চেনা অপরিচিতা: মাঝে মাঝে ভাবি, জীবনের প্রথম কষ্টটা কী ছিল? ডানপিটে বাচ্চা ছিলাম। হাঁটুর দাগগুলোই বলে দেয় দুরন্তপনা কতোটুকু ছিল! তবু, এতো বছর পর শুধু একটাই ঘা দগদগ করে। পাঁচ বছর বয়সে যখন ব্যবহৃত হতাম দূর সম্পর্কের মামা’র কাছে। দু’বছর সেই পেডোফাইল তার চাহিদা মিটিয়েছে। আমি আসক্ত হইনি সেই দাবি করবো না। পাঁচ বছরের একটা শিশুর বোঝার কথা না বিষয়টি ঠিক কী ঘটতো, বা এর ভয়াবহতা কতখানি।
লোকটা বলতো, এটা একটা খেলা, যেটা আমেরিকায় খেলে। কিন্তু ঠিক জানি না, একটা পর্যায়ে মনে হলো এর থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। তখন আমি লোকটাকে শক্ত করে মানা করে দিলাম। লোকটা তারপর বাসায় আসতো না।
১৪ বছর বয়সে আস্তে আস্তে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগলো। আমার বান্ধবী নীপা একদিন স্কুলের মাঠে বললো, “জানিস, বাবা যখন মাকে ধর্ষণ করে তখন বাচ্চা হয়!” ধর্ষণ জিনিসটা কিভাবে হয় খুব পরিষ্কার ধারণা ছিল না। বান্ধবীদের গোপন অ্যাডাল্ট জোকসের আসর, সিনেমা, বইপত্রে বুঝতে পারলাম সেই ছোটবেলায় আমার সাথে কী ঘটেছিল! আমার একলা বয়ো:সন্ধিতে এমন কেউ ছিল না যাকে আমার কষ্টের কথা বলবো।
মনে হচ্ছিল, আমার তো সব শেষ হয়ে গেছে। বিকেলে গুটি গুটি পায়ে যেতাম ছাদের কিনারে। রড বেরিয়ে থাকা ন্যাড়া ছাদ। রডে হাত দিয়ে নিচে উঁকি দিতাম। তিনতলা থেকে পারবো লাফ দিতে? খুব চেষ্টা করতাম। কিন্তু, পারতাম না। ক্লাস এইটে পড়া ভিরু কিশোরী। অনেক ভয় লাগতো।
রাগ হতো, কেন পারি না! তারপর, নিজেকে নিজে সেই সান্ত্বনামূলক যুক্তি দিতাম- বাবা-মায়ের কী হবে? যখন অনেক বড় হবো জীবনে, তখন এই কষ্টগুলো মুছে যাবে। আর কখনও বিয়ে করবো না। কোন ছেলেকে ঠকাবো না। এগুলো ঠেসে ঠেসে মনে ভরতাম। আর যা কিছু ভাল, ছবি আঁকা, গান, পড়াশোনা, ম্যাকগাইভার, সালমান খান, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, হাসাহাসি, সবকিছু নিয়ে আমি আমার অন্ধকার সময়টা ভুলে যেতাম। সত্যি বলতে, ৫/৬ বছরের স্মৃতি খুব পরিষ্কারভাবে মনে থাকার কথা নয়। আর আমি নিজের কাছ থেকেই এই অতীত মুছে ফেলতে চাইতাম।
বড় হওয়ার পর বুঝতাম। আমার মা আমার বড়ভাইকে নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকতেন। ঠাট্টা মশকরার পাত্র ছিলাম। প্রথম সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের যে আগ্রহ থাকে, পরবর্তী সন্তানেরা সেটা পায় না। তাই কার কাছে থাকলাম, কী হলো সেটা খেয়াল রাখার সময় হয়তো তার ছিল না।
আমার ছোটবেলায় দিনের বেলাটা বেশিরভাগ কাটতো কাজের লোক আর বাসার আশ্রিত মানুষদের কাছে। তাই এমন ঘটনা আমার মায়ের চোখ এড়িয়ে গেছে।
আমার শৈশব খুব সুন্দর ছিল। খেলাধুলা, সারাদিন পুরো পাড়া চক্কর, আকাশে মেঘ করলে জোরে জোরে, “আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে” গাওয়া আর সত্যি সত্যি বৃষ্টি হওয়া, দোকানে বাকিতে সন্দেশ, চানাচুর খাওয়া, ১০ টাকা চাঁদা দিয়ে পিকনিক করা, আরও অনেক কিছু।
শুধু একটা জিনিস পারতাম না। আমার বন্ধুরা যখন ঘেমে নেয়ে খালি গা হয়ে যেত, সেটা আমি পারতাম না। আমার বুকের অস্বাভাবিক গ্রোথ সেই লজ্জার কারণ ছিল। একবার খেলতে গিয়ে সবাই সবার বুক দেখালো, আমিও দেখালাম, তখন একটা ছেলে “বড় দুধ বড় দুধ” বলে খেলার মাঠে চেঁচিয়ে অনেক লজ্জা দিল। ব্যাপারটা বোকামি ছিল। আমার মানসিক পরিপক্কতা আর দৈহিক গড়ন বিপরীত মেরুর ছিল বলেই হয়তো অনেক বোকামো করেছি।
বোধ হওয়ার পর যে মানুষটিকে সবচে’ ভালবাসতাম, আম্মার মার আর বকুনির হাত থেকে বাঁচতে বিশাল একটা আশ্রয় ছিল একটা শিশুর, সেই নানাভাই, সেও একদিন হারিয়ে গেল। আমার রূপকথার রাজ্য, পক্ষিরাজে চড়া রাজপুত্র, সোনার কাঠি রুপার কাঠি, আমগাছে দোলনা টানানো, শিং মাছ দিয়ে যত্ন করে ভাত খাওয়ানো সব হারিয়ে গেল তার সাথে। গল্পের মতো তাকে বাঁচাতে পারিনি। বিশাল একটা শূন্যতা আমায় ভর করলো। কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো? আমার একা হওয়ার শুরু সেই পাঁচ বছর বয়স থেকেই।
ভিকারুন্নিসায় একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির পর হঠাৎ আমার পিরিয়ড একই মাসে দ্বিতীয়বার হওয়া শুরু হ’লো এবং প্রবলতরভাবে। মাংসের মত চাকা রক্ত থপ থপ করে পরতো। এক সময়, অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে আর দাঁড়াতে পারতাম না। পড়ে যেতাম। একরাতে আম্মা আমাকে নিয়ে গাড়িতে ডাক্তার খুঁজতে বের হ’লো। সারা শহর খুঁজেও সে রাতে গাইনি ডাক্তার পাওয়া গেল না। একজনকে পাওয়া গেলেও সে দেখবে না জানিয়ে দিল। ঘুরে ঘুরে পাড়ার ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে গেলাম। উনি ইমারজেন্সি ওষুধ দিলেন। আর একজন ডাক্তারের রেফারেন্স দিলেন।
যাই হোক। কয়েকদিন পর একটু সুস্থ হলে, আলট্রাসনোগ্রাম করা হলো। আমি ভয়ে বাঁচি না। শুধু মনে হচ্ছিল, আমার অন্ধকার সময়টা সবাই জেনে যাবে। সনগ্রাফিক টেবিলে যখন জেল লাগিয়ে তলপেট ঘষছিল ডাক্তার, তখন মনে হচ্ছিল অসংখ্যবার মৃত্যু হচ্ছে আমার। অজ্ঞতা, অপরিপক্বতা আর লজ্জা কুরে কুরে খাচ্ছিল। রিপোর্ট পাওয়ার পর আম্মার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। মিশরের মমির মত মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করি, “কী হইসে আম্মা? আমার মা শুকনো মুখেই মিথ্যা বলে, ‘কিছু না’।
আস্তে আস্তে জানতে পারি। আমার দুটো ওভারিতেই সিস্ট ধরা পড়েছে। সিস্ট মানে কী জানা গেল, টিউমার। অপারেশন করে নাকি সেসব বের করে। ভয়ে আমি শেষ হয়ে গেলাম। মনে হ’লো এ আমার পাপের শাস্তি। আমি কি তবে মরে যাবো? খুব তাড়াতাড়ি?
(চলবে…)