আয়নায় নিজের মুখ

লুনা শিরীন: মুহূর্তেই বিহ্বল লাগে এই যাপিত জীবন- এই প্রবাস জীবনে নিজের করোটিতে বহন করা স্বপ্নময় এই একটাই জীবন- অবিশ্বাস্য কৌতূহল নিয়ে আমাকেই জিজ্ঞ্যেস করে –এর নাম জীবন, ভালো করে জানো, ভালো করে বুঝে নাও। আমি নিজেকে মেলাতে পারি না, আমি নিজের কাছে নিজেই যেন এক বোকা বালক – যার শরীর বাড়ে, কিন্তু বয়স বাড়ে না।

luna-shirin
লুনা শিরীন

লিখতে বসেছি লতিফা আপাকে নিয়ে, কিন্তু কী লিখি? কথা হলো মাত্র ৪৫ মিনিট, তবুও দোভাষীর কাজে, যেখানে আমার নিজে থেকে প্রশ্ন করার কোন অধিকার নেই, আমি একটা ভ্যাসেল মাত্র- মানে আমি শুধু কথা বলবো, বাংলা/ইংলিশে – একজনের কথা হুবহু আরেকজনের কাছে, অন্য কোন ভূমিকা নেই।

কিন্তু তবু এখানেও আমরা যারা দোভাষী, তারা মানুষ চিনতে পারি, ঘটনায় বলা, না বলা কথা উন্মোচিত হয় আমাদের কাছে –মনে পড়ে এই দোভাষীর কাজের শুরু প্রথম দেড় মিনিটে নিজের পরিচয়। আমাকে শপথ নেবার মতো বলতে হয়- “আমি মাহমুদা শিরীন, অমুক সংস্থা থেকে দোভাষীর কাজের জন্য এসেছি। এখানে যা যা বলা হবে, আমি হুবহু সেটা উচ্চারণ করবো। আমি নিরপেক্ষতা এবং গোপনীয়তা বজায় রাখবো ,আমি কিছু নোট নেবো নিজের স্মরণ শক্তির জন্য, কিন্তু কাজ শেষে সেটা ছিঁড়ে ফেলবো”।

উপরের এই শপথ বাংলায় এবং ইংরেজীতে বলতে হয় কাজ শুরুর আগে- এটা মাস্ট- করতেই হবে। ২০০৯ সালে যখন এই দোভাষীর কোর্স করেছিলাম তখন নাইয়া গ্রেড সিক্সে পড়ে। বরফের রাতে নাইয়াকে বেবি সিটার এর বাসায় রাখার জন্য ঘণ্টায় গুনে গুনে ডলার তুলে দিতাম বাঙ্গালী মহিলার হাতে- সেদিন বুঝতে পারিনি একটা ফুল টাইম জব থাকার পরেও কেন আমি আরো একটা কাজের জন্য মন দিয়ে চেষ্টা করছি?

কিন্তু আমার সামনেও সেদিন কোন পথ ছিলো না, অনেকগুলো ডলার দিয়ে কোর্সে ভর্তি হয়েছি, পাশ করে বেরুতেই হবে। সেইসময় আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন একজন ভারতীয় লোক। ভীষণ ডায়নামিক সেই টিচার আমাদের বলেছিলেন – যতোই তুমি পরিচিত হও, যতোই তোমাকে বলা হোক নিজের পরিচয় দিতে হবে না, কিন্তু তুমি মনে রাখবে, একজন ইন্টারপ্রেটার এর প্রথম কাজ হচ্ছে নিজের শপথ –এখান থেকে নিজেকে সরাবে না কোনদিন।

আজ আট বছর কষ্টের জবের পাশাপাশি আমি দোভাষীর কাজ করছি, কানাডার উইনিপেগ থেকে অন্য একটা ফোন ইন্টারপ্রেটার অফিসের সাথেও আমি কাজ করি – আমি কোনদিন নিজের পরিচয় না দিয়ে কাজ শুরু করি না। কিন্তু এই যে মেশিনের মতো কাজ করি আমরা – আমাদের আড়ালেও আমাদের আরো পরিচয় আছে – আমি কারও মা, কারও সন্তান, কারও বন্ধু, কারও প্রেমিক, বা আমিও আর দশজনের মতো একজন সাধারণ অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ। ঘণ্টায় ডলার উপার্জন করাই আমার একমাত্র লক্ষ্য না, বরং জীবনের গভীরে গিয়ে জীবনের বাস্তবতা দেখলে আমাদের মন প্রবলভাবে আলোড়িত হয়, আমরা প্রশ্ন করি নিজেদের – এই কি জীবনের সত্যিকার রূপ?

আজ বিকেলে গিয়েছিলাম ডাউন টাউন টরোন্টোতে একটা এসাইনমেন্টে।  শহরের ওইসব এলাকায় বেশকিছু পুরনো বাঙ্গালী থাকেন – যারা অন্তত ৩০/৩৫ বছর আগে টরোন্টো এসেছেন – ওইসব এলাকায় বেশকিছু সরকারি বাড়ি আছে, যা অনেক আগে পাওয়া সহজ ছিলো, এখন আর সহজেই সরকারি বাড়ি বা সুবিধা মেলে না- যাই হোক লতিফা আপা সেই পুরনো প্রবাসী বাঙ্গালীদের একজন। এসেছিলেন ডাক্তার এপয়েন্টমেন্ট এ- আমার নয় বছরের পার্ট টাইম এই দোভাষীর কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- বেশীর ভাগ বাঙ্গালীই ইংলিশ বোঝে ও বলতে পারে, কিন্ত এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এর অভাব কাজ করে বলেই এরা দোভাষীকে পাশে রাখতে চান। মনে করেন কোথাও যদি বুঝতে না পারেন, আমাদের শরণাপন্ন হবেন।

আজকে কাজ যাবার পরেও সেই একই ঘটনা ঘটলো, শান্ত শীতের বিকেলে আমি আর লতিফা আপা বসে আছি, দূর থেকেই বুঝতে পারি ইনি বাঙ্গালী নারী। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কথা বলতে পারবো না তাই চুপ করে থাকতে হয় – রিসিপশনে বসা চাইনিজ নারী লতিফাকে বলেন – তুমি তো ইংলিশ পারো, তুমি কেনো দোভাষী ডেকেছো?

লতিফাও বলে উঠে, না- না আমি ডাকিনি –আমি তো ইংলিশ বলতে ও বুঝতে পারি। ইতিমধ্যে এসে পড়ে ধবধবে সাদা ক্যানাডিয়ান নারী ডাক্তার শ্যারন। এবার আমরা তিনজন এক রুমে – লতিফা অ্যাবিউজের শিকার হয়েছে – তাই সেই সরকারি বাড়ির জন্য অ্যাপ্লাই করেছে – ঘটনা এইটুকু জানার পরে আমি স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেই লতিফাকে নির্যাতন করেছে তার স্বামী, কিন্তু মাত্র ১০ মিনিট পরেই ঘটনা উন্মোচিত হয় – ডাক্তারের সামনেই ৬১ বছর বয়সি লতিফা আমাকে শুধরে দেয় – বলে, না না আপা, আমার স্বামী না, আমার ছোট ছেলে বাবু, সে আমারে মারে, গালিগালাজ করে, আমারে সহ্য করতে পারে না, তাই আমি তার কাছ থেকে আলাদা হতে চাই।

এবার আমার মুখে কথা সরে না, সহসাই বুঝতে পারি আমাকে কথার ট্র্যাক রাখতে হবে, এটা আমার জব, কিন্তু কী বলবো আমি? আরও বলা দরকার, এই কেস নিয়ে শ্যারন এবং লতিফা এর আগে বহুবার বসেছে, সুতরাং ডাক্তার শ্যারনও বোঝে আমি নতুন – এই কেস আমি জানি না- কিন্তু লতিফা কাঁদছে আর ঘটনার বিবরণ দিচ্ছে, নিজের পেটের ছেলের সাথে এক বাসায় সে থাকতে পারছে না – এখন কী করবে?

না পেরে ডাক্তারের কাছে এসেছে, শ্যারন যদি ওকে ভালো সাপোর্টিং লেটার লিখে দেয় তাহলে লতিফা সরকারি বাসা পাবে। কিন্তু শ্যারন বলে, লতিফা এরকম অনিরাপদ জীবন কাটাতে পারে না, বরং লতিফার উচিত ৯১১, পুলিশ কল করা। এদিকে লতিফা কিছুতেই পুলিশ ডাকবে না, কারণ তার ছেলের জীবনে পুলিশের রেকর্ড সে চায় না – তাহলে উপায়?

দোভাষীর কাজে আমাদের ঘটনার আদ্যপান্ত জানার সুযোগ নেই। আজকের মতো এইটুকুই।

বাস, ট্রাম, সাবওয়ে ধরে বাড়ি ফিরতে থাকি, নিজের আয়নায় ভাসতে থাকে ১৬ বছরের ছেলের মুখ। যাকে নিজের আয়নায় বসিয়েছিলাম মাত্র ১১ মাস বয়স থেকে। আজ সেই ছেলে বড় হয়েছে, আমার একাকিত্ব নিয়ে কথা বলার অনেক আলোচনায় নাইয়া আমাকে খুব ভালোভাবে বলেছে – মা, তুমি তোমার ফ্রেন্ড খুঁজে নাও না কেনো? আমি তো তোমার কাছে থাকবো না মা, আই হ্যাভ মাই ওন লাইফ। সেই সত্য আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে নাইয়া?

কিন্তু ওই যে লতিফা আপার মুখ, এমন আরো শত শত মায়ের মুখ। আমার নিজের মায়ের মুখ – যিনি আজ এই পড়ন্ত বেলায় বলেন, তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়েই তো বেঁচে আছি। সব মায়ের মুখ এক, কিন্তু সব সন্তানের মুখও কি এক?

– ১৯/১০/২০১৬

শেয়ার করুন: