“আই লাভ ইউ….বাট আই লাভ মী মোর”

সুরাইয়া আবেদীন: মাঝরাতে চিৎকার চেঁচামেচি খুব আতংকের বিষয়!
প্রতিবেশীর ঘর থেকে আসছে, ঘুম ভেঙ্গে খুব আতংকে ঝিম মেরে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ, তারপর সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের বিপদমুক্ত করার প্রার্থনা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম…
পরদিন সকাল হলেই দারোয়ানের কাছে খোঁজ নিলাম… অমুক এপার্টমেন্টের তমুক আন্টির মেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল!  

চেনা প্রতিবেশী, দিক কয়েক পর গেলাম দেখা করতে…

suraiya-2দেখলাম অভিমানীকে, লিফটে দুই একবার দেখা হয়েছিল এর সাথে…
কী মায়াবী মুখ!    
এত্তোগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল। হাত কেটেছিল।  
কারণ?
তার প্রেমিকের আরেকটা গোপন সম্পর্কের কথা জেনেছে সে…
এই নিয়ে দিনের পর দিন অশান্তি…
ঐ রাতে ঝগড়ার এক পর্যায়ে বুদ্ধিমতী (!) অভিমানে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মরে যাবে…   
মরলো আর কই?
মাঝখান থেকে বাবা-মাকে দিল একরাশ শারীরিক-মানসিক কষ্ট, অপমান!   
আর পুরো বিল্ডিং এর বাসিন্দাদের মুখে তুলে দিল দিন কয়েকের মুখরোচক আড্ডার টপিক!   

মেয়েদের এই একটা জিনিস দেখলে ভয়াবহ রাগ লাগে। প্রেমিকের প্রতারণা ধরা পরার পর, প্রেমের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে এমন ভাব করে একেকজন যেন ঐ একজন ছেলেই তার জন্য বরাদ্দ ছিল এই পৃথিবীতে।
ফিরিয়ে আনার জন্য কী আকুতি!
যতো নিচে নিজেকে নামানো যায় ঠিক ততোটাই নামাবে…

হ্যাঁ, একটা লেভেল পর্যন্ত চেষ্টা অবশ্যই করবে…কিন্তু ‘শেষ চেষ্টা’ বা ‘শেষ বারের মত’ বলে কোন সীমা থাকবে না?
নিজের পড়াশোনা,পরিবার, ক্যারিয়ার- সব তুচ্ছ হয়ে যাবে ঐ একজন প্রতারকের জন্য?
এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত?
সহজ, একদম সহজ হিসাব হলো- যার কাছে তুমি মূল্যবান সে তোমাকে যেকোনো কিছুর বিনিময়ে জীবনে পেতে চাইবে, পাশে রাখবে।
যে চাইবে না, তুমি ঐশ্বরিয়া হলেও চাইবে না।

‘আমার সাথে এমন করলো কেন’/ কিংবা ‘আমার কী দোষ ছিল?’- এসব প্রশ্নের কোন উত্তর হয় না।
সম্পর্ক ধরে রাখতে কারণ লাগে না। তেমনি লাগে না ভাঙতেও।
আবার যার ভাঙতে হবে সে কোটি কারণ সামনে এনে দাঁড় করাতে পারে, তেমনি পারে তোমাকে বেঁধে রাখতে তুচ্ছতম অজুহাতেও।
মানুষের মন অদ্ভুততম জিনিস। প্রেমের চালকও এই ‘মন’।

এই ‘মন’ ই যখন আর চায় না কিংবা বেঁকে যায়, তখন সারা পৃথিবী খুঁজে প্রেমিকার জন্য একসময় ১০৮ টা নীলপদ্ম এনে দিতে চাইতো যে প্রেমিক, কিংবা ঝগড়ার পর অভিমান ভাঙাতে বার বার আবৃত্তি করত ”আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু  তোমার জন্য” -সেই একই প্রেমিক ফিরে তাকাবার সময়ও পায় না তার প্রেমিকার দিকে..।
মানুষের এই পরিবর্তন স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক শুধু এই পরিবর্তনের কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা খুঁজে না পাওয়া। কিন্তু মেয়েরা এই ব্যাখ্যা পেতে কী মরিয়া!

কেঁদে কেটে চোখের কাজল লেপটে ফেলে…টিপের পাতায় ধুলো জমতে দেয়…
চারুকলার সামনে থেকে কেনা শখের চুড়িগুলোকে রিনিঝিনি শব্দে আর বাজায়ই না… পায়ের নূপুর জোড়া করে রাখে বাক্সবন্দী… প্রতিজ্ঞা করে নীল শাড়ি পরবেই না জীবনে…কিংবা খুব অভিমানে রবীন্দ্র সঙ্গীতই শোনা ছেড়ে দেয়… কেননা সব গানেই যে ‘সে’ ছিল…
আর কেউ কেউ তো জীবনই দিয়ে দেয়…।

আহা!
কত অভিমান!
এই অভিমানেই গেল এসব মেয়েদের জীবন।

জীবনের সংজ্ঞা এরা নির্ধারণ করে কোন এক প্রতারককে না পাওয়ার মধ্য দিয়ে…
জীবনের সময় এরা অপচয় করে কোন এক বিশ্বাসঘাতকের ফিরে আসার অপেক্ষায়…
জীবনের সৌন্দর্য এরা ধূলিসাৎ করে কোন এক স্বার্থপরের দেয়া আঘাতে অপমানে…

আহা!
কী বোকা!
কী সরল!
কী নিষ্পাপ!

প্রিয় সরল, কোমল, নিষ্পাপ মেয়েরা…এ পৃথিবীতে সবচে মূল্যবান এবং একই সাথে সবচে ক্ষণস্থায়ী বস্তুটি হচ্ছে ‘জীবন’…

তোমার এ জীবন এতোই মূল্যবান যে, একে প্রাণ দিতে তোমার মা রাত দিন নয় মাস অবর্ণনীয় কষ্ট করেছেন…  
চমৎকার একটা সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিবেশে তুমি যেন বেড়ে উঠতে পারো তার জন্য তোমার বাবা দীর্ঘ সময় মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন।

কোন এক প্রতারকের প্রতারণার কেন এতো মূল্য তোমার কাছে যার জন্য বাবা মায়ের এত কষ্টের বিনিময়ে পাওয়া ‘জীবন’ কে তুচ্ছ করতে তুমি একটা বার ভাব না?

প্রতারককে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা কর, অথচ নিজের বাবা-মায়ের চোখে পানি আনতে এক মুহূর্ত চিন্তা করো না পর্যন্ত!

যে তোমাকে চায় না, কেন তুমি তাকে চাইবে?
যে তোমাকে ঠকায়, কেন তুমি তার জন্য নিজের পরিবারকে ঠকাবে?
যে তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে কেন তুমি তার জন্য নিজের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার ছুঁড়ে ফেলবে?

আয়নার সামনে দাঁড়ালে যাকে দেখ সে কি এতই ফেলনা?
যে প্রতিবিম্ব আয়নায় দেখা যায় সে তো মূল্যবান একজন মানুষের, যার আত্মসম্মান আছে, যার আছে কারো কাছে একমাত্র প্রিয়তমা হয়ে বেঁচে থাকার যোগ্যতা।- এভাব কেন ভাবতে শেখ না?  

আমেরিকান জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’র সামান্থা জোন্স এর তার প্রেমিকের উদ্দেশ্যে দেয়া একটা ডায়লগ আমার খুব পছন্দের।  
তা হলো- ‘I love you… but I love me more.’  

অন্য কাউকে নিজের চাইতে বেশি ভালোবাসার মত বোকামি আর কিছুতে নেই।
তার উপর তা যদি হয় প্রতারক প্রেমিকের জন্য, তাহলে সেই বোকামির পরিমাণ যে কতখানি তা পরিমাপের একক এই দুনিয়ায় এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয় নাই।  

সম্পর্কে প্রতারণা হচ্ছে কনিয়াম ম্যাকুলেটাম (হেমলক প্ল্যান্ট) এর মতো, এ লতা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে আর নিঃশেষ করে দেয় সম্পর্কে সবচে উৎসর্গিত মানুষটাকে।  
অথচ কনিয়াম ম্যাকুলেটাম এর বদলে যদি আইভি বেড়ে উঠতো, বিশ্বাস আর আস্থার যত্নে, তাহলে ‘সম্পর্ক’ অবিশ্বাসের কুরুক্ষেত্র না হয়ে বোধকরি ছোট্ট একটা ‘স্বর্গ’ হতে পারতো…     

সম্পর্কের ‘কনিয়াম ম্যাকুলেটাম’ মনের উষ্ণতায়, মায়ায় আর নিজেকে শেষ করে দিয়ে বাড়তে দেবে নাকি বিষাক্ত এ  লতার বীজ যে বুনে দিল, যা একসময় বিষবৃক্ষ হয়ে জীবনের সকল সৌন্দর্য আস্বাদনের পথে একমাত্র বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে, তাকে ছুঁড়ে ফেলে স্বাধীন, সুন্দর, মুক্ত জীবনের পথ বেছে নেবে সে সিদ্ধান্ত খুব বড় ভুল করে ফেলার আগেই নিয়ে নাও মেয়ে…  
খুব বেশি দেরী হবার আগেই সামান্থার মতোই বলতে শেখো,  ”I love you… but I love me more.”

 

শেয়ার করুন:

সম্পাদক ম্যাডামকে টিভিতে স্বাক্ষাতকারে দেখলাম, উইমেন্ চ্যাপ্টারের বেশিরভাগ লেখা আমার পছন্দ । নারীদের এরকম একটা প্লাটফর্ম দেয়ার জন্য আপনাকে হৃদয় নিংড়ানো নিখাদ ভালবাসা এবংশ্রদ্ধা।