অল দ্য বেস্ট টু ‘পুরুষতন্ত্র’

শারমিন শামস্: হঠাৎ করেই পুরুষতন্ত্রবাদীদের মনে একটা জোয়ার এসেছে। তারা হঠাৎ নড়েচড়ে বসেছেন। এতোদিন গা এলিয়ে বসে আয়েশ করে পান চিবিয়ে ঢেঁকুর তুলছিলেন। হয়তো মনে মনে ভেবেছিলেন, ‘তোদের কত ক্ষ্যামতা, সে জানা আছে’। কিন্তু অবস্থা যেভাবে এগোচ্ছে, মানে মেয়েরা, এমনকি কোন কোন পুরুষও যেভাবে পুরুষতন্ত্রের নিন্দা-মন্দ করতে শুরু করেছে, তাতে বিষয়টা অভিমান থেকে ক্রমে আতঙ্কের দিকে যাত্রা করেছে। কারণ মেয়েদের প্রতিবাদের এই রূপ তো আগে দেখেনি কেউ। এ যে অবিশ্বাস্য!

চিরটা কাল কী ঘটেছে? মেয়েদের ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে। এরপর থানা-পুলিশ হয়েছে। ধর্ষকের নামমাত্র শাস্তি হয়েছে। আর ধর্ষণের শিকার হওয়া মেয়েটি যদি বেঁচে থাকে তবে তো পোয়াবারো। পাড়াজুড়ে ঢি ঢি পড়ে গেছে। মেয়ে ঘরের ভিতরে অন্ধকার কোনায় লুকিয়েছে, মেয়ের বাপ-মা-ভাইবোন লুকিয়ে থেকেছে। তারপর একদিন মেয়ে আর সইতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়েছে। এইতো চলে আসছিল।

পত্রিকার পাতায় লেখা হচ্ছিল- অমুক মেয়ের সম্ভ্রমহানি, তমুক মেয়ের ইজ্জত লুটে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। তো এই দুর্বৃত্ত হেসেখেলে বেড়িয়েছে। আর মেয়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়েছে। কিন্তু আজ একী হচ্ছে! মেয়েতো মানতে রাজি নয় আর যে ধর্ষণ মানে সম্ভ্রমহানি। মেয়ে আজ বিচার চাইছে। থানায় গিয়ে নিজেই মামলা ঠুকে দিচ্ছে ধর্ষকের বিরুদ্ধে। চারিদিকে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড থেকে শুরু করে লিঙ্গ কর্তনের জোর দাবি তুলছে। যেন আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে তারা। তাদের প্রতিবাদের ভাষা, তাদের দাবি-দাওয়ায় এতো তেজ, এতো তীব্রতা!

moonmoon-4
শারমিন শামস্

তো স্বাভাবিক, পুরুষতন্ত্র একটু ধাক্কা খেয়েছে। অফিস শেষে দু’ঘণ্টা আড্ডা পিটিয়ে ঘরে ফিরে তিনি বৌরে বলতেন, ভাত দাও। সেই বৌ তারে উল্টা বলছে, নিজে নিয়ে খাও। তিনি বলছেন, কেন? বৌ বলেছে, অফিস থেকে ফিরে রেঁধেছি, বেড়েছি, বাচ্চা সামলেছি। এবার ঘরের বাকি কাজগুলো তুমি করো।

তো তিনি ভেবেছিলেন, লেবু চিপে মাছ-ভাত খেয়ে প্লেটখানা টেবিলেই উল্টে রেখে তিনি শয্যা নেবেন। তা হবে না তবে? তিনি ভেবেছিলেন, রাতে বৌরে ডাকামাত্র বৌ ছুটে এসে সেবারত হবেন, তা নয় বৌ বলছে, ‘কী করো বুঝি না। আমি তো কোনো ভালো লাগা পাই না! তবে কি আমার ভালো লাগতে নাই? আমারেও ভালো লাগাও’।

বড্ড বিপদে পড়েছেন তিনি। ঝগড়াঝাঁটির মুহূর্তে রেগে গিয়ে বৌরে ঠাস করে চড়টা-কিলটা-ঘুষিটা বসিয়ে দিয়েছেন। আজ বৌ হুমকি দিচ্ছে আর একটা আঘাত এলেই থানায় যাবে, মানবাধিকার সংস্থায় যাবে। অথবা বৌ নিজেই পাল্টা কিলঘুষি চালিয়ে দিচ্ছে। বড় বিপদে পড়েছে আজ মি. পুরুষতন্ত্র।

বৌয়ের বাচ্চা হবে। শাশুড়ি বলছে, ছেলে হওয়া চাই। বৌ আগে মনে মনে দোআ-দরুদ পড়তো। পীর ফকির ধরতো। ভয়ে বৌটা নম: নম: করে থাকতো। আজ হলোটা কী! বউ উল্টা মুখ-ঝামটা দিচ্ছে। ‘ছেলে না মেয়ে সে আমার কারণে হয় না, হয় আপনার ছেলের কারণে। তারে গিয়ে কন। আর ছেলে না, মেয়ে চাই আমি। আপনি কী চান তা নিয়ে আমি ভাবি না’।

এত্তো বড় সাহস এই বৌমার। শাশুড়ির হৃদকম্প শুরু হয়। পুরুষতন্ত্রের হৃদকম্প আবার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এখন আরো জোরে জোরে হয়। মা-ছেলে চিন্তায় অস্থির। বৌ পাল্টায়ে গেছে। অফিসে বসও চিন্তাযুক্ত। মেয়েকর্মীদের দিনরাত ‘তোমরা এই পারো না সেই পারো না’ এইসব বলে বলে বেতন কম দিয়েছে, ইনক্রিমেন্ট দেয়নি। এখন মেয়েরা প্রতিবাদ করছে। না হলে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে। যারা নারীদের সম্মান দিচ্ছে, কাজের মূল্যায়ন করছে, সমতা দিচ্ছে, সেইসব অফিসের গুণগান বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। মহা হ্যাপা।

এদিকে ভিডিও বের হচ্ছে। ভিডিওতে ছেলেমেয়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত- ছেলে নিজেই তা ছড়িয়ে দিচ্ছে, কারণ মেয়ে তাকে ছেড়ে গেছে। এরপর মেয়ের গলায় দড়ি ছাড়া আর কিছু তো করার নেই। ছেলে তা জানে বলেই জেনেশুনে এই পথ নিয়েছে। নিজে হাতে তো মারতে পারবো না, তবে মেয়ে তুই যাতে মরিস, সে ব্যবস্থাই নিচ্ছি। কিন্তু একি! মেয়ে তো মরেনি। বরং সাইবার আইনে মামলা ঠুকে দিয়েছে। মাথা উঁচু করে থানায় গিয়েছে। তাকে সমর্থন যুগিয়ে লেখালেখি চলছে। ছেলের হাতে তখন হাতকড়া। কী ভেবেছিল, আর কী হলো! ছেলে তো ছেলে, ছেলের গুষ্ঠীসুদ্ধর মাথায় হাত। সোনার চামচের দোষ ধরেনি কেউ এতোকাল। এখন এই মেয়েরাই আর সোনার চামচ পুছে না। বড্ড জটিল পরিস্থিতি। কী কাণ্ড কী কাণ্ড!

কোরবানির ঈদের আগে যেমন হাটে গিয়ে গরু দেখা হয়, বিয়ের আগে ছেলেও তেমন মেয়ে দেখতে বের হতো দল বেঁধে। মেয়েও ফর্সা রঙের মেকাপ করে লাস্যময়ী হয়ে হেঁটে চলে বিয়ে কনফার্ম করতো। যার হতো না, সে হতাশায় ভুগতো। আর ছেলে কনের বাড়িতে খাওয়া চা-নাশতার ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বলতো, ‘যাক অফিসে কেরানি হলে কী হবে, অন্তত একটা জায়গায় তো আমার ক্ষ্যামতা আছে। আমিও কাউরে রিজেক্ট করতে পারি বটে!’

তো এভাবে চলছিল। মেয়ে হঠাৎ বেঁকে বসেছে। মেয়ে এভাবে আর হাটে নামবে না। তাতে তার বিয়ে হয় হোক, না হয় না হোক। বিরাট যন্ত্রণা। আরো আরো অনেক আছে। বলে শেষ হবে না। এগুলো প্রাথমিক। শহরে মেয়েগুলো আর ওড়না পরতে চাইছে না। কাজের সুবিধা দেখে যা ইচ্ছে পরতে চায়, পরছেও। স্বামীকে পছন্দ না হলে মেয়ে নিজেই তালাক দিচ্ছে। স্বামীর অত্যাচার মেনে না নিয়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসছে। প্রতারক স্বামী বা প্রেমিকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিচ্ছে।

মেয়েরা অনেক পড়াশোনা করছে। প্রতিবছর মেয়েদের রেজাল্ট বেশি ভালো হচ্ছে। মেয়েরা চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে দারুণ করছে। মেয়েদের সততা আর দায়িত্ববোধ প্রশংসিত হচ্ছে। এদিকে মায়ের দায়িত্বও পালন করছে। বৃদ্ধ পিতামাতাকে মেয়েরাই দেখছে। ফলে সবাই বলছে, মেয়ে সন্তানই ভালো।

পাশা যে তবে উল্টে যাচ্ছে। ক্যামনে? বড্ড চিন্তায় পড়েছে পুরুষতন্ত্র। চারিদিকে লেখালেখি হচ্ছে। ‘এরা নারীবাদী’। এরা অবশ্য নিজেদের অতো বেশি নারীবাদী বলে চ্যাঁচায় না। ‘নারীবাদী নারীবাদী’ বলে চিৎকারটা আসলে পুরুষতন্ত্রেরই। তবে খুব কায়দা করে, খুব কৌশলে ব্যাপারটা ঘটানো হয়েছে যেন কেউ বুঝতেও না পারে। এমনকি কিছু আকাট মূর্খ নারীও ফাঁদে পা দিয়েছে, যারা নিজেদের নারীবাদী বলে চিৎকার করছে। আসলে সেও যে ওই পুরুষতন্ত্রের চিৎকারেই গলা মেলাচ্ছে তা সে নিজেই বুঝতে পারছে না।

তবে বুঝবে, সময় হলেই। সে পর্যন্ত টুকটাক সুবিধা নেবেই পুরুষতন্ত্র। কিন্তু প্রতিবাদের মিছিল তো থেমে নেই। লড়াইয়ের মাঠ তো উত্তপ্ত। মেয়ে নিজের প্রাপ্যটুকু যুঝে এবং বুঝে নিতে নেমেছে। নিয়েই ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে। আর ছাড়াছাড়ি নাই। কী কাণ্ড! অতএব পুরুষতন্ত্র এক গোপন মিটিংয়ে বসেছে। এজেন্ডা হাতে নিয়েছে। এবার ঢাল-তলোয়ার নিয়ে হাউমাউ করতে করতে নেমে পড়েছে ময়দানে। সাথে কিছু অনুচর অনুসারী- তারা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিচ্ছে- হাউ হাউ খাউ খাউ।

তো, মেয়েরা কি এসব দেখে ভড়কে গেছে? চিন্তায় পড়েছে? নাহ। মেয়েরা দূরদর্শী। তারা তো জানেই লেজে আগুন লাগলে এমনই ছুটোছুটি শুরু হয়ে যাবে। হচ্ছে। আরো আগেই হওয়ার কথা ছিল। তারা আলস্য করছিলেন বলেই একটু দেরি করে ফেললেন।

যাই হোক, অল দ্য বেস্ট টু পুরুষতন্ত্র। আপনাদের জংধরা তলোয়ার আর অতি ব্যবহৃত ঢাল নিয়ে লম্ফঝম্প অব্যাহত রাখুন। আমরা ঠাণ্ডা মাথায় ছিলাম, এখনো আছি। আমাদের কনসেপ্ট খুব পরিষ্কার। আমাদের দাবি ন্যায্য ও লড়াইটা সৎ, সুন্দর। তাই আমাদের হেরে যাবার কোনো ভয় নেই। ভালো থাকবেন।

(লেখাটি অনলাইন পত্রিকা পূর্বপশ্চিমবিডিডটকম থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন: