কামরুন্নেসা নাজলী: একজন হতাশাবাদী মানুষ হয়েও ইদানীং সচেতনভাবে ভালো কিছু খুঁজে বেড়াই। এই অস্থির সময়ে ভালো কিছু খুঁজে পাওয়া সাগর সেঁচে মুক্তো কুড়োনোর মতো হলেও ভালোকে উৎসাহিত করার জন্য, খারাপকে ধিক্কার জানানোর জন্য সংখ্যায় কম হলেও সেই ভালোকে ভালো করে তুলে ধরা প্রয়োজন।
এই রকম একটা উপলব্ধি থেকেই এই লেখার অবতারণা।

‘গণমাধ্যম যখন লিঙ্গ বৈষম্যের প্রভাবক’ শিরোনামে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম এ প্রকাশিত লেখাটি পড়ছিলাম। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র পরিচালিত এক জরিপের বরাত দিয়ে লেখাটায় উল্লেখ করা হয়েছে- দেশের শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সব ধরনের বেশিরভাগ পুরুষই নারীদের অধস্তন মনে করেন। খুবই পুরনো, পরিচিত, একই সাথে অনাকাঙ্খিত একটি মনস্তত্ত্ব । নারী-পুরুষ বৈষম্যের মূল কারণ তো এই ঊর্দ্ধতন-অধস্তন মনস্তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত।
এই মানস গঠনে পরিবার,সমাজ, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতো গণমাধ্যমের শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত তাদের বিভিন্ন উপস্থাপনার মাধ্যমে নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার চেয়ে বৈষম্যকে জিইয়ে রাখতেই ভূমিকা রেখে চলেছে।
প্রতিদিন যেসব চলচ্চিত্র, নাটক, বিজ্ঞাপন আমরা দেখছি তাতে নারীকে স্বাধীন, স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং পুরুষের অধস্তন নিম্নশ্রেণির মানুষ, কখনো বা বস্তু সামগ্রীর সমতুল্য হিসেবেই উপস্থাপিত করা হচ্ছে। নারীর গতানুগতিক ভূমিকাকেই প্রধানত চিত্রায়ন করা হয় সেসব উপস্থাপনায়। প্রশ্ন আসবে- কোনো কোনো নারীই তো এই সব ভূমিকায় চিত্রায়িত হচ্ছে। এর কারণ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় আমরা নারীরাও ছোটবেলা থেকেই সমাজ আরোপিত অধস্তন ভূমিকাকে প্রশ্নাতীত ভেবে মেনে নিতেই শিখি।
গণমাধ্যমে নারীকে তথাকথিত ভূমিকায় উপস্থাপন নিয়ে উদ্বেগের এই সময়ে রাধুঁনি মসলার একটা বিজ্ঞাপন একটু ভিন্নভাবে চোখে পড়ছে, যেখানে দেখানো হচ্ছে- পরিবারের পুরুষ সদস্যটি গর্বের সাথে আমন্ত্রিত বন্ধুদের জন্য রান্না করেছেন। আমন্ত্রিত অতিথি বন্ধুরাও প্রশংসার সাথেই তাদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে রাধুঁনি মসলারই আর একটি বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ছে। যেখানে দেখানো হতো একজন পেশাজীবী মা কাজ শেষে রাতে বাড়ি ফিরে দেখেন-তার ছেলে রান্নার কাজটি সেরে রেখেছে।
চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে বটে, কিন্তু গৃহকর্ম থেকে নারীর রেহাই মেলেনি। তাই এখনও দশভুজার স্তুতি বাক্য!! শুনতে শুনতে অফিসের কাজ শেষে রান্না-বান্না, বাচ্চাদের দেখভাল করাসহ গৃহকর্মের সব কাজের দায়িত্ব সামলাতে হয় নারীকেই। তবে হাতেগোনা হলেও কিছু কিছু পরিবারে নারী-পুরুষ মিলেই গৃহকর্মের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। কিন্তু সদাশয় সেইসব পুরুষকেও বৃহত্তর পরিবার, বন্ধুমহল থেকে প্রশংসার পরিবর্তে ‘স্ত্রৈণ’ বলে হেয় করা হয়।
এইরকম প্রেক্ষাপটে ‘রান্নার কাজটি শুধুমাত্র নারীর নয়’ এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে এই ধরনের বিজ্ঞাপনের যথেষ্ঠ গুরুত্ব রয়েছে।
এই প্রসঙ্গে কেয়া সাবানের একটি বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ছে-যেখানে সাবানের ব্যবহারকারী নারী একজন ডাক্তার যিনি তার স্বামীর আপত্তির মুখেও মাতৃহারা একটি শিশুকে নিজের সন্তানের মতো দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। এই সাবানের ব্যবহারে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এরকমই ছিল বিজ্ঞাপনটির মূল বক্তব্য, আমার কাছে অন্তত সেই রকমই মনে হয়েছে।
বিজ্ঞাপনগুলোতে যেখানে নারীর সৌন্দর্য নিয়ে অকারণ বাড়াবাড়ি করা হয়, সেখানে সৌন্দর্য নয়, নারীর আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর এই বিজ্ঞাপনটি বেশ ভাল লাগা নিয়ে দেখতাম।
সংখ্যায় কম হলেও এই উপস্থাপনগুলো প্রশংসার দাবী রাখে। আমাদের প্রশংসা, স্বীকৃতি নিশ্চয়ই নারীর ভূমিকার ইতিবাচক উপস্থাপনে সচেতনভাবে আরো উদ্যোগ গ্রহণে তাদেরকে উৎসাহিত করবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক, অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে অন্যদেরকেও হয়তো প্রভাবিত করবে।