শাশ্বতী বিপ্লব: ফেসবুক একটা আজব কারখানা। কত রকমের মানুষের যে দেখা মেলে এখানে। সবারই সব বিষয়ে কিছু না কিছু বলার আছে।মতামত, আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, ঘৃণা, যেকোন কিছু প্রকাশের স্বাধীনতার ষোলআনা পুষিয়ে নেয়া যায় এখানে।সেই মত বা অনুভূতি কেউ শুনলো কি না শুনলো, মানলো কি না মানলো, শোভন হলো কি হলো না, ইত্যাদির খুব একটা ধার না ধারলেও চলে।

যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, কিন্তু তাতে অসামাজিক অভিব্যক্তির প্রকাশ চলে দেদারসে। তারই কিছু নমুনা দেখে এলাম রাবেয়া কুলসুম পিংকির দেয়ালে। রাবেয়া কুলসুম পিংকি একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। আত্মহত্যা করছেন। কিন্তু কোথাও কোন ইঙ্গিত রেখে যাননি, অভিযোগও করেননি কোন।এমনকি লিখে জাননি কোন সুইসাইডাল নোটও। ফেইসবুকের শেষ স্ট্যাটাসে শুধু লিখে গেছেন ‘সবাইকে ধন্যবাদ।’
পিংকির ধন্যবাদে স্বাভাবিক কারণেই খুশী হয়নি কেউ। এভাবে নিজেকে শেষ করে দেয়া, এতো সহজে হার মেনে নেয়াটা কেউ মেনে নেয়নি। নেয়ার কথাও নয়।
“আত্মহত্যায় কোন বাহাদুরী নেই, বেঁচে থাকাটাই কৃতিত্ত্বের” – এই কথাগুলো নিয়ে এই সেদিনও কত আলোচনা, সমালোচনা হলো।
আকতার জাহান জলির আত্মহত্যার পর আমরা কত কিছু লিখলাম। জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানালাম। বললাম জীবন মূল্যবান। এভাবে হেরে যাওয়া তোমাকে মানায় না। তারপরও আরেকটা তাজা প্রাণ ঝরে গেলো। আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
খবরটা পড়লাম। মন খারাপ নিয়ে পিংকির প্রোফাইলটা দেখতে গিয়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফিরলাম। মানুষটা দেখবে না, পড়বে না জেনেও কত অদ্ভুত রকমের মন্তব্যে ভরে গেছে তার দেয়াল! স্ট্যাটাসের নীচে চেনা অচেনা মানুষেরা এসে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। যাকে উদ্দেশ্য করে লিখছে তার কাছে এসবের কোন মূল্য নেই জেনেও!
বেশিরভাগই তার ছাত্র ছাত্রী। তারা দুঃখ প্রকাশ করছে, পরকালের জন্য মঙ্গল কামনা করছে। কেউবা হতাশাও প্রকাশ করছে। কেউ প্রশ্ন করছে, জানতে চাইছে ম্যাম কেন এরকম করলেন। এগুলো তাও বোঝা যায়।
কিন্তু, এসবের মাঝে কিছু মানুষ তার জন্য জাহান্নাম কামনা করছে! লিখেছে, “জাহান্নামের জ্বালানী হলেন। জাহান্নামেই জ্বলুন চিরকাল।” অথবা ফান করার চেষ্টা করেছে কেউ। লিখেছে, “কিল্লাই আফা?” বা, “উনি সুইসাইড খাইসেন” ধরণের মন্তব্য।
একজন ইংরেজি হরফে লিখেছে, “আপনাকে বিয়ে করার জন্য কি ভালো ছেলের অভাব ছিলো? ফালতু কারণে সুইসাইড করলেন। এটা আপনার প্রোপার্টি নয় যে আপনি চাইলেন আর নিজে নিজে হত্যা করলেন নিজেকে।আর চলে গেলেন চিরস্থায়ী জাহান্নামে। অবশ্যই আপনি জাহান্নামী যদি করে থাকেন সুইসাইড।”
প্রতিটা মৃত্যুর পিছনে গল্প থাকে। থাকে চাওয়া পাওয়ার গড়মিল। থাকে হতাশা। যে মানুষটাকে বেঁচে থাকতে কেউ বোঝেনি, সেই মানুষটাকেই মরে যাওয়ার পর জ্ঞান বিতরণের মানুষের অভাব হচ্ছে না!
পিংকি পড়বেন না জেনেও যারা তার প্রোফাইলে গিয়ে এসব কুৎসিত, কদাকার মন্তব্য করছেন, কেমন মানুষ তারা!! একজন মানুষের মৃত্যুতে শোক জানানো বা তার আত্মার মঙ্গল কামনা করাই সামাজিক রীতি ছিলো এতোদিন। এই সামাজিক মাধ্যমে নতুন অসামাজিক রীতি চালু হয়েছে বুঝতে পারলাম।
এতো অবাক হওয়ার হয়তো কিছু নেই। বরং এই আত্মহত্যার পিছনে কোন প্রেমঘটিত বা দাম্পত্য সমস্যাজনিত মুখরোচক গল্প যে এখনো চাউড় হয়নি সেটাই বিস্ময়ের!! তাই হয়তো পিংকি অগ্রিম ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন সবাইকে।