পৃথা শারদী: সেদিন বাদাম খাচ্ছিলাম আর বাইরে পড়তে যাওয়া নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছিল কাজিনদের সাথে। কথায় কথায় কথা উঠলো, মেয়েমানুষের একা একা দেশের বাইরে যাওয়া ঠিক না। আমি এমনিতেই বেশ চড়া মেজাজের মানুষ, এমন ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বললে আমি ছেড়ে দেব, এটা স্বপ্নেও ভাবা ভুল।
আমি কচকচ করে বাদাম চিবুতে চিবুতে বললাম, “এ ব্যাটা! মানুষ মানে মানুষ, মেয়ে আর ছেলে কীরে! মেয়েমানুষের যদি বাইরে একলা যাওয়া ঠিক না হয়, তো পোলা মানুষেরও উচিত বিয়ে করে বাইরে যাওয়া, একা একা সে বিদেশ ঘুরে পেটে-পিঠে বিদ্যা আর অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে এসে পটাপট মেয়ে বিয়ে করবে, আর আমি কি ঘরে বসে বসে তার জন্য সেমাই রান্না করা শিখবো নাকি, ও গেলে আমিও যামু”!
আমার কাজিন আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, “তুই একটা নারীবাদী”, আমি আরো কিছু বাদাম মুখে পুরে বললাম, “আমি মানববাদী’’।
পাশের বাসায় এক দম্পতির বাস। ১০ বছরের দাম্পত্য জীবন তাদের। স্ত্রী ভয়ানক মাত্রায় পান খান ! কথায় কথায় পান চাবান, মুখ থেকে ভুরভুর করে হাকিমপুরী জর্দার সুবাস আসে। বাচ্চাদের অকারণে মারধোর করেন, সারাক্ষণ এর সাথে রাগ, তার সাথে কথা কাটাকাটি। স্বামী উত্তর, তো উনি দক্ষিণ, স্বামী যতই স্ত্রীকে বোঝাতে যান হিতে বিপরীত হয়, রাত বিরেতে স্বামীকে পেটান।
একদিন মাঝরাতে ভদ্রলোক নাকের উপর এক কাটা দাগ নিয়ে হাজির হলেন, কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘বৌ মেরেছে, তার মা-বাবার সামনে!” কী অপমান! কী অপমান! ফি হপ্তায় স্বামী-স্ত্রী আমাদের বাসায় এসে আলাদা আলাদাভাবে একে অপরের নামে কেচ্ছা গেয়ে যান, মা-বাবা বসে বসে তাদের কেচ্ছা শোনেন, কেচ্ছা মেটান।
কোন লাভ তাতে হয় না, ভদ্রলোকের স্ত্রী তার রাক্ষুসী ভূমিকায় সদা তৎপর। তাদের কেচ্ছা শুনতে শুনতে আমি মেজাজ খারাপ করে বাসায় বেড়াতে আসা কাজিনকে বললাম, “এরা ডিভোর্স নেয় না কেন!’’
সে চোখ কপালে তুলে বললো, “নারীবাদী হয়ে একী কথা, মহিলার পক্ষ নে!’’ মুখ ব্যাকা করে জবাব দিলাম, “ঘটনার সাথে নারীবাদী হবার কিছু নাই, লোকটার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, চেষ্টা করেও এই বিচিত্রমনা, আধপাগলা মহিলার সাথে থাকতে পারছে না, লোকটার জন্য, বাচ্চাগুলোর একটা ভালো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ডিভোর্স দরকার, লোকটি ভীষণ নির্যাতিত!’
আমার কাজিন ফিক করে হেসে বলে, “ভূতের মুখে রাম নাম! নারীবাদী হয়ে একজন পুরুষের পক্ষ নিস ক্যান!”
“তুই একটা অকাট্য গাধা” বলে দাঁত খিচিয়ে সরে আসলাম।
উপরের ঘটনা দুটো লেখার কারণ একটাই, পৃথিবীতে নারী-পুরুষ এই দু পক্ষই সমান তালে নানাভাবে ভোগান্তি পোহাচ্ছে, হয়তো ভোগান্তি পোহান নারীরা বেশি, পুরুষেরা কম, তবে তারাও পোহান। যারা আজ নারীদের ভোগান্তি দূর করতে সাহায্য করেন তারা নারীবাদী হয়ে যান, যারা একটু অসহায় পুরুষের পক্ষে কথা বলেন অমনি তারা পুরুষতান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছেন!
নারীবাদী, পুরুষতান্ত্রিক আমাদের অভিধানের প্রিয় দুটো বিশেষণ। যদিও এই বিশেষণগুলো আমাদের নিজেদেরকেই খুব সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছে। মনের দীনতা প্রকাশে সহযোগিতা করছে। একজন নারী তার প্রাপ্য অংশটুকু পাচ্ছেন না, তার চাওয়া-পাওয়া থেকে, প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তার অধিকারের জন্য লড়ছেন প্রতিনিয়ত, সে লড়াইয়ে কেউ সামিল হলে তাকে বলে দিচ্ছি নারীবাদী! অনেকটা বর্ণবাদ প্রথার মত! পুরুষের জন্যও একি নিয়ম!
একজন পুরুষ ভালো থাকতে পারছেন না ,তা নিয়ে কেন একজন নারী কথা বলতে পারবেন না! এতো বিদ্বেষ কেন থাকবে! একজন পুরুষ যখন একজন নারীর বিপদে তার পাশে দাঁড়ান তাকে অনেকেই বলেন, নারীঘেঁষা, নারীবাদী লোক! আজকাল সহজে খুব সহজে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা পুরুষ পাওয়া যায় না, যদি পাওয়াও যায়, যদি সেই পুরুষ ঘরের এটা-সেটা কাজ হাতে হাতে করে দেন, যদি কোন পুরুষ সকালের খাবারটা নিজ হাতে বানান সঙ্গীনিকে এক বেলার জন্য নিস্তার দিয়ে, যদি তিনি মেয়েটির মা-বাবাকে সময় দেন তো তাকে স্ত্রৈণ বলা হয়। কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকার কাজে সাহায্য করলে, তার পড়াশোনায় সাহায্য করলে তাকে মেণীমুখো বলা হয়!
একজন নারীই যখন তার পাশে থাকা পুরুষের জন্য অহরহ করে যাচ্ছেন, তাকে তো আমরা ভুলেও পুরুষবাদী বলি না, বরং তাকে আমরা লক্ষ্মী মেয়ে বলেই আদর করে ডাকছি।
কী একটা সমাজ রে বাবা! নারী হলে নারীকেই সাহায্য করো এবং নারীবাদী হয়ে যাও, পুরুষ যদি হও তুমি ভুলেও নারীকে সহায়তা করো না, তোমার সব সাহায্য তোলা পুরুষের জন্য, তুমি পুরুষবাদী হবে! এত ব্যত্যয় হলেই তুমি হ্যান, তুমি ত্যান! তুমি খারাপ, তুমি পচা! তুমি সব!
আচ্ছা ,আজকালকার যুগে এত স্বার্থপর হলে কি চলে ,বলুন?
চলুন না, কারো সমস্যায় তাকে নারী কিংবা পুরুষ হিসেবে চিন্তা না করে শুধুমাত্র একজন মানুষ হিসেবে দেখি ,তারপর যা ভালো হবে ঠিক তাই করি! কোন পার্থক্য না খুঁজে!
এই নারী-পুরুষের ভেদ ভুলে আমরা একটু মানববাদী হই। নারী-পুরুষের সুখ-দু:খ, চাওয়া-পাওয়া, অধিকার আদায়ের ক্ষেত্র আর আলাদা করে না দেখে সব অসুখে, দু:খে ভোগা মানুষের সুখ-দু:খগুলো মেটাতে সাহায্য করি! সুখে থাকার অধিকার, একা থাকার অধিকার, দোকা হবার অধিকার, জীবনকে নিজের মতো উপভোগ করার অধিকার তো সব মানুষেরই আছে! সেই পরিচয়ের আধিপত্যেই আজ চলুন আমরা মানববাদী হই!
নারীবাদ-পুরুষবাদের রশি টানাটানি বাদ দিয়ে আমাদের একটু মানবিক হওয়াটা আজ নিজের জন্যই খুব দরকার। হয়তোবা এই মানবিকতার জোরেই নারী-পুরুষ একে-অন্যের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বলতে পারবো, আমরা একে-অপরের খুব আস্থা ও শ্রদ্ধার পাত্র, সেদিন হয়তো নারীর নিরাপত্তার জন্য এতো ভাবতে হবে না, সেদিন হয়তো খুব সহজে একটা সংসার দু ভাগ হবে না! একবার তো সবাই চেষ্টা করি!
জীবন তো একটাই ! আসুন, এই এক জীবনে আমরা মানববাদী হই।