ঈশ্বর নাকি নশ্বর-২

মাকসুদা আজীজ: প্রথম পর্বে যা বলেছিলাম তা একদমই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। যারা পড়েননি তাদের জন্য একটু রি-ক্যাপ করছি। অধিকাংশ পুরুষ নিজেকে প্রভু মনে করেন, স্বামী শব্দের প্রতিশব্দগুলোও প্রভুত্বে গিয়ে শেষ হয়। নারীরাও দিব্যি তা মেনে নিয়েছেন। তারা স্বামীকে প্রভু মানেন এবং আরাধনাও করেন।

প্রচলিত গণমাধ্যমেও স্বামীদের এরকম প্রভুগোছের আচরণ করতে দেখা যায়। আর স্ত্রীদের মাথা পেতে প্রভুর আদেশ, উপদেশ, অত্যাচার মেনে নিতে দেখা যায়। শুধু তাই না, তারা স্বামীকে খুশি রাখা রীতিমতো ধর্ম পালনের মতো করে পালন করে। আমার ভাষায়, সে ধর্মের নাম “শাবানা ধর্ম”।

এখন আমরা পরের পর্বে আসি।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যখন আমি বুঝতে পারি যে, আমার স্বামী ঠিক প্রভু বা ঈশ্বরের মতো না। আমি ছোটবেলা থেকে যেমন পুরুষের বর্ণনা শুনে এসেছি, সে ঠিক সেরকমও না। তার সাহায্য লাগলে সে এমন ভাব করে না যে, আমি তাকে সেবা করে বেহেস্তে চলে যাবো। বরং সে নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে আমার কাছে সাহায্য চায়। ভুল করলে স্বীকার করে। আমার কর্মকাণ্ডে সে ল্যাং মারে না, আমাকে কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রেখে নিরাপদ করার চেষ্টাও করে না। লাগলে সাহায্য করে।

14269804_10208922711037874_936094233_nমাসকিউলিনিটির সংজ্ঞায় এমন পুরুষদের বলা হয় পজিটিভ বা মার্জিনাল মাসকিউলিন। তারা একজন মানুষ যেমন হওয়ার কথা, ঠিক তেমন। তবে সমাজের সংজ্ঞাটা এতো সাধারণ না। আমাদের সমাজ এ ধরনের পুরুষদের বলে স্ত্রৈণ, বৌয়ের আঁচল ধরা, ভেরুয়া এবং এমন অনেক কিছু।

তাহলে এখন জানতেই হবে আমাদের সমাজ ‘পুরুষ’ কাদের বলে? পুরুষ হলো তারা, যারা একটু তর্জন-গর্জন টাইপ হয়। যাদের কথায় পরিবারের মানুষ খুব দাম দেয়। যাদের কথা হচ্ছে শেষ কথা, যে অন্য কারও মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। এবং বলাই বাহুল্য তার অধীনস্থ সবাই তার কথার এক চুল বাইরে যায় না। এদেরকে “আলফা মেইল” বলে। মাসকিউলিনিটির সংজ্ঞায় এ ধরনের পুরুষকে বলে হেজেমনিক মাসকিউলিন। সহজ কথায় এরা প্রভাব বিস্তার করে।

পরিবারকে যদি একটা রাষ্ট্র ভাবেন, আর পুরুষকে যদি রাষ্ট্রপ্রধান, তাহলে মার্জিনাল মাসকিউলিনরা হলো গণতন্ত্রের নিয়মে চলে আর হেজেমনিকরা একনায়কতন্ত্রের। লক্ষ করুন, আমি কিন্তু বলিনি কোনো একধরনের পরিবারেও নারী রাষ্ট্রপ্রধান। কারণ এটা আমাদের প্রচণ্ডভাবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় খুব বিরল উদাহরণ। একমাত্র কোনো প্রকার পুরুষের (যেমন, বাবা, ভাই, চাচা, মামা, খালু, নিদেনপক্ষে একটা নাবালক পুত্র) সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিতে এটা হয়, অন্যথায় নয়।  

এখন উদাহরণটা বুঝতে সুবিধা হবে, বছরের পর বছর একনায়কতন্ত্রের এই ধারা চলতে চলতে তারা আর মানুষের পর্যায়ে নিজেদের ভাবতে পারে না। তারা নিজেকে ঈশ্বর ভাবা শুরু করে। আর বেমালুম ভুলে যায় যে এর ব্যতিক্রমও কিছু হতে পারে।

পুরো বিষয়টা একটা সময় এসে সমাজে এমনভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছে যে, নারীরাও মোটামুটি মেনে নিয়েছে যে, পুরুষ সব সময় উপরেই থাকবে, এবং নারীকে অর্থাৎ তাকে বশ্যতা মেনেই চলতে হবে। এই পরিক্রমায় যুগে যুগে ঘরে ঘরে শাবানা ধর্ম পালন হয়ে আসছে। একজন মাতা শাবানা আরেকজন কন্যা শাবানা তৈরি করে। ধর্ম, লৌকিকতা, উৎসব সব কিছুতেই শাবানার রীতি প্রবেশ করানো হয়, আর ধরে নেওয়া হয় এটাই আদর্শ অবস্থা।

OLYMPUS DIGITAL CAMERA
ছবিটি সংগৃহীত

এই আদর্শ অবস্থার চিড় ধরায় একজন মার্জিনাল মাসকিউলিন। সে ভাবে, আরে এমন কেন হবে মেয়েরা রান্না করে ঘেমে এসে পরে এঁটোটা খাবে? সে রান্না করতে যায় না বটে, তবে সঙ্গীকে প্রথমটা, ভালোটা খাওয়ায়। টেবিল গোছানোর বা খাওয়া শেষে থালা ধোয়ার কাজটা করে। সে তার সঙ্গীকে ভালোবাসে, তার ভালো চায়। বিশ্বাস করে সঙ্গীর সাফল্য, তারও সাফল্য। সঙ্গীর সাফল্যে সে খুশিও হয়।

আমার মনে হয়, একজন নারী যুদ্ধ করে যতোটা না এগুতে পারে, এমন একটা সহযোগিতামূলক পরিবেশ পেলে তার থেকে বেশি এগুতে পারে। যুদ্ধ করলে এক পা আগালে দশ পা পেছানোর ভয় থাকে, ক্লান্তি আসার ভয় থাকে। এই পরিবেশে হয়তো ৫০-৫০ ভাগ হয় না। তবে নারীর মনে আস্থা আসে যে তার বিষয়ে ভাবার কেউ আছে।

যারা আগানোর চেষ্টায় দশ পা পিছাচ্ছেন এই ধরনের পরিবেশ তাদের মনে আশার সঞ্চার করে। তারা ব্যতিক্রমের চেষ্টা করেন। সমস্যাটা বাঁধে সেখানে।

ভণ্ড ঈশ্বররা লালসালু জড়িয়ে দিব্যি বৌকে দিয়ে পা টেপাচ্ছিল। বৌয়ের সব কিছুর মালিকানা তাদের। এমনকি জীবনেরও। বৌয়েরাও সব তাকে সঁপে দিয়ে তার নাম জপ করছে, সর্বক্ষণ তার সেবায় নিয়োজিত আছে, আর দুরু দুরু বুকে তার মঙ্গল কামনা করছে পাছে ঈশ্বরের কিছু হয়ে গেলে তাদের কী হবে!

ক্লান্ত দেহ এবং মনে তারা দেখে একজন নারীকে, যে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে। তাকে কেউ শুধু অমুক ভাবি বা তমুকের বৌ নামে চিনে না। তার দিব্যি নিজের একটা পরিচয় আছে। মাঝে মাঝে এই পরিচয় তার স্বামীও গায়ে জড়িয়ে খুশি হয়ে উঠছে। জন্ম শাবানাদের মনে প্রশ্ন আসে, আমি কী এটা পারতাম না?

আমার সব সময় মনে হয়, সব সমস্যার মূলে এই প্রশ্নটা। কোনোভাবে যদি এই শাবানারা এই প্রশ্নটা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারতো, এই সমস্যার তৈরিই হতো না। অনেক শাবানা আসলে এই প্রশ্ন করেই না। তারা দিব্যি প্রভু-দাসী মিলে বখে যাওয়া মেয়েলোকের গীবত গায়, আর তারা সুখেও আছে।

পথভ্রষ্ট শাবানারা হলো আমার জীবনের সমস্যার কারণ। তারা বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহ রোধ করতে তাদের ঈশ্বররা আমার নশ্বর সঙ্গীকে ঈশ্বরীয় শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে। তাকে ভেরুয়া বলে, স্ত্রৈণ বলে আর তার পুরুষত্বই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে।যেহেতু সাধারণ নশ্বর পুরুষ একজন ভালো মানুষ, সে এতো সাত-পাঁচ সহজেই বোঝে না। ফলে সে উল্টা গীত গেয়ে তাদের ফেরানোর দাওয়াত না দিয়ে নিজেই ঐ গর্তে পা ফেলে বসে। শুরু হয় বিচ্যুতির।      

প্রথম পর্বটির লিংক: https://womenchapter.com/views/16714

শেয়ার করুন: