পৃথা শারদী: ফেসবুক ঘাঁটছিলাম, চোখে পড়লো কী একজন গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কোন না কোন বাগেরহাট না কই! অবাক হলাম! ধর্ষণের শিকার হয়েছেন! এ আর এমন কি! মেয়েই তো ধর্ষিত হয়েছেন, ছেলে তো নন! তাতে কেন এতো মাথাব্যথা! এ তো এ দেশে ভাত-ডাল কিংবা ডাল-ভাত!
সেই নারীকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে। ওই নারী সিঁথিতে সিন্দুর নামের কী একটা লাল আবীর পরেন তার স্বামীর মঙ্গল কামনায়, তার মানে জাতে তারা হিন্দু! কে না কে এক সোবহান মোল্লা তাকে খুব শারীরিকভাবে চাইতো, পেয়েও আসছিল বলপূর্বক, আসলে দুর্বলের কোনো শক্তি থাকে না তো! সেদিন নানাভাবে কৌশলী হয়ে ঘরে ঢুকে স্বামীকে খুন করতে গেল ‘তরবারি’ দিয়ে, বৌটি গেল স্বামীকে বাঁচাতে, ফলাফল সেই বৌটির পা গোড়ালিসহ কেটে আলাদা হয়ে গেল তরকারির কোপে।
আচ্ছা, আদতেই কি এটা ফলাও করে বলার মতো কিছু! অন্ততপক্ষে এই দেশে! আহ! সংখ্যালঘু গৃহবধুকে ধর্ষণ! এই নারী না হয় সংখ্যালঘু, তার না হয় পায়ের তলার মাটি নিজের বলে দাবি করার জো নেই, সে না হয় ‘মালাউন’, কিন্তু সেই হিজাব পরিহিত তনু নামের নম্র মেয়েটির তো ছিল নায্য বিচার পাওয়ার অধিকার!
এই গৃহবধূকে না হয় খুন করা হয়নি (হয়তো বা খুন করা হতো, সময়ের অভাবে খুন করা যায়নি) কত হাজার মেয়েকে তো খুন করে, মাথা থ্যাঁতলে দিয়ে, কারো সারা শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে, কারো কারো হাত পায়ের রগ কেটে দিয়ে কষ্ট দেয়া হলো। সবাই কমবেশি কষ্ট পেয়ে মরেও গেল।
আমাদের এই কিম্ভুত-অদ্ভুত সমাজ খুব নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, এ সমাজ নারীদের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল, সেই সমাজ চায়, যাতে নারীরা সকল ব্যাপারে নায্য অধিকার ভোগ করেন, নারীরা যাতে নিরাপত্তা পান!
এ দেশের বিচার বিভাগও তার ব্যতিক্রম নন । তবে এসব ধর্ষণের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের খুব সুবিধা হয় যদি সে নারী ধর্ষকের বীর্যটুকু নিজ শরীরে ধারণ করে অক্কা পান তো ! মরে গেলে বিচার হয় মামলার কয়েক বছর পর, তাও সব ধর্ষিতার মামলা একঢালা পাটক্ষেতের মতো মৃদুমন্দ হালে দোল খায়, যাদের কিনা খুব পয়সার জোর সেই মামলাগুলোর অনেক অনেক অনেকদিন পর সালিশি হয় , বিচার সাদামাটাই হয়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, ফাঁসি দেয়া হয় খুব কম। আসলেই ফাঁসী কেন দেয়া হবে ! যদিও ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসীই এ দেশে, তাও!
এ গেল নির্যাতিত নারীটি মারা যদি যান তো ! আর যদি মারা না যান! আহ! তাহলে তো মজ্জাই মজ্জা! কথায় আছে যেদিন কোন রেপ কেস কোর্টে তোলা হয় সেদিনই কোর্টে ভীড় বেশি হয়। শুরু করা হয় ধর্ষণের শিকার মেয়েটির যাবতীয় আলামত দিয়ে। মেনেই নেয়া হয় যিনি ধর্ষিতা হবেন তার চরিত্রে সমস্যা ছিল, যদি অববাহিতা হন তাহলে তার একাধিক পুরুষ সংসর্গ ছিল, আর যদি বিবাহিতা হন তো তার যৌনজীবন ভাল ছিল না। ধর্ষকের সাথে তার বেশ মাখামাখি সম্পর্ক ছিল, কোন না কোনভাবে চরিত্রবান ধর্ষককে আজ ফাঁসাবেন বলে এই চরিত্রাহীনা নারী এই ধর্ষণের মামলা ফেঁদেছেন।
আরেকবার সবার সামনে তাকে একপ্রকার মানসিক ধর্ষণ করা হয়। সবাই এটা খুব উপভোগও করেন।
যারা শোনেন, তারা মনে মনে কল্পনা করেন তারা ছিলেন ধর্ষকের ভূমিকায় , তাদেরই এক জ্ঞাতির দ্বারা ছিবড়ে হয়ে যাওয়া এক মেয়ের কাছে সেই যৌনসংগমের বর্ণনা শুনে সেখানে নিজেকে কল্পনা করে নিতে কোন পুরুষের না ভালো লাগে !
একজন পুরুষের কাম প্রশমন করা, গরম শরীর ঠাণ্ডা করা একজন “মাইয়া মানুষের “ শতভাগ দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে আজকাল! যে কেউ যে কাউকে বলপূর্বক শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করছেন, সেই ইয়াসমিনের কথা মনে পড়ে যায় , শাজনীনের কথা মনে পড়ে খুব, সেই দু বছরের শিশুর কথা খুব মনে পড়ে, যার শরীর থেকে পাওয়া যেত স্বর্গীয় ঘ্রাণ।

আজকে কোন না কোন সোবহান মোল্লাকে নিয়ে আমরা খুব রেগে যাচ্ছি কিন্তু আদতে কী হচ্ছে ! কিছুই কি হচ্ছে! এমন কতো কতো গৃহবধূ দিনে-রাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, কত প্রেমিকা কত প্রেমিকের কাছে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, বাইরে সুন্দর মুখোশ পরে থাকা কত ভালো চৌকষ অফিসার রাতের বেলা তার অর্ধাঙ্গিনীকে বলপূর্বক শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করছেন, কত ছোট ছোট মেয়ে গৃহশিক্ষক দ্বারা এই অপমানের শিকার হচ্ছে কিংবা অফিসে? কত নারী তার বসের দ্বারা এই নির্যাতনের শিকার, আমরা তো কেউ তার খবর রাখি না!
সেই অনেক আগে ইয়াসমিনকে পুলিশেরা যখন মহাসমারোহে যন্ত্রণা দিয়ে গেল, তখন সবাই চুকচুকিয়ে বলেছিল, “আহা, কাজ করতে গেল, গরীব ছিল! বুঝবে না দিনকাল”!
যখন তনুকে ধর্ষণ করা হলো তখন সবাই জিব চুকচুক করে বললো, “মেয়েটা হিজাব পরতো গো, তাও এমন হলো”!
আজ এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করা হলো, জিভ দ্বিগুণ গতিতে দ্বিগুণ শব্দে চুকচুক করে উঠে সবাই বলছে, “আহা গো, হিন্দু ছ্যাল গো”!
সবারই বোঝা ও জানা উচিত ধর্ষণ মানে ধর্ষণ, একজন নারীর অনুমতি ব্যতীত বলপূর্বক যেকোনো শারীরিক সম্পর্ক মানেই ধর্ষণ। ধর্ষণ শব্দটি শাস্তি দেবার জন্য যথেষ্ট। এই শব্দের আগে নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করে মেয়েটিকে সবার করুণার পাত্রী করার মানে নেই।
এক্ভইবে ধর্ষক মানে ধর্ষকই, সে যত মহৎ যত শীর্ষপদে কিংবা সমাজের যত নিচু পদেই থাকুন না কেন, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। ধর্ষণের শাস্তি একটাই, মৃত্যুদণ্ড।
প্রিয় সমমনা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, চলেন আমরা এই জিভের চুকচুকানি দ্বিগুণ হারে করি, পরের ঘটনার জন্য জিভকে রেডি করেন, যাতে নতুন বিশেষণে বিশেষায়িত করে ধর্ষিতাকে সবার চোখে করুণার পাত্রী করবেন, আর নিজেরা ফাঁকে- ঝোঁকে সেই বিশেষণ দান করার মহিমায় গর্বিত হবেন।
নারী সমাজ, চলেন আমরা নিজেদের চোখজোড়া অন্ধ করি ,কান দুটোকে বধির করি আর শরীরটা অনুভূতিহীন করি। আমাদের ভুলে যেতে হবে আমাদেরও রাগ আছে, ক্রোধ আছে ,ঘৃণা আছে আর মনের খুব গভীরে ভালবাসা আছে। এই সমাজ, এই নোংরা সমাজ আমাদের কোন অনুভূতিরই যোগ্য নয়।
আর এই যে সুশীল সমাজ ! আজ এই ছোট্ট একটা খবরে ম্যাচের আগার ছোট্ট বারুদের মত ফোঁস করে জ্বলে দপ করে নিভে যাবার কি কোন দরকার আছে! কোন দরকার নেই। এর চেয়ে ভাল চলুন আমরা সবাই চুপ করে থাকি, মুখে কুলুপ এঁটে থাকি, বলা যায় না, এসব নিয়ে কথা বললে যদি নিজেরাই একদিন ভিকটিম হই তো!
জয় হোক সোবহান মোল্লাদের!
হাজার হোক সবশেষে , হীরকের রাজাই ভগবান কিনা। তাও বলি খুব আশা নিয়ে বলি, বিচার যেন হয় ! বিচার যেন হয় !