সন্তানের জন্ম এবং মায়ের শ্বশুরবাড়ির দাপট

মাকসুদা আজীজ: একটা খুব জনপ্রিয় মিম আছে, ‘শাশুড়ি মা আমাকে শেখাতে এসেন না কীভাবে বাচ্চাকে পেলে বড় করতে হয়। আপনার পেলে-পুষে বড় করা একটা পিসের সাথে আমি বাস করি, ফলে আমি খুব ভালোভাবে জানি, আপনার শিক্ষা কতোটা উত্তম’।

এটা একটা ইংরেজি মিম থেকে অনুবাদ করা। ফলে এইটা থেকে সহজেই অনুমেয় এই চিত্র খালি বঙ্গদেশের নয়। এটা কাহানি ঘার ঘার কি!

Maksuda Aziz
মাকসুদা আজীজ

প্রথম যখন ড. টি এ চৌধুরীর কাছে দেখাতে যাই আমি তখন কনসিভ করি নাই। আমার ওভারিতে ডার্ময়েড সিস্ট ছিল, আল্ট্রাসনোগ্রামে ডাক্তার লিখতেন টেরাটোমা। আমার ইনফার্টিলিটি এক্সপার্ট জা সাজেস্ট করলেন এই লাইনে একদম বেস্ট কাউকে দেখাতে, কারণ এটা অবশ্যই ফার্টিলিটিতে প্রভাব ফেলবে।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যখন টি এ চৌধুরীর কাছে পৌঁছালাম, তখন বাস্তবিক অর্থে দেখলাম একটা সন্তানের জন্য মানুষের হাহাকার কীরূপ হতে পারে। আমার আশেপাশে সব ইনফার্টিলিটিতে ভোগা মানুষ। কারও কারও অধ্যাবসায় ১৬ বছর ধরেও চলছে। মোটিমুটি বয়স্ক রোগিদের মধ্যে আমি আর জিকো (আমার স্পাউস) কাচুমাচু হয়ে বসে থাকতাম। আমার বয়স তখন ২৬ বছর, জিকোর মেরে কেটে ৩০। প্রায় প্রত্যেকে আমাদের আলাদা করে জিজ্ঞেস করতেন আমরা এতো কম বয়সে এইখানে কী করি?

একদিন এক মহিলার সাথে আলাপ হলো। উনার অধ্যাবসায়ের ১৩ তম বছর চলছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কখনও কনসিভ করেন নাই? উনি জানালেন, সাত বছরের মাথায় একবার কনসিভ করেছিলেন। এরপর যখন তিন মাস চলছে, তখন ঈদ হলো, শ্বশুরবাড়ির লোকজন কিছুতেই মানলেন না যে বৌ ঈদ করতে শ্বশুরবাড়ির গ্রামে যাবে না। গ্রামের পথে ঝাকাঝাকিতে মিস ক্যারেজ হয়ে গেল। সেই থেকে এখনও ঝুলছে।

প্রতিদিন এরকম অনেক স্টুপিড আলাপ শুনে মনে হতো, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিষয় “শ্বশুরবাড়ির ইগো।”

আমাদের মায়েদের কিছু গ্রুপ আছে। সেখানে আজ শুনলাম একটা ক্রিটিক্যাল বাচ্চাকে ট্রিটমেন্ট দেওয়ার পরে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। দুই মাসের বাচ্চাকে দাদী মায়ের দুধ খেতে দেয় নাই। গরুর দুধ খাইয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে বাচ্চাটা বাঁচেনি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার দাদী বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি সেই দাদী উঠতে বসতে মৃত সন্তানের বোঝা বুকে চেপে রাখা মাকেই শাপ-সাপান্ত করছেন। দোষ দিচ্ছেন।

আমি মাস্টার্সের থিসিস করছি মেটারনিটি ল নিয়ে। এটা নিয়ে প্রায় প্রায়ই এর-ওর সাথে আলাপ হয়। আমি মোটামুটি সবাইকেই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বুঝাই, মেটারনিটি লটা কেন একটা রদ্দি মার্কা জিনিস। এটার প্রথম কারণ এটা কোনো ইউনিভার্সাল ল না। অর্থাৎ বাংলাদেশের সকল মা এই আইনের অন্তর্ভূক্ত না। শুধুমাত্র সেইসব মায়েদের জন্য প্রযোজ্য, যারা একটা ফরমাল জব করেন।

কথা প্রসঙ্গে একদিন এক বন্ধু বললেন, হ্যাঁ আমার মায়ের সাথেও এমন হয়েছে তো। আমরা বাবার পোস্টিং ছিল অমুক জেলায়, আমি হওয়ার পরে আমার মাকে এ্যাসাইলাম দিতে আমার দাদার বাড়িতে পাঠানো হয়েছি। আমার দাদী আমার মাকে দিয়ে ধান প্রসেসিং এর কাজ করাতেন। আমি বলে উঠলাম, সাধু, সাধু, এই না হলে বঙ্গ ললনার ললাট!

তো, আমাদের মাতৃভূমি কথাটা শুধু দায় খাটানোর বেলাতেই। এই যেমন সন্তান হবে, বৌকে পাঠাও বাপের বাড়ি। খরচপাতি যা লাগে দিবে শিশুর নানা। ৪০ দিন কোনো ক্রমে পার হলেই লাগাও দাদার নাম। আর বীজই তো আসলো। মাটি সে তো একটা হলেই হয়।

হাস্যকরভাবে আজকে ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েও দিব্যি বাচ্চার দাদাবাড়ির লোকেরা বীজকেই আসল মানে। পাশে দাঁড়িয়ে নানাবাড়ির লোকেরা ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে তার সমর্থন জানিয়ে যায়। আমার মতো দুই’একজন খারাপ বৌ যখন তেড়ে ফুড়ে জবাব দিতে আসে, তখন বাচ্চার নানী দেঁতো হাসি দিয়ে ঘটনা আড়াল করে, নিজের মেয়ের হাত চাপ দিয়ে নিচু গলায় বলে, “থাক, ওরা বললেই তো সব বদলে গেলো না। সয়ে যাও মা, মা মানেই সর্বংসহা”।

কিছুদিনে আগে একটা সাধ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, আমার আবার সাধ-টাধের ভাগ্য হয়নি। বরং অনেকের সাধ-আহ্লাদে গুঁড়ে বালি দিয়ে আমি মেয়ে নিয়ে দিব্যি বেঁচে আছি। সে যাই হোক, আমাকে বলা হলো, হবু মায়ের কানে কানে একটা আশীর্বাদমূলক কিছু বলতে। হবু মা আমার থেকে বয়সে বড়, তবে মা হিসেবে আমি তার থেকে অভিজ্ঞতায় বড়। আমি মায়ের পাশে গিয়ে জোরে জোরে বললাম, “ষড়যন্ত্র করবো না গো, যা বলবো জোরেই বলবো।” এরপর নাটুকে ভঙ্গিতে হাত তুলে বললাম, “তুমি তোমার বাচ্চার কাস্টমাইজড মা, ওর সবকিছু তুমিই সবচেয়ে ভালো বুঝবে বলেই ওকে তোমার কোলে দেওয়া হয়েছে। কে, কী বললো কখনও সেটা শোনার দরকার নাই। তোমার মন যা চাইবে তাই করবে।”

বক্তব্য শেষে দেখলাম শাশুড়ি মা ‘ঠিক বলেছো’ বলে তালি দিলেন। যাক বাবা, আমার শাশুড়ির সাথে জগতের সকল ভালো শাশুড়ি মরে যায়নি। কেউ কেউ এখনও বিরল শাশুড়ি হয়ে বেঁচেই আছেন।  

শেয়ার করুন:

এটা সর্বজনীন সত্য নয়। শুধু শ্বশুরবাড়ি কে এক তরফ বকা দেয়া কতটুকু যুক্তি সঙ্গত? নতুন মাকে অনেকেই উপদেশ দিতে চায়। অনেক সময় বাপের বাড়ির মানুষও অনেক কিছু চাপিয়ে দিতে চায়। সন্তান হবার খরচ শ্বশুরবাড়িও দেয়, সন্তানের বাবাও দেয়। আপনারা, যাদের কথা অনেকেই শোনেন, মানেন, তাদেরকে অনুরোধ এভাবে এক তরফা ভাবে লিখবেন না। তাতে করে মা হবার আগেই কারো কারো মনে শ্বশুর বাড়ি সম্পর্কে অহেতুক তিক্ততা সৃষ্টি হতে পারে।