখে। সিরয়িাল দেখা এক ধরনের আনস্মার্ট ব্যাপার, এইটা মেনে নেয়ার পরও সিরিয়াল দেখে।

আমি এক সংস্থার ডক্টরেট করা একজন প্রধান নির্বাহী ভদ্রমহিলাকে চিনি যার সিরিয়াল একদিকে, দুনিয়া আরেকদিকে। আইবিএ থেকে এমবিএ করা একাধিক ভদ্রমহিলাকে চিনি যারা সিরিয়াল দেখেন। আমি এমন অনেক নারী চরিত্রকে চিনি, যার চরিত্রের সাথে সিরিয়াল দেখাটা ঠিক যায় না, তরপরও দেখে। আমার বাসার ছুটা গৃহকর্মী থেকে শুরু করে, গ্রামের গৃহবধু, আমার নানী শাশুড়ি থেকে শুরু করে আমার ডাক্তার ননদিনী, এরা সবাই কোন না কোন চ্যানেলের সিরিয়াল দেখে। কাজেই এই বিষয়টাকে হালকা করে নেয়ার সুযোগ নেই।

আর এই দর্শকদের উপর ভর করেই এন্টারটেইনমেইন্ট ইন্ডাস্ট্রি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করে নিচ্ছে, কাজেই এইটা ‘নট অ্যা মেটার অফ জোক এনি মোর’। মজার বিষয় হলো, গুগল সার্চ দিয়ে এইটার উপর একাধিক আর্টিক্যাল এবং স্টাডি পেপারও পেলাম। সবই আসলে ফোকাস করেছে সিরিয়াল দেখার আফটার ইম্প্যাক্ট এর উপর। আর আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সাথে সিরিয়ালের সমাজ ব্যবস্থার তুলনাও আছে, কিন্তু মেয়েরা কেন দেখে এইটা মেয়েদের পারসপেকটিভ থেকে দেখা হয়নি। আমি নিজে নেশাগ্রস্ত হয়ে তারপর আইডেনটিফাই করার চেষ্টা করেছি মেয়েরা আসলে কেন দেখে।

বিষয়টা কি এরকম যে বাংলাদেশের চ্যানেলের নাটকগুলো ওদের চেয়ে নিম্নমানের হয়, ওইজন্য এর চেয়ে বেটার কোন অপশন না পেয়ে সবাই ভারতীয় চ্যানেলের নাটক দেখে? একদমই কিন্তু এরকম না। আমাদের বেশিরভাগ প্রচলিত অভিনেতাই ভারতীয় সিরিয়ালের যে কারো চেয়ে ভালো অভিনয় করে। পারিপার্শ্বিকতা যদি বিচার করেন, তাহলে ভারতীয় সিরিয়ালের চেয়ে বাংলাদেশের নাটক অনেক বেশি বাস্তবধর্মী, অনেক বেশি সরল।

চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে, মেকাপ, পোশাক বাংলাদেশের নাটক অনেক বেশি বাস্তব এর কাছাকাছি। আমাদের নাটকে গ্রাম এবং শহর এই দুইটা ভাগ আপনি সহজেই করতে পারবেন। ভারতীয় চ্যানেলে কিন্তু এরকম কোনো ভাগ আপনি চাইলেও করতে পারবেন না।

ধরেন দেখাচ্ছে ঠিকই গ্রামের একটা কোনো ঘটনা, কিন্তু পোশাক-গহনা কিছু আলাদা করতে পারবেন না, কোনটা শহর আর কোনটা গ্রাম। তারপর ধরেন, তিন ইঞ্চি মেকাপ মুখে নিয়ে, কাতান সারি পরে ঘুমাতে যাওয়ার মতো অনেক অস্বাভাবিক দৃশ্য এখানে দেখায়, তাহলে তারপরও আসলে আমাদের মেয়েরা সিরিয়াল কেন দেখে? এই অমোঘ নেশাই বা তৈরি হচ্ছে কেমন করে?  

কাজটা আমি এথনোগ্রাফিক স্টাডির আঙ্গিকে করেছি। গুগলে পওয়া কিছু গবেষণা কাজও পড়েছি, কিন্তু এখানে আমি আমার পর্যবেক্ষণগুলোই দিলাম।

পুরো এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে ভারতীয় সিরিয়াল হচ্ছে একমাত্র জায়গা যেখানে প্রধান চরিত্র হচ্ছে নারী। শতকরা একশভাগ সিরিয়ালের একশ ভাগেই প্রধান চরিত্র নারী। এখানে পুরুষ চরিত্রায়ন আছে, কিন্তু সেটা সবসময়ই সাইড চরিত্র হিসেবে আসে। শুধু যে নারী প্রধান চরিত্র, তাই নয়, এই সিরিয়ালগুলোর  শতকরা আশি ভাগেরও উপরে টিভি স্ক্রিনে নারী চরিত্রের উপস্থিতি থাকে।  বলা যায়, পুরোটাই নারী ডমিনেন্ট।

আপাত অর্থে এইটা আপনার কাছে বিশেষ কোন গুরুত্ব বহন না করলেও, এই পুরুষ প্রধান সমাজ ব্যবস্থায় এইটার প্রভাব কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চেতন অথবা অবচেতনে পরিবারে অথবা পরিবারের বাইরে নারীকে যখন অভিনয় করতে হয় পার্শ্ব চরিত্রে, তখন হঠাৎ করেই সিরিয়ালের মধ্যে প্রধান চরিত্র হওয়ার স্বাদ তিনি পেয়ে যান। এইখানে তিনি প্রধান, এইখানে শুধু তার কথাই ভাবা হয়, এইখানে তার কথা তার মতো করেই বলা হয়।

কাজেই এই প্রধান চরিত্র হওয়ার এই ত্রিশ মিনিট তাকে টানবেই এইটাই স্বাভাবিক। কিছু যায় আসে না এইটা বাস্তব না ফ্যান্টাসি। বরং বাস্তবমিশ্রিত এই ফ্যান্টাসি এমন অনেক কিছুই বলে, যা ভদ্রমহিলা বলতে চান।

এবার আসি যে পরিস্থিতি দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেইদিকে। টুম্ব রাইডারের লারা ক্রাফ্ট যতই দুর্দান্ত চরিত্রের নারীই হোক না কেন লারাকে কখনই ভদ্রমহিলা তার পাশের বাড়ির প্রতিবেশি ভাবতে পারবে না। সেখানে মিলন তিথির অহনা তার অনেক কাছের, অনকে পরিচিত, অনেক আপন। সুনির্দ্দিষ্ট কতগুলো প্রায় বাস্তব চরিত্র যখন প্রতিদিন একইসময়ে এসে তার ড্রইংরুমে বসে তার ভাষাতেই তার মতই দুঃখ-কষ্ট শেয়ার করে, তখন এই পরিবারের মানুষগুলোর সাথে ভদ্রমহিলা একধরনের আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করেন।

কাজেই সেই পরিবারে এরপর কী ঘটলো বা ঘটছে তাতে ভদ্রমহিলার কিছু যায় আসে বৈকি! এই সিরিয়ালগুলোতে দর্শক নারী সবসময়ই কোন না কোন চরিত্র পেয়ে যান যেটা তার সাথে মেলে অথবা কোন না কোন পরিস্থিতি পেয়ে যান যেটা মোটা দাগে তার সাথে মেলে।

এই সিরিয়ালগুলোতে নেগেটিভ ক্যারেক্টারগুলোর উপস্থিতি কিন্তু সাংঘাতিকভাবে প্রমিনেন্ট এবং ভাইব্রেন্ট। একদল নেগেটিভ চরিত্র সারাক্ষণ দেখবেন পর্দা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এবং কোন এক ভালো বউ বা মা বা মেয়ে বা শাশুড়িকে সারাক্ষণ যন্ত্রণা দিয়ে বেড়াচ্ছে বা বিপদে ফেলছে। তারপর চোরের দশ দিন সাধুর একদিনের মতো গোটা পঞ্চাশ পর্বের পর একদিন ভালো মেয়ে বা ভদ্রমহিলাটির দিন ফেরে বা মুখ ফোটে, সেদিন তিনি কঠিন কঠিন কথা বলে সবার উপর একহাত নেন! এই ঘটনাতে দর্শক ভদ্রমহিলা বাস্তব জীবনে যা যা, যাকে যাকে বলতে চেয়েছেন, কিন্তু বলতে পারেন না তার রিফলেকশন দেখতে পান, এবং সংসারে দুষ্ট লোকগুলোকে কিছু বলতে পারার একধরনের তৃপ্তির স্বাদ পান, যেটা বাস্তব জীবনে আসলে হয়ে উঠে না সভ্যতা-ভব্যতার কারণেই।     

সিরিয়ালগুলোর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক এদের স্ক্রিপ্ট। এই একটা জায়গায় বাংলাদেশের নাটক সিরিয়ালগুলোর কাছে হার মানতে বাধ্য। আপনি একটা সিরিয়ালে একটা ডায়ালগ পাবেন না যেটা স্ক্রিপ্টের বাইরে বা অগোছালোভাবে বলা। প্রতিটা কথার পৃষ্ঠে কথা এমন শক্তভাবে, গুছিয়ে দেয়া যে মনে হবে এই  সময় বুঝি এই কথাটা এইভাবেই বলতে হতো। অন্যভাবে বললে ক্লাইমেক্সের ঘাটতি পড়তো! কথার পৃষ্ঠে কথা দিয়ে কথার ফুলঝুরি কেমন করে ফোটাতে হয় তা এই সিরিয়ালগুলোতে খুব ভালো করে পাবেন।

২১ ‍মিনিট সিরিয়ালে সবাই সবসময় ইউ শেপে দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ কিন্তু ডায়ালগই দিতে থাকে, আর কিছু না। ৫%ও আউটডোর সিন থাকে কিনা সন্দেহ। কাজেই তাদের ডায়ালগ দিয়েই দর্শক টানতে হয়, অতএব ডায়ালগ শক্তিশালী হতে বাধ্য। এরপর আসি স্পষ্ট উচ্চারণে, খুব একুরেটভাবে ডায়ালগ থ্রো! এরকম কোন চরিত্র রুপায়ন পাবেন না যেখানে অভিনেত্রী বা অভিনেতা সুন্দর উচ্চারণে সঠিকভাবে ডায়ালগ বলতে পারে না। এর একটা আকর্ষণ আছে বৈকি!

এগুলো ভারতীয় সিরিয়াল দেখার এডিকশনের পিছনের কারণ বলে আমার অবজারভেশনে মনে হয়েছে। কিন্তু এই সিরিয়ালগুলো ভারতবষের্র চলে আসা সামন্তীয় সমাজব্যবস্থাকে ধরে রাখার পুঁজিবাদী কৌশল ছাড়া কিছু নয়। সেই লৈংগিক রাজনৈতিক আলোচনা না হয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাকলো।

শেয়ার করুন: